ক্রাইস্টচার্চ টেস্ট যেন পুরো সফরের প্রতিচ্ছবি!
শেষ হয়ে গেল টাইগারদের এবারের নিউজিল্যান্ড মিশন। এবারের সফরকে কী বলা যায়? একেকজন একেকভাবে ব্যাখ্যা করছেন। একেক জনের উপস্থাপন ভঙ্গি একেক রকম। কেউ বলছেন ৮-০। কেউবা হোয়াইটওয়াশের হ্যাটট্রিক। আবার কারো মতে তুলোধুনো। সামগ্রিকভাবে এ সফর ব্যর্থতার, হতাশার এবং সঙ্গে বেদনারও।
বারবার সম্ভাবনা জাগিয়েও শেষ হাসি হাসতে না পারার এক ব্যর্থ মিশন হিসেবেই পরিগণিত হয়ে থাকবে এবারের নিউজিল্যান্ড সফর। যে ক্রাইস্টচার্চের হ্যাগলি ওভালে গত ২৬ ডিসেম্বর প্রথম ওয়ানডে দিয়ে শুরু হয়েছিল এবারের নিউজিল্যান্ড মিশন। আজ একই মাঠে হতাশার এক বৃত্তে বন্দি থেকে শেষ হলো প্রায় এক মাসের সে পথ চলা।
পুরো সিরিজের চালচিত্রের সাথে এ টেস্টেরও কি অদ্ভুত মিল! এবারের নিউজিল্যান্ড সফরে জয় যদিও ‘সোনার হরিণ’ হয়েই থাকল; কিন্তু টাইগাররা বারবার জয়ের পথ খুঁজে পেয়েছে। সে পথে হেঁটে-দৌড়ে খানিকদুর এগিয়েও গেছে।
কখনো মনে হয়েছে, এইতো আর অল্প একটু পথ বাকি। তাহলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে গন্তব্যে। তিনটি করে ওয়ানডে আর দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে বেশ কবারই এমন হয়েছে। সম্ভাবনার সূর্য্য উঁকি দিয়েছে। মনে হচ্ছে এবার সাফল্য ধরা না দিয়েই যায় না। তারপর ঠিক একটি নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে সে সম্ভাবনার সূর্য্য মেঘে ঢেকে গেছে।
ওয়েলিংটন টেস্টেও এমন হয়েছে। প্রথম ইনিংসে ৫৯৫ রানের পাহাড়সম স্কোর গড়া দল দ্বিতীয় ইনিংসে ২০০‘র গণ্ডিও পার করতে না পেরে করুণভাবে হেরেছে।
আর ক্রাইস্টচার্চে ব্যাটিংয়ে খুব বেশি দুর যেতে না পারলেও তৃতীয় দিন শেষে সাকিবের ছোট্ট এক স্পিন ম্যাজিক ও পেসারদের সুনিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে প্রথম ইনিংসে লিড নেবার সম্ভাবনা জেগেছিল। ২৮৯ রানের মাঝারি পুঁজির স্কোর নিয়েও দ্বিতীয় দিন শেষে ২৬০ রানে কিউইদের ৭ উইকেট ফেলে দেযার পর মনে হচ্ছিল কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। টাইগারদের চোখে মুখেও মিলেছিল জয়ের নেশা।
কিন্তু হায়! একদিনের বৃষ্টিতে সব ওলট পালট। কোথায় গেল দ্বিতীয় দিনের দুর্দান্ত বোলিং। কোথায় গেলো দ্বিতীয় দিন পাওয়া স্পিরিট! উল্টো ব্যাকআপের বদলিতে ক্যাচ মিসের মহড়া। যেখানে প্রথম ইনিংসে এগিয়ে থাকার কথা। সেখানে পিছিয়ে থাকতে হল ৬৫ রানে।
এখানেই আসলে ছন্দপতন। জয়ের আশা তো উবে গেল, সঙ্গে শঙ্কা জন্ম নিল এবারও না বড় পরাজয় ঘটে! শেষ পর্যন্ত সেটাই ঘটলো। দ্বিতীয় ইনিংসের ব্যাটিংটা হলো যাচ্ছেতাই। সম্ভবত এবারের নিউজিল্যান্ড সফরের সবচেয়ে বাজে ব্যাটিং প্রদর্শনি হয়েছে এই হ্যাগলি ওভালে।
যেখানে একজন ব্যাটসম্যানও নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি। যেখানে ভাল খেলতে পারলে জয়ের সম্ভাবনা না থাক, ড্র করার পথ খুলবে- সেই ম্যাচে ছন্নছাড়া ও কাণ্ডজ্ঞানহীন ব্যাটিং! সুতরাং দিন শেষে ৯ উইকেটের করুণ পরাজয়।
যেখানে খেলার বাকি দেড় দিনেরও কিছু বেশি সময়। একদিন ক্রিজে কাটিয়ে দিতে পারলেই জয়ের সম্ভাবনা না জাগুক, নিশ্চিতভাবে ড্র করা যাবে- এ সত্য জেনে এবং বুঝে কী ব্যাটিং করল তামিমের দল?
