‘সামর্থ্যের ঘাটতি নয়, পার্থক্য শুধু কন্ডিশনে’
নেলসনে ‘ট্রেলওয়েজ’ নামের যে হোটেলে টিম বাংলাদেশ আছে, তার লবি ও রিসিপশন দিয়ে ঢুকে অল্প কয়েক গজ গেলেই তার রুম। ওই রুমে ঢোকার প্রবেশ পথ দুটি। একটি মূল হোটেল বিল্ডিংয়ের ভিতর দিয়ে। অন্যটি বাইরে।
ওই দরজাটি আজ সকাল থেকেই খোলা। স্থানীয় সময় বেলা বারোটা নাগাদ খুললো সে দরজা। সেই যে খুললো দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামতেও তা খোলাই থাকল। সে দরজার বাইরে কিছু চেয়ার পাতা। ঠিক সেখানেই দেখা মিললো মাশরাফি বিন মুর্তজার। চেয়ারে বসা।
মুশফিক, সাকিব-তাসকিনরা পাশে দাঁড়ানো। তাদের সাথেই কথা বলছিলেন তিনি। স্বদেশি সাংবাদিকদের দেখামাত্র, কুশল বিনিময়। ‘আরে...! ভাই কেমন আছেন? সব খবর ভালো তো?’ তার আচরণ, কথা-বার্তা মোটামুটি স্বাভাবিক। চোখে-মুখে তেমন কোন হতাশার চিহ্নও নেই।
তা থাকার প্রশ্নও আসে না। তার অভিধানে তো হতাশা, দুঃখবোধ আর না পাবার অতৃপ্তি-অপ্রাপ্তি কোনটাই নেই তেমন। তাই বলে যে তিনি প্রাপ্তিতে খুব উচ্ছসিত হন, সৃষ্টিসুখের আনন্দে-উল্লাসে মেতে ওঠেন, তাও নয়।
আসলে মাশরাফি একটু ব্যতিক্রমি চরিত্র। পাওয়া না পাওয়া কোনটাই তার কাছে খুব বড় নয়। আজও সেই মাশরাফির দেখাই মিললো। কথা-বার্তা ও আচরণে বড় ধরনের কোন পার্থক্য নেই। তবে কখনো কখনো আনমনা হয়ে পড়লেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। কেমন যেন অন্যরকম মনে হলো তখন।
কথা বলে বোঝা গেল, দুই ম্যাচ টানা হারে বড় ধরনের কোন গ্লানি নেই তার। বরং ক্রিকেটারদের মানসিকতায় এক ধরনের সন্তুষ্টিই আছে। ছেলেরা যে বিনা যুদ্ধে হাল ছেড়ে দেয়নি। নিউজিল্যান্ডের অনভ্যস্ত কন্ডিশনে খেলতে আসার পর তাদের যে মনের বাঘে খায়নি, তাতেই সন্তুষ্ট অধিনায়ক মাশরাফি।
তার অনুভব, ছেলেরা একটুও ঘাবড়ে যায়নি। পাঁচ-ছয় বছর পর নিউজিল্যান্ডের অনভ্যস্ত কন্ডিশনে খেলতে এসে মনের যুদ্ধে হারেনি। মাঠে নামার আগে হেরে বসেনি। উল্টো মাঠে লড়েই জয়ের সুযোগ তৈরি করেছে।
হ্যাঁ সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে সাফল্যের মালা গলায় পরা হয়নি সত্য। তাতে না পারার অনুশোচনা আছে খানিকটা। তাই বলে হতাশা নেই। আর তা নেই বলেই মুখে এমন কথা, ‘এখানে (নিউজিল্যান্ডের মাটিতে) খেলতে জেতার সুযোগ তৈরি করতে পেরেছে কয়টা দল? উপমহাদেশের কয়টা দল পেরেছে বলুন? না ভারত, না পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার কেউ পারেনি। আমরা সুযোগ তৈরি করতে পেরেছি। জিততে পারিনি আমদের দোষে, সেটাও অবশ্যই আমাদের দায়।’
