অনভ্যস্ততা ও প্রতিকূলতাকে জয় করার একদিন
খেলা শেষে তামিম ইকবালের কাছে এক কিউই সাংবাদিক খুব কায়দা করে জানতে চাইলেন, আচ্ছা যতটুকু সময়ই খেলা হোক না কেন, আপনার দলের রান ৩ উইকেটে ১৫৪। দিন শেষে কেউ যদি স্কোরবোর্ডের দিকে নির্দেশ করে আপনার কাছে জানতে চায় আপনি কি বলবেন ? ‘বাংলাদেশ টেস্ট দলের সহ-অধিনায়কের ছোট তবে চিবুক সোজা করা জবাব, ‘আমি বলবো আমি সন্তুষ্ট।’
কেন সন্তুষ্ট? পরিবেশ-পরিস্থিতি কেমন ছিল, ব্ল্যাক ক্যাপ্সরা কেমন বোলিং করেছে। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের অ্যাপ্রোচ অ্যাপ্লিকেশনই বা কেমন ছিল? এসব নিয়ে অনেক কথা বলেছেন তামিম। সব কথার শেষ কথা, ‘আমরা খারাপ করিনি। যা হয়েছে মন্দ না। ভালোই। তবে আরও ভাল বলা যেত, হয়তো দিনটি আমাদের জন্য আদর্শ হয়ে থাকতে পারতো যদি আমরা আরও একটি উইকেট কম হারাতাম। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ আউট না হলেই চলতো। তখন অনায়াসে বলা যেত আমরা একটি সত্যিকার ভাল দিন কাটিয়েছি। ’
শুধু তামিম ইকবালের কথা বলা কেন ? কিউই ফার্ষ্টবোলার নেইল ওয়েগনারও টাইগারদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। খেলা শেষে আনুষ্ঠানিক মিডিয়া সেশনে এসে এ বাঁহাতি ফাষ্ট মিডিয়াম বোলার বলে উঠলেন, ‘আমার তো মনে হয় এটা বাংলাদেশেরই দিন। তারা পুরো পরিবেশ পরিস্থিতিটা বেশ ভালোই মোকাবিলা করেছে। আমাদের কর্তৃত্ব ফলাতে দেয়নি।’
ওপরের এ কথোপকোথনটা শুধু বাংলাদেশের তামিম আর নিউজল্যান্ডের ওয়াগনারের ব্যক্তিগত মত হিসেবে ভাবার কোনই কারণ নেই। সামগ্রীকভাবে প্রথম টেস্টের প্রথম দিনটি বাংলাদেশের মন্দ কাটেনি। ভালোই গেছে। কেন কিভাবে? নিশ্চয়ই প্রশ্ন উঠবে। যারা প্রশ্ন করবেন, কিভাবে ভালো কাটলো? তাদের জন্য বলা, আজ টাইগারদের অ্যাপ্রোচ, অ্যাপ্লিকেশন এবং মাঠের পারফমেন্স মানে ব্যাটিংটাকে শুধু শুধু রান আর উইকেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না।
আসলে টাইগাররা অন্ত আজকের দিনটিতে হাজারো প্রতিকূলতা, অনভ্যস্ততা এবং বাধা বিপত্তিকে অতিক্রম করে গেছেন। তারা সব কিছুকেই আজ জয় করেছেন। ৪০.২ ওভার খেলা হয়েছে। উইকেট পড়েছে মোটে তিনটি। আর রানও দেড়শো পেড়িয়ে গেছে। তার মানে রান তোলা ও উইকেট আগলে রাখার কাজটিও খারাপ হয়নি।। তবে এটা সত্য মাহমুদউল্লাহ আউট না হলে এক কথায় ভালো বলা যেত। তারপরও অনেক প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে দিন শেষে এই অবস্থা।
আসুন দেখে নেই কি কি প্রতিকূলতা অতিক্রম করেছে টাইগাররা? প্রথম দেখতে হবে কোন কন্ডিশনে খেলা হয়েছে। তামিম ইকবাল অকপটে স্বীকার করেছেন, ‘আমরা জীবনেও এমন খারাপ, বৈরী ও প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে খেলিনি। আমার জানা নেই পৃথিবীর আর কোথাও এমন আবহাওয়ায় খেলা হয়। কোন আবেগতাড়িৎ সংলাপ নয়। তামিম এতটুকু বাড়িয়ে বলেননি। চরম খারাপ আবহাওয়া বলতে যা বোঝায় তাই। প্রচণ্ড, তীব্র আর দমকা ঝড়ো বাতাস যাই বলা হোক না কেন বেশি হবে না।
সমুদ্র উপকূলে ঝড়ের সময় বাংলাদেশে অন্যান্য জায়গায় যে বাতাস বয়ে যায়, তার প্রায় দ্বিগুণ বাতাস। যখন বাতাসের ঝাপটা আসে, এত জোরে যে, একজন মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন। মনে হবে তাকে পিছন থেকে কে যেন ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে ‘শো শো’ শব্দ। মনোযোগ-মনোসংযোগ রাখাই দায়। রীতিমত ভয়ের উদ্রেক ঘটে। মনে হয় চারদিকের সব কিছু ভেঙে চুরে যাবে। তার সঙ্গে বৃষ্টি এবং প্রচণ্ড ঠান্ডা। এমন আবহাওয়ায় ক্রিকেট খেলা, তাও টেস্ট ম্যাচ, এটা বাংলাদেশে স্বপ্নেও ভাবা যায় না। এমন আবহাওয়ায় টেস্ট ম্যাচতো অলিক কল্পনা, খুব কাজের তাড়া না থাকলে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ ঘরের বাইরেই বের হন না। কাজেই এমন কন্ডিশনের সঙ্গে পূর্ব পরিচয়ের প্রশ্নই ওঠে না।
