ফুটবলকে থমকে দেওয়া বিমান দুর্ঘটনা
বিমান দুর্ঘটনায় আবার স্তদ্ধ হয়ে পড়েছে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন। মঙ্গলবার ব্রাজিলিয়ান ক্লাব শ্যাপেকোয়েন্সের খেলোয়াড়, কোচ, বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ আরো কিছু যাত্রী নিয়ে দুর্ঘটনায় তাদের বহনকারী বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। ফুটবল দলের খেলোয়াড়সহ ৭২ জন যাত্রীর পাশাপাশি ৯ জন ক্রুসহ বিমানটি বৈদ্যুতিক গোলোযোগের কারণে বিধ্বস্ত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে ৭৬ যাত্রী নিহত। এদের মধ্যে ছিলেন ২২ জন ফুটবলার। কোপা সুদামেরিকানার ফাইনালে খেলার জন্য দলটি কলম্বিয়া যাচ্ছিল। কলম্বিয়ার আকাশসীমায় প্রবেশের পর হঠাৎ করে বৈদ্যুতিক গোলযোগ দেখা দিয়ে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়।
বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ক্রীড়াঙ্গনকে এভাবে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগেও খেলোয়াড়দের নিয়ে বিমান দুর্ঘটনার বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। তবে বিমান দুর্ঘটনায় এক সঙ্গে এত সংখ্যক ফুটবল খেলোয়াড়ের মৃত্যুর ঘটনা এটি দ্বিতীয়।
বিমান দুর্ঘটনায় সবচেয়ে করুণ ঘটনা ঘটেছিল ১৯৯৩ সালে। ওই বছরের ২৭ এপ্রিল জাম্বিয়ার বিমান বিধ্বস্ত হয়ে দেশটির জাতীয় ফুটবল দলের ২২ খেলোয়াড়ই নিহত হয়েছিল। গ্যাবনের সমুদ্র উপকূলের মাত্র ৫৫০ গজ দূরে এই দুর্ঘটনা ঘটেছিল। সেনেগালের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপ ফুটবল বাছাইয়ের খেলায় অংশ নিতে জাম্বিয়া ফুটবল দল ডাকার যাচ্ছিল।
তদন্তে দেখা যায়, পাইলটের ভুলের কারণে বিমান যাত্রীদের এমন করুণ পরিণতি হয়েছিল সেদিন। বিমান আগুন ধরে যাওয়ার পর পাইলট ভুলক্রমে অন্য ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এর ফলে দুটো ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায় সেদিন। অবশ্য এই বিমানটি বেশ কয়েক মাস বন্ধ থাকার পর আবার চালু করা হয়েছিল।
ওই সময় পরীক্ষামূলক উড্ডয়নকালে বেশ কিছু ছোট-খাট ত্রুটি ধরা পড়লেও নির্ধারিত এই ফ্লাইটে বিমানটি রওয়ানা হয় এবং বিশ্ব ফুটবল অঙ্গনকে এমন করুণ পরিস্থিতির মুখোমুখি করে বিধ্বস্ত হয়।
তবে মৃতের সংখ্যার দিকে থেকে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা হয়ে আছে সাউদার্ন এয়ারওয়েজের ঘটনাটি। এ ঘটনায় আমেরিকার মার্শাল বিশ্ববিদ্যালয়ের থান্ডারিং হার্ড ফুটবল দলের ৩৭ জন ফুটবলার এবং নয়জন কোচিং কর্মকর্তা নিহত হয়েছিল। সব মিলিয়ে ৭৫জন বিমান যাত্রী নিহত হয়েছিলেন।
একই বিমানে ভ্রমণ করছিল মার্শালের অ্যাথলেটিক দল। সবকিছু ঠিকঠাক শুরু হলেও ল্যান্ড করার সময়েই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। ঘটনার সময় যেমন ছিল বৃষ্টি, তেমননি ছিল কুয়াশা। সব মিলিয়ে কঠিন পরিস্থিতি হলেও ল্যান্ড করা সম্ভব ছিল। তাছাড়া অভিজ্ঞ পাইলট বিমান চালাচ্ছিলেন; কিন্তু দুর্ভাগ্য সেদিন সব শেষ করে দিয়েছিল। অবতরণ করার সময় একটি গাছে আঘাত লেগে চুরমার হয়ে যায় বিমানটি। সঙ্গে সঙ্গে ৭৫ যাত্রীর মৃত্যু হয়।
কাছাকাছি সময়ে খেলোয়াড়দের মৃত্যুর বড় ঘটনা ঘটেছিল ১৯৮৭ সালের ৮ ডিসেম্বর। সে সময় পেরুর নৌবাহিনীর ফকার এফ-২৭-৪০০ বিমানে পেরুর ফুটবল ক্লাব অ্যালিয়াঞ্জা লিমা দল ভ্রমণের সময় নির্দিষ্ট লক্ষ্য থেকে মাত্র ছয় মাইল দূরে থাকতেই বিমানটি দুর্ঘটনায় পতিত হয়। ২৩ খেলোয়াড়ের পাশাপাশি কোচ, অন্যান্য কর্মকর্তা, চিয়ারলিডার এবং ক্রুসহ ৪৪ জন সদস্য ছিল ওই বিামনটিতে।
