সাবাশ বাংলাদেশ; স্যালুট মাশরাফি
অগ্নিঝরা মার্চ আমাদের স্বাধীনতার মাস। বিশ্বের বুকে একখণ্ড স্বাধীন ভূমির জন্য ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসের যে যুদ্ধ হয়েছিল তার শুরু এই মাসেই। তাই মার্চ ফিরে এলেই বাঙ্গালি আবেগপ্রবণ হয় বিজয়ের স্মৃতি রোমন্থনে। সেই আবেগে এবার যোগ হলো বাড়তি উপলক্ষ্য- বিশ্বকাপ ক্রিকেটে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের দুর্দান্ত জয়ের। এ জয়ে অভিনন্দন জানাই বাংলাদেশের টাইগারদের, অভিনন্দন জানাই ক্রিকেটপাগল ১৬ কোটি বাঙ্গালিকে।
তবে সবার আগে নত হৃদয়ে স্যালুট জানাই আমাদের দলনেতা, দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজাকে। আজ তাকে নিয়েই লিখতে বসেছি, যিনি আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে একজন আইকন। সত্যিকারের যোদ্ধা বলতে যা বোঝায় মাশরাফি তাই। সেই শুরু থেকেই ব্যথা-যন্ত্রণা নড়াইল এক্সপ্রেস খ্যাত এই পেসারের নিত্যসঙ্গী। এই ব্যথা শুধু শরীরে নয়, ছিলো মনেও। বারবার চোটের কারণে দল থেকে ছিটকে পড়েছেন।
মনে আছে, ২০১১ সালে ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে মাশরাফি বল হাতে দৌঁড়াতে পারেননি এই চোটের কবলে পড়ে। সেবার কেঁদেছিলেন তিনি, কাঁদিয়েছিলেন সারাদেশকে। নিয়তির কী খেয়াল! ক্যারিয়ার নিয়ে অনিশ্চয়তার মুখে চলে যাওয়া সেই মাশরাফির কাঁধেই এবার বাংলাদেশের দায়িত্ব। কী অসাধারণ কামব্যাক! কী চমৎকার প্রতিশোধ চোটের উপর। তার এই প্রত্যাবর্তন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে ক্রিকেট বিশ্বে। সবাই পঞ্চমুখ মাশরাফির ইচ্ছাশক্তির। সবচাইতে বড় আনন্দের বিষয় এবার তিনি খেলছেনও দুর্দান্ত।
এ পর্যন্ত চলতি আসরে দেশের হয়ে সেরা পারফর্মার হিসেবেই নাম আসবে তার। তাকে দেখেই গড়ে ওঠছে আমাদের নতুন প্রজন্মের ক্রিকেট। একজন বীর যোদ্ধার গল্প এর চেয়ে আর মহৎ হয় কী করে তা জানা নেই। চোটের সঙ্গে লড়তে লড়তে ক্লান্ত হননি, ভেঙে পড়েননি; সংশপ্তকের মতো উঠে দাঁড়িয়েছেন বারবার। নতুন উদ্যমে ফিরেছেন মাঠে। দেখিয়েছেন সর্বোচ্চ পারফরম্যান্স। হাঁটুর চোটের কারণে নি-ক্যাপ পরে মাঠে নামতে হয়। তবু নিজেকে উজাড় করে দিতে এতটুকু কার্পণ্য করেন না তিনি।
হয়তো অনেকেই বলবেন একজন খেলোয়ার হিসেবে টিকে থাকতেই এসব মোকাবিলা করে যাচ্ছেন মাশরাফি। তবে তার নতুন গল্পটা একটু ভিন্ন। মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে গিয়ে আমরা জেনেছি, ঘরে নতুন বউ রেখে অনেকে যুদ্ধে গিয়েছেন। কেউ কেউ অসুস্থ মা-বাবাকে রেখেও যুদ্ধে গিয়েছেন। কোনো কোনো পিতা সন্তানের মৃত্যুর খবর শুনেও বাড়ি আসতে চাননি যুদ্ধের প্রয়োজনে, দেশের প্রয়োজনে। এমন সব মহান ত্যাগের জন্যই তারা চিরকাল শ্রদ্ধেয় আমাদের কাছে। দেশ ভালোবেসে তেমনি ত্যাগের মানসিকতা রয়েছে এই মাশরাফিরও।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি তার ছোট ছেলে সোহেল মুর্তজা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। জানা যায়, পাঁচ মাসের ছেলেটা মাশরাফির অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তবে বেশি অসুস্থ হয় অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার পর থেকে। টাইফয়েডের সঙ্গে মূত্রাশয়ের সংক্রমণে সে অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি ছিলো। বিসিবিকে জানানোর পর অ্যাপোলোতে ভর্তি করার ব্যবস্থা করা হয়। বোর্ড বসিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। ইনজেকশনের সঙ্গে অন্যান্য চিকিৎসাও চলছিল। এখন সে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছে।
