‘দ্যাখ দ্যাখ ওই যে মাবিয়া’
খিলগাঁওয়ের সিপাহীবাগের যে ফ্ল্যাটটিতে থাকেন মাবিয়া আক্তার সিমান্ত জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের মাধ্যমে তার ভাড়া পরিশোধ করছে সরকার। গত ১১ নভেম্বর নতুন বাসায় উঠেছেন গত এসএ গেমসে স্বর্ণজয়ী এ নারী ভারোত্তোলক। ৩ বেড ও ২ ড্রইং রুমের এ ফ্ল্যাটের ভাড়া মাসে ২২ হাজার টাকা।
যতদিন না মাবিয়ার জন্য নতুন ফ্ল্যাট নির্মান হবে, ততদিন নিজের মতো করেই থাকবেন তিনি। এসএ গেমসে স্বর্ণজয়ী তিন ক্রীড়াবিদের জন্য উত্তরায় ফ্ল্যাট নির্মাণ করছে রাজউক। গেমসের পরই তাদের ফ্ল্যাট দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে ঘোষণা বাস্তবায়নের কাজ চলছে এখন।
একটি স্বর্ণই বদলে দিয়েছে মাবিয়ার জীবন। খিলগাঁওয়ে একটি টিনের ঘরে থাকতো মাবিয়ার পরিবার। বাবা-মা, দুই বোন ও এক ভাইয়ের সংসারে এখন আনন্দের ফোয়ারা। মাদারীপুরের কুলপরুদী গ্রামের মো. হারুনুর রশিদ স্ত্রী আখতার বানুকে নিয়ে সংসার পেতেছিলেন খিলগাঁয়ে। মুদি দোকান করে চালাতেন সংসার। মাবিয়ার মামা শাহাদাত হোসেন নিজের জায়গায় তোলা টিনের ঘরটি দিয়েছিলেন তার বোনকে। নতুন ফ্ল্যাটে উঠে ঘরটি ভাড়া দিয়েছে হাজার দশেক টাকায়।
যে ভারোত্তোলন বদলে দিয়েছে একটি জীবন, একটি অস্বচ্ছল পরিবারে ফিরিয়ে এনেছে স্বচ্ছলতা সেই ভারোত্তোলনে কিভাবে এলেন মাবিয়া? প্রথম দিন ভারোত্তোলনের আঙ্গিনায় এসে যে মেয়েটি ভয় পেয়েছিলেন, তার এখন স্বপ্ন ভারোত্তোলেনর মাধ্যমে নিজেকে এমন এক উচ্চতায় তোলা যেখানে আর কেউ পৌঁছতে পারবেন না সহজে। তো মাবিয়ার কাছেই জানা যাক কিভাবে দু:খের সাগর পাড়ি দিয়ে এখন সুখের দরিয়ায় নোঙর ফেলেছেন।
‘টানাটানির সংসার ছিল আমাদের। বাবার ছোট্ট মুদি দোকানের আয়ে ঠিকভাবে চলতে পারতাম না আমরা। আমারও তখন পড়াশুনা ভালো লাগতো না। মামা ক্রীড়াঙ্গনের মানুষ। তিনি বক্সিং কোচ। ২০১০ সালে দেশে মেয়েদের ভারোত্তোলনের প্রচলন ছিল না। একদিন মামা আমাকে নিয়ে যান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের জিমনেসিয়ামে। সেখানে চলছিল ভরোত্তোলনের অনুশীলন। ভারোত্তোলকদের ওজন তোলা দেখে আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। এতো ওজন কিভাবে তোলে? ওয়েট-প্লেটগুলো ফ্লোরে ফেলার বিকট শব্দ, চারিদিকে হৈ চৈয়ে কিছু সময়ের মধ্যেই আমার মাথাব্যাথা শুরু হয়ে যায়। প্রথম দিন আর ভারোত্তোলনের বার ছুঁয়ে দেখা হয়নি। দেখেই অবস্থা কাহিল হয়েছিল আমার। তিন সপ্তাহ পর প্রথম ওজন তোলার চেষ্টা করি। মাঝের দিনগুলোতে শুধু লাফালাফি করেছি ফিটনেসের জন্য। ওটা আমার ভালোই লেগেছিল। আমি যে ছোট সময় থেকেই লাফালাফি পছন্দ করতাম। মার্বেল খেলা, দৌড়ঝাপ করা, কুত কুত আর কানামাছি খেলাই ছিল আমার কাজ’- জাগো নিউজের সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডায় বলছিলেন স্বর্ণকন্যা মাবিয়া।
ভারোত্তোলন জগতে ঢোকার এক বছরের মধ্যেই প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন মাবিয়া। ২০১১ সালে এলাকার যুব সংসদের হয়ে ক্লাব কাপে অংশ নেন। পরের বছর জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ৪৮ কেজিতে রৌপ্য জিতে প্রথম নজরে আসেন এবং ২০১৫ সালে ভারতের পুনেতে অনুষ্ঠিত যুব কমনওয়েলথ ভারোত্তোলনে স্বর্ণ জয়ের পর চাকরি পান বাংলাদেশ আনসারে।