সে না পারার দায় মাথায় নিয়েই মাশরাফি বলে গেলেন, ‘হতাশার কি আছে? বরং আমরা যে দিনকে দিন উন্নতি করছি তার প্রমাণ মিলেছে এ সিরিজে। এখন পর্যন্ত জয়ের দেখা না মিললেও সে উন্নতির চিহ্নটাও কিন্তু ফুটে উঠেছে। আমরা যে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে এসে কিউইদের সাথে জয়ের সম্ভাবনা ও সুযোগ তৈরি করতে পারছি, সেটাই উন্নতির বড় নিদর্শণ।’
মাশরাফির দাবি, ‘ক্রিকেটারদের মানসিকতা এখন অনেক পাল্টে গেছে। আমরা কিন্তু মানসিকভাবে দূর্বল হইনি। যে মানসিকতা আছে সেটা নিয়ে খেলতে পারছি। মানসিকতা বদল হয়েছে। আমরা মনের দিক থেকে বিশ্বাস করি, এখানে এসে প্রতিদ্বন্দ্বীতা গড়ে তুলতে পারি। প্রথম ম্যাচে খারাপ বোলিং করার পরও ভাল ব্যাটিং করেছি। কালকে ১০০ রানে এক উইকেট থেকে মড়ক লাগার আগে পর্যন্ত আমরা ঠিকই ছিলাম। এরপর না হয় ভেঙ্গে পড়েছি। মানসিকতার দিক থেকে দেখলে বলতে হবে উন্নতি হয়েছে।’
নিউজিল্যান্ডেও নিজেদের জেতার সামর্থ্য আছে বলে মনে করেন মাশরাফি। তিনি বলেন, ‘আমাদের মানসিকতাই তো বদলে গেছে। জেতার সামর্থ্য যে নেই তা নয়। আছে। হয়ত সময়ের ব্যাপার। ভুলে গেলে চলবে না। নিউজিল্যান্ডও বাংলাদেশে গিয়ে পারে না।’
পার্থক্যর মূল জায়গাটা তাহলে কি? সামর্থ্য? না অন্য কিছু? এ প্রশ্নের জবাবটা মাশরাফি একটু ঘুরিয়ে দিয়েছেন। তবে কথায় পরিষ্কার বোঝা গেছে, তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, আসল পার্থক্য কন্ডিশনে।
নিউজিল্যান্ডের আবহাওয়া ও উইকেটও কি একটা বড় ভুমিকা রাখছে? মাশরাফির ব্যাখ্যা, ‘সেটা খুবই সিম্পল। এখানে বোলারদের লেন্থ ঠিক করা কঠিন। ওরা যেমন জানে, কোন লেন্থে বল করতে হবে, কোথায় ফেলতে হবে, বাতাসের সঙ্গে মানিয়ে কোথায় বাউন্সার করতে হবে। ওরা খুব ভালো জানে, কোন প্রান্ত থেকে কোন বোলার ভালো করবে। আমাদের দেশে যেমন আমরা এসব ভালো জানি। এসব কিছু সামান্য ব্যাপার আছে; কিন্তু এখানেই ওরা জিতে যায়। এই কন্ডিশনে ৫ বছর পর খেলছি আমরা। খুব স্বাভাকিভাবে ভাল করা কঠিন। নিউজিল্যান্ডের এই দল ভারতে গিয়ে সব ম্যচ হেরে এসেছে।’
এতক্ষণের আলাপে নিজের কথা একবারও উচ্চারন করেননি মাশরাফি। ২৪ ঘন্টা আগে তিনি যে দলের সেরা বোলিং করেছেন, সর্বাধিক তিন উইকেট দখল করেছেন, তার কিছুই উল্লেখ করতে নারাজ মাশরাফি।
টিম বাংলাদেশ অধিনায়কের কথা, ‘কি আর বলবো বলুন? নিজের পারফরমেন্স ভালো-মন্দ সবকিছু নির্ভর করে দলের ওপর। দল ভালো না করলে, আপনি যতই ভালো করেন, সেটার কার্যকারিতা থাকে না। আমি সবসময়ই চেষ্টা করি, সেভাবেই চেষ্টা করছি।’
আরআইবি/আইএইচএস/পিআর