প্রথম ইনিংসে তবু সৌম্য আর সাকিবের ব্যাট থেকে জোড়া হাফ সেঞ্চুরি বেরিয়ে এসেছিল। সৌম্য খেলেছেন ৮৬ রানের সাহসী ইনিংস। সাকিব তার মত খেলেই করেছিলেন ৫৯। দ্বিতীয় ইনিংসে কেউ চল্লিশের ঘরেও পৌঁছুতে পারেননি।
সর্বোচ্চ ৩৮ রান আসলো মাহমুদউল্লাহ রিয়াদেও ব্যাট থেকে। আর সৌম্য দ্বিতীয় সর্বোচ্চ করলেন ৩৬। সাকিব থেমে গেছেন মোটে ৮ রানে। ব্যাটসম্যানেেদর ব্যর্থতার মিছিলে ব্যতিক্রম ছিলেন দুই পেসার তাসকিন আহমেদ এবং কামরুল ইসলাম রাব্বি।
ধ্বংস্তুপের মাঝে দাঁড়িয়েও এই দুই বোলার প্রাণপন চেষ্টা করেছেন দলকে টেনে তুলতে। দলের অন্য ব্যাটসম্যানদের লজ্জায় ডুবিয়ে ইনিংসের সবচেয়ে বড় ৫১ রানের জুটিটা তাদেও হাতেই গড়া। তবুও ইনিংস শেষ হলো ১৭৩ রানে। যা প্রথম ইনিংসের চেয়ে আরও ১১৬ রান কম।
এতে কিউইদের সামনে টার্গেট দাঁড়াল মাত্র ১০৯ রান। চতুর্থ দিনে তখনও নিউজিল্যান্ডের হাতে ছিল ১৯ ওভার। সঙ্গে বাড়িয়ে দেয়া হল আরও ৩০ মিনিট। অন্তত ৫/৭ ওভার করা যায় এ সময়ের মধ্যে। ব্যাস তাতেই কাজ হয়ে গেল। শেষ দিনের জন্য অপেক্ষায় থাকলেন না স্বাগতিকরা। জিত রাভাল, টম লাথাম আর কলিন ডি গ্র্যান্ডহোমের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে দিন শেষে ৯ উইকেটের দারুণ এক জয় নিয়েই মাঠ ছাড়ল কেন উইলিয়ামসনের দল।
অন্যদিকে না পারার বেদনায় দগ্ধ হয়ে মাথা নিচু করে সাজঘরে ফিরলেন তামিম, সাকিব এবং মাহমুদউল্লাহরা। কেন এমন হল? জিততে না পারলেও এ ম্যাচে ড্র করার যথেষ্ঠ সম্ভাবনা ছিল। একটু দেখে ও ধৈর্য্য ধরে আজকের দিনটি কাটিয়ে দিতে পারলে, শেষ দিন ঘন্টা খানেক খেলতে পারলেই এ ম্যাচে হার এড়ানো যেত; কিন্তু ব্যাটিংটা তেমন হল না কেন?
এটা কি সামর্থ্যরে যথাযথ প্রয়োগে সমস্যা? নাকি সত্যিকারের একটি খারাপ দিন? প্রশ্ন উঠল। খেলা শেষে মিডিয়ার মুখোমুখি হয়ে বাংলাদেশ অধিনায়ক তামিম ইকবালের কথা, ‘আমার মনে হয় দুটোর কোনটাই না। তাহলে কী?’
তামিম জবাবে যা বলেছেন তার সারমর্ম হল, এবারে নিউজিল্যান্ড সফরে যা ঘটেছে, এ ম্যাচেও তাই ঘটেছে। পুরো সফরে যেমন কখনো কখনো আশার প্রদীপ জ্বেলে আবার একটা পর্যায়ে গিয়ে দপ করে নিভে গেছে। এ টেস্টেও তাই হয়েছে।
তাই তো তামিমের কথা, ‘আমি পুরো সফরের সাথে এ ম্যাচেরও মিল খুঁজে পেলাম। এবার নিউজিল্যান্ডে কম-বেশি সব খেলাতেই আমরা কোন না কোন সময় ভাল খেলেছি। একটা সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছিল। মনে হয়েছে কিছু একটা ঘটতে বা হতে যাচ্ছে; কিন্তু পরক্ষণেই ডুবতে হয়েছে আশা ভঙ্গের বেদনা নিয়ে। একবারও সাফল্যের নাগাল পাইনি। এ টেস্টেও তাই হল।’
তামিম বোঝাতে চাইলেন, পুরো নিউজিল্যান্ড সফরে যেভাবে সুযোগ সৃষ্টি করে এবং সম্ভাবনা তৈরি করেও শেষ হাসি হাসা সম্ভব হয়নি। উল্টো আশা ভঙ্গের বেদনায় পুড়তে হয়েছে, ক্রাইস্টচার্চ টেস্টেও তাই হল। তার মানে পুরো সিরিজ কাটল একইভাবে!
এক দুই ম্যাচ এমন হতে পারে; কিন্তু একটি সফরে তিনটি করে ছয় সীমিত ওভারের ম্যাচ আর দুই টেস্টে বারবার এমন সুযোগ তৈরি করে প্রতিবার শেষ দিকে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেল- এমন চিত্র খুব দেখা যায় কী?
এআরবি/আইএইচএস/জেআইএম