আগে দু`চার বার এমন কন্ডিশনে খেলে গেলে একটা কথা ছিল। কিন্তু তাও হয়নি। এই ওয়েলিংটনে আট বছর আগে যে দলটি খেলে গেছে, তার ৭৫% ক্রিকেটারই নেই এ দলে। কাজেই এই অনভ্যস্ত কন্ডিশনে খেলার পূর্ব অভিজ্ঞতা কারো নেই। তামিম এই মাঠে নিউজিল্যান্ডের ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট খেলে গেছেন। প্র্যাকটিসও করেছেন। কিন্তু এমন আবহাওয়ায় খেলেননি কখনো। আর বাকিরা এ রকম পাগলা হাওয়া দেখলেনই প্রথম।
এটাই শেষ নয়। আরও প্রতিকূলতা আছে। সকালে এমন বৈরী আবহাওয়ায় টস না জেতাও একটা মানসিক ধাক্কার সামিল। কিন্তু তা কাটিয়ে ব্যাটিংয়ে নামা। কিন্তু হায়! এক ঘণ্টা পুরো হবার আগে ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে খেলা বন্ধ। এক ঘন্টা ২০ মিনিট পর আবার শুরু। ঘণ্টা দেড়েক হতেই আবার বৃষ্টির হানা। এবার তিন ঘণ্টা তিন মিনিট খেলা বন্ধ।
এরকম অবস্থায় মনোযোগ-মনোসংযোগ ধরে রাখা কঠিন। খেলা চলতে থাকলে লক্ষ্য-পরিকল্পনা অনুযায়ী খেলা যায়। একবার পরিকল্পনা মাফিক কিছু না হলে, পরক্ষণে তা শুধরে আবার চেষ্টার সুযোগ থাকে। কিন্তু সারা দিনে সাড়ে ছয় ঘন্টার জায়গায় যদি অর্ধেকেরও কম সময় খেলা হয়, সেটাও টানা নয়। ভেঙে ভেঙে। এবং অনেক্ষণ পর পর। তাহলে মনোযোগ-মনোসংযোগ ধরে রাখা খুব কঠিন। সে কঠিন কাজটিও করতে হয়েছে।
তার ওপর ঘাসের উইকেট। যেখানে কিউই বোলারদের দুর্দান্ত দাপট ও প্রতাপে অনেক বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানেরই নাভিশ্বাস ওঠে। তার চেয়ে বড় কথা এই বেসিন রিজার্ভে প্রথম ইনিংসে ভালো খেলা এবং বড় সড় স্কোর গড়ার রেকর্ড খুব কম। আজ তামিম ও মুমিনুলরা সে ধারারও ব্যতিক্রম ঘটিয়েছেন। তামিম একদম শতভাগ আস্থা, আত্ববিশ্বাস নিয়ে খেলে ৫০ বলে ৫৪ রানের এক উদ্দীপক ইনিংস খেলে পথ দেখিয়ে যান। আর সেই পথে হেটে মুমিনুল উপহার দেন এক সত্যিকার টেস্ট ইনিংস। শেষ পর্যন্ত ১১০ বলে ৬৪ রানে অপরাজিত থেকে সাজঘরে ফেরত আসা কক্সবাজারে এ প্রত্যয়ী যুবার এক সময় রান ছিল ২৯ বলে ৪।
মাহমুদউল্লাহও খেলেছেন দায়িত্ব নিয়ে। মুমিনুলের সাথে মাহমুদউল্লাহর জুটি দেখে মনে হচ্ছিল তারা অনেক দূর যাবেন। কিন্তু মাহমুদউল্লাহ ২৬ রানে গিয়ে যে ভুলটি করেন, তাতেই সর্বনাশ। যে পিচে প্রথম ইনিংসে গড় রান ২.৮২ । সেখানে তারা তিন উইকেটেই ৩.৮১ গড়ে দেড়শো পার করে দিয়েছেন। এটাই তো অনেক। বেশ কিছুটা সময় ধৈর্য ধরে বলে মেধা ও গুণ বিচার করে খেলার পর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ উইকেট ও পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে অযথা অফস্টাম্পের বাইরের বলকে তাড়া করে উইকেট বিসর্জন না দিলে সত্যিই দারুণ একদিন কাটতো বাংলাদেশের।
কিউই ফাস্ট বোলার ওয়েগনার অকপটে স্বীকার করেছেন, প্রথমদিন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের প্রতিরোধের মুখে তারা তেমন কিছু করতে পারেননি। যে ফরম্যাটে ট্র্যাক রেকর্ড সবচেয়ে ভালো, গত দুই তিন বছর যে ৫০ ওভারের ম্যাচে দল হিসেবে প্রায় প্রতিষ্ঠিত টাইগাররা সেই ওয়ানডেতে নাকাল।
টি-টোয়েন্টি সিরিজেও তুলোধুনো। অনেকেরই সংশয় ছিল, টেস্টে না জানি কি হয়? শেষ পরিনতি কি হবে, তা জানতে যদিও আরও ক`দিন অপেক্ষায় থাকতে হবে, তবে অতীব সমালোচকও মানবেন, এত সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা যে ব্যাটিং করেছে, তা সাধুবাদ পাবার যোগ্য। তাইতো কিউই ফাস্ট বোলার ওয়েগনারের মুখে এমন কথা – ‘এটা আসলে বাংলাদেশেরই দিন ছিল।’
এআরবি/এমআর/আরআইপি