দুর্ঘটনায় পুরো দলই নিহত হয়। শুধু তাই নয়, বিমানের সব যাত্রীর মধ্যে শুধুমাত্র পাইলট রক্ষা পেয়েছিলেন। অ্যালিয়াঞ্জা দলটি পুকালপা থেকে পেরুভিয়ান লিগ ম্যাচ খেলে ফিরছিল। বিমানটি অবতরণের সময় পাইলট সমস্যা বুঝতে পেরে কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
ফলে সে সময় পাইলট আবার বিমানকে আকাশে নিয়ে যান এবং পরেরবার চেষ্টায় যখন অবতরণ করতে যান তখন বিমানটি বেশ নিচুতে নেমে পড়ে এবং সাগরে পড়ে যায়। দুর্ঘটনার পর পেরুর নৌবাহিনী সংবাদ মাধ্যম থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয় এবং তারা দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেনি।
এমনকি বেসরকারি কোনো তদন্ত সংস্থাকে তদন্তের অনুমতি দেয়নি। তবে অনুমান করা বিমানের মেকানিক্যাল অবস্থা ভালো না হওয়ায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। সে সময়ে এটি ছিল পেরুর বিমান দুর্ঘটনার ইতিহাস অষ্টম হৃদয় বিদারক ঘটনা।
খেলোয়াড়দের বিমান দুর্ঘটনার ইতিহাসে ঘটা প্রথম দুর্ঘটনায়ও মৃত্যুর শিকার হয়েছিল ২৩ খেলোয়াড়। ১৯৪৯ সালের ৪মে ঘটা এই দুর্ঘটনায় তুরিনো ফুটবল দলের পুরো দলই নিহত হয়েছিল। তুরিনো দলটি বেনফিকা ক্লাবের অধিনায়ক ফ্রান্সিসকো ফেরেইরার সম্মানে একটা প্রীতি ম্যাচে অংশ নিয়ে লিসবন থেকে দেশে ফিরছিল।
এ ঘটনায় তুরিনোর আসলে ইতালির জাতীয় দলের অধিকাংশ খেলোয়াড়সহ পুরো দলটি নিহত হয়েছিল। ক্লাব কর্মকর্তা, বিমানের ক্রু এবং ইতালির তিনজন বিখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক সবাই নিহত হয়েছিল। এই ঘটনায় ইতালির ফুটবল প্রেমিরা এতটা আঘাত পেয়েছিলেন যে, খেলোয়াড়দের অন্ত্যোষ্টিক্রিয়াতে প্রায় ১০ লাখ মানুষ উপস্থিত হয়েছিল।
তাছাড়া এই দুর্ঘটনা খেলোয়াড়দের মধ্যে বড় ধরণের এক ভীতি ছড়িয়ে দিয়েছিল। যে কারণে ১৯৫০ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ খেলার জন্য ইতালির জাতীয় দল আকাশ পথ নয় বেছে নিয়েছিল সমুদ্র পথ।
১৯৫৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারিতেও ঘটেছিল মারাত্মক এক দুর্ঘটনা। এ ঘটনায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের আটজন খেলোয়াড় ও তিনজন কর্মকর্তাসহ ১১জন নিহত হন। এছাড়া বিমানের আরো ১২জন যাত্রী নিহত হয়েছিল।
পশ্চিম জার্মানির মিউনিখ বিমানবন্দর থেকে তৃতীয় চেষ্টায় টেকঅফ করার সময় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। ৪৪জন যাত্রীর মধ্যে দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ২০ জন মারা গিয়েছিল, পরবর্তীতে আরো তিনজন মারা যায়। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ফুটবল দলটি ইউরোপিয়ান কাপে অংশ নিয়ে বেলগ্রেড থেকে ফিরছিল।
নন স্টপ ফ্লাইট হলেও তেল নেওয়ার জন্য মিউনিখে যাত্রা বিরতি করেছিল বিমানটি। দুইবার টেক অফের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরও পাইলট তৃতীয় চেষ্টা চালায়। কেননা সিডিউল জটিলতা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা পাইলট এমন ঝুঁকি নিয়েছিলেন। এই ঘটনা শুধু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে নয় ইংলিশ ফুটবলকে থমকে দিয়েছিল। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ১০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
জাগো চ্যাম্পিয়নের ১৭তম সংখ্যা পুরো পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে…।
আইএইচএস/এমএস