নিজের সাড়ে ৩হাজার টাকা বেতন, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করা ছোট ভাই রাসেলের হাজার পাঁচেক টাকা আর বোন আঞ্জুমান মনির ঘরে সেলাইয়ের কাজ মিলে কিছুটা স্বচ্ছলতা ফিরে আসে মাবিয়াদের পরিবারে। এখন তো পুরো পরিবারই সুখ দেখতে শুরু করেছেন।
জীবনটাকে ভালোই উপভোগ করছেন মাবিয়া। জাগো নিউজের সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডায় মাবিয়া বলেন, ‘আমি এমন উজ্জ্বল একটা জীবনই চেয়েছিলাম। এখন আমাকে দেশের অনেক মানুষ চেনে। অনেক বিত্তশালী আছে যাদের একটি গন্ডির বাইরে কেউ চেনে না; কিন্তু
আমি মাবিয়া দেশের অনেক মানুষের কাছেই পরিচিত।’
এই ব্যাপক পরিচিতির উল্টো দিকও দেখছেন মাবিয়া। ঠিক যাকে বলে খ্যাতির বিড়ম্বনা। সেটা কি রকম তা জানা যাক মাবিয়ার কাছেই। ‘যখন কোথাও যাই তখন অনেককে বলতে শুনি, দ্যাখ দ্যাখ ওই যে মাবিয়া। এসবে মাঝে মধ্যে আনন্দ পাই, মাঝে মধ্যে বিব্রতও হই।’ দূর থেকেই এসব বলে নাকি সামনে এসে কথাও বলতে চায় কেউ? ‘হ্যা, মাঝে-মধ্যে কেউ কাছে এসে বলে, আপা আপনি কি মাবিয়া? আবার কেউ পরিচয় জানার পর সেলফি তোলারও আবদার করেন। কেউ আবার মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে ফোনও করেন’- হাসতে হাসতে বলেন মাবিয়া।
বিভিন্ন ধরনের মানুষের যোগাযোগ করা, ফোন করা- এর মধ্যে মজার কোনো কিছু আছে? এই যেমন কেউ প্রেম-ট্রেম নিবেদন করে কি না। ‘করে না আবার? করে। তবে আমি ভালোবাসায় বিশ্বাস করি কম। কারণ অনেকেই প্রতারণা করেন’- বলেন মাবিয়া। যারা প্রস্তাব দেন তাদের আপনি কি বলেন? ‘না বলে দেই, আর কি বলবো?’- মাবিয়ার মুখে মুচকি হাসি।
এভাবে কতজনকে ফেরাবেন? যদি কাউকে পছন্দ হয়ে যায় তখন কি হবে? ‘ঠিকই বলেছেন। মানুষ তো তাই না? তবে এমন কাউকে যদি পছন্দ হয়েই যায় তাকে শর্ত দেবো বিয়ে ২০১৮ সালের আগে না। সেটা ২০২০ সালেও হতে পারে। এছাড়া আমার খেলার ব্যাপারে তার সহযোগিতার নিশ্চয়তা থাকতেই হবে’- নিজের ব্যক্তিগত পরিকল্পনার কথা বলছিলেন মাবিয়া।
গত কোরবানির ঈদে পুরো পরিবার গিয়েছিলেন গ্রামের বাড়িতে। সেটাই মাবিয়ার প্রথম বাব-দাদার ভিটে-মাটিতে যাওয়া। সপ্তাহখানেক ছিলেন মাদারীপুরে। অনেক মজার অভিজ্ঞতার কথা বললেন মাবিয়া, ‘যখন বাড়ীতে পৌঁছাই তখন বিকাল ৪টার মতো। ভেবেছিলাম একটু বিশ্রাম নেব; কিন্তু আমার দাদী কিছুক্ষণ পরপর একেকজনকে নিয়ে আসেন এবং বলেন উনি তোর অমুক হন, তমুক হন। সন্ধ্যা পর্যন্ত মানুষ আসতেইছিল বাসায়। তাই সন্ধ্যার পর বের হয়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম লেকের পাড়ে। তাতেও মুক্তি ছিল না। যেই সামনে পড়ে, বলতে থাকে মাবিয়া কেমন আছিস? কিন্তু আমি তো কাউকে চিনি না। আমার বাবারা ৪ ভাই। সবার ছেলে-মেয়ে মিলে আমরা ১১ ভাই-বোন। একসঙ্গে হওয়ার পর মনে হয়েছিল যেন মিছিল বের হয়েছে। হা হা হা।’
এসএ গেমসে স্বর্ণ পাওয়ার পর ওভাবে কেঁদেছিলেন কেন? ‘মাঝে মধ্যে ওই ভিডিওটি দেখি। এখন ওই কান্না দেখলে আমার হাসি পায়। ভাবি কিভাবে কেঁদেছিলাম। আসলে মনের ভেতর থেকে কান্না এসেছিল। কারণও আছে। আমি স্বর্ণ পাবো তাতো কারো কাছে প্রত্যাশা ছিল না। যে কারণে ওই সময় কর্মকর্তারাও থাকেননি। যাক, সে অনেক কথা।
ওই ছবিটা আমার বাবা তার মোবাইলের স্ক্রিনে রেখেছেন। আমার যখন মন খারাপ থাকে তখন ওই ছবিটা দেখি। বাবা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ফ্ল্যাটে উঠলে ছবিটা বড় করে এমন জায়গায় রাখবেন যাতে কেউ ঘরে ঢুকলেই প্রথমে তার চোখে পড়ে’- বলছিলেন মাবিয়া।
আরআই/আইএইচএস/এমএস