মাশরাফির মা হামিদা মুর্তজা জানালেন, সোহেলকে ২১টা ইনজেকশন দিতে হবে। এখনো অনেকগুলো বাকি। খবর পেয়ে নাকি খুব বিচলিত হয়েছেন মাশরাফি, কিন্তু মচকাননি। নিজের মন খারাপকে টিমের ভেতরে ছড়াতে দেননি। স্ত্রী সুমনা হককে বলেছেন ছেলের প্রতি মনযোগী হতে। নিজে মনযোগ দিয়েছেন দেশের লক্ষ্য অর্জনে। দেশকে সবার ঊর্ধ্বে ঠাঁই দিয়ে সন্তানের অসুস্থতার খবর বুকে চেপে নেমেছিলেন আফগান বধের নেতৃত্ব দিতে।
এমন দেশপ্রেমিক পিতার জন্য নিশ্চয় একদিন গর্ব করবে সোহেল। আজ যেমন আমরা গর্ব করছি তার বাবার মতো দেশপ্রেমিক খেলোয়ার পেয়ে। মাঠে সেদিন দারুণ খেলছিলেন মাশরাফি। আর মাঠের বাইরে তার ছেলের জন্য শুভকামনা জানিয়েছিল ১৬ কোটি বাঙ্গালি। আল্লাহর রহমতে সোহেল এখন সুস্থ। বাংলাদেশও তার বাবার নেতৃত্বে অনেকটাই বিপদমুক্ত।
এবার কেবল আর একটি জয়ের অপেক্ষা; সুপার এইট নিশ্চিত করতে। আমাদের বিশ্বাস মাশরাফির হাত ধরেই বাংলাদেশ এবার অনেকদূর যাবে। যতোটা যাবার স্বপ্ন প্রতিনিয়তই দেখছি আমরা। আর এই বিশ্বাসটা খেলোয়ার মাশরাফির জন্য নয়, বরং দলনেতা মাশরাফির জন্য। একজন আদর্শ ক্যাপ্টেনের মতোই তিনি বাংলাদেশ নামক জাহাজটাকে স্বপ্ন পূরণের বন্দরে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। দলের মধ্যে শৃংখলা, নিয়মানুবর্তিতা, খেলায় মনযোগ সর্বোপরি টিম বাংলাদেশ হয়ে একসাথে জয়ের জন্য লড়াই করার ইচ্ছেটা তিনি বপন করতে পেরেছেন।
তার মতো নেতার দলেই আমরা সাব্বিরের মতো চমৎকার মানসিকতার খেলোয়ারের সন্ধান পাই। যিনি চাইলেই স্কটল্যান্ডের সাথে খেলাটা শেষ করে ইতিহাসের নায়ক হতে পারতেন। কিন্তু তা না করে পরপর দুটি বল ডট দিয়ে উইকেটের অপর প্রান্তে ৪৮ রান নিয়ে হাফ সেঞ্চুরি থেকে মাত্র দুই রানের দূরত্বে থাকা সাকিবকে স্ট্রাইক করার সুযোগ দেন। আর সাকিবও জুনিয়রের দেয়া এই সম্মানকে স্মরণীয় করে রাখতে চার মেরে জয় এবং নিজের ব্যক্তিগত মাইলফলক দু’টিই অর্জন করলেন।
খেলা শেষে তাই জয়ের আনন্দের উৎসবেও প্রাণবন্ত হয়ে রইলো এই দৃশ্য। মাশরাফিও ধন্যবাদ দিলেন সাব্বিরকে এই খেলোয়ারিসুলভ আচরণের জন্য। হয়তো আমাদের কপিল দেব নেই, ইমরান খান নেই, স্টিভ ওয়াহ-রিকি পন্টিং-সৌরভ গাঙ্গুলি নেই; কিন্তু আমাদের একজন মাশরাফি আছেন।
বুকে হাত দিয়ে পরম নিশ্চিন্তে আমরা বলতে পারি জয়-পরাজয় যাই হোক, দলে এমন অনেক দৃশ্যই ইতিহাস হবে দল মাশরাফির মতো অভিভাবকের হাতে থাকলে। মাশরাফি ১৬ কোটি বাঙ্গালিকে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। বিশেষ করে অনেক বড় স্বপ্ন দেখানোর সাহস দিয়েছেন। তাই এবারের বিশ্বকাপ মিশনে নতুন ইতিহাসের অপেক্ষায় বাংলাদেশ। জয়তু বাংলাদেশের ক্রিকেট…জয়তু মাশরাফি……
বিএ/আরআই