ব্রাজিলে আবার প্রজাপতির রঙ
আমাজনের অরণ্যে সেই কবে হারিয়ে যায় প্রজাপতিটা! রঙ নিয়ে, সৌন্দর্য নিয়ে। মাঝে বিশ্বকাপ পর্যন্ত বারদুয়েক জেতে ব্রাজিল; কিন্তু প্রজাপতির ডানার ওই রঙ-সৌন্দর্য ফেরেনি তাদের খেলায়। ফুটবল রোমান্টিকদের নস্টালজিয়াতেই থেকে যায় তা।
বহু বছর পর তিতে আবার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন ব্রাজিলিয়ানদের। সবুজ এই গ্রহে রোদ্দুরের মতো ছড়িয়ে থাকা তাদের সমর্থকদের। আবার যে ‘জোগো বোনিতো’র সুর ফিরছে ব্রাজিলের খেলায়! আবার যে ফিরছে সাম্বার ছন্দ! একই সঙ্গে সাফল্যের সাম্পানও নোঙর করছে জয়ের বন্দরে। নতুন কোচ তিতের অধীনে ছয় ম্যাচে ছয় জয় তো সে সাক্ষ্যই দেয়।
ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের ভক্ত-অনুরক্তরা তাই স্বপ্ন দেখবেন না কেন!
এই স্বপ্নের ঘুড়ির আকাশ ফুঁড়ে মহাকাশে যাত্রা গেল সপ্তাহান্তে। সেই অভিশপ্ত বেলো হরিজন্তে। ২০১৪ বিশ্বকাপে যে শহরে এসে প্রত্যাশার ঘুড়ির ভোকাট্টা হয়ে যায়। তা-ও কিভাবে! সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ১-৭ গোলের হারে! ব্রাজিলের জন্য ৬৪ বছর আগের ‘মারাকানাজো’ ভোলার যে মঞ্চ তৈরী হয় আরেকবার বিশ্বকাপ আয়োজনে, তাঁদের জন্য কিনা আরেক চিরক্ষত নিয়ে আসে ‘মিনেইরাজো’। ওই মাঠে আবার ফিরলে ইতিহাসের পাতা থেকে বিদ্রুপের উঁকিঝুঁকি তো থাকবেই।
তার ওপর প্রতিপক্ষ আর্জেন্টিনা। ব্রাজিলের সঙ্গে প্রবল টক্কর যাদের। না হয় নতুন কোচ এদগার্দো বাউসার অধীনে আলবিসেলেস্তে-ক্যারাভানের পথচলার শুরুটা মসৃণ হয়নি; কিন্তু সেজন্য ইনজুরির কারণে লিওনেল মেসির খেলতে না পারাও তো এর বড় কারণ। ব্রাজিলের বিপক্ষে ওই পাঁচবারের ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলারের প্রত্যাবর্তন। পেছনে মিনেইরাজো অভিশাপ, সামনে মেসির আর্জেন্টিনা- দুয়ে মিলে আশঙ্কার এক চোরাস্রোত ঠিকই বয়ে যায় ব্রাজিলিয়ানদের মনে।
সেটিকে কী দারুণভাবেই না সাফল্য-কল্লোলে রূপান্তর নেইমার-কৌতিনিয়ো-জেসুসদের! ৩-০ গোলের রাজসিক এক জয়ে!
২০০২ আসরের পর থেকে বিশ্বকাপের ওই সোনালী ট্রফির সঙ্গে আড়ি ব্রাজিলের। সৌন্দর্যের সঙ্গে প্রবল আপোষও। কিন্তু আর্জেন্টিনার বিপক্ষে আশ্চর্য দাপট এই সময়ে। ২০০৪ কোপা আমেরিকার ফাইনালে যেমন অতিরিক্ত সময়ে গিয়ে ম্যাচে সমতা ফিরিয়ে টাইব্রেকারে জিতে যায়। পরের বছর কনফেডারেশন কাপ ফাইনালে ৪-১ গোলের জয়। ২০০৭ সালে কোপা আমেরিকা ফাইনালে ৩-০ ব্যবধানে। ২০০৯ সালে বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে আবার ৩-১ গোলে। কিন্তু এর কোনোটিই ঠিক প্রথাগত ব্রাজিলিয়ান উপায়ে না। রক্ষণ জমাট থেকে প্রতিআক্রমণ নির্ভর ইউরোপিয়ান ঘরাণায় ফুটবলের ফসল বরং। ২০১২ অলিম্পিক প্রস্তুতির সময়ের ম্যাচটিকে বলা যায় ব্য্যতিক্রম। যেখানে পায়ে পায়ে সৌন্দর্যের ফুল ফুটিয়েও মেসির হ্যাটট্রিকে ব্রাজিল হেরে যায় ৩-৪ গোলে।
এবার আর তেমন কিছু হয়নি। ইউরোপিয়ান ঘরাণার ফুটবল খেলেনি, আবার সৌন্দর্যের পথে হাঁটতে গিয়ে আত্মসমর্পনের পতাকাও ওড়ায়নি। মেসির আর্জেন্টিনার বিপক্ষে জয় আসে ৩-০ গোলে। তবে প্রবল প্রতিপক্ষের বিপক্ষে যে প্রবল আধিপত্য নিয়ে খেলে সেদিন ব্রাজিল, তাতে এর অন্তত দ্বিগুণ গোলও হতে পারত। হয়নি, তাতে কী? ব্রাজিলের বিশ্বকাপ-স্বপ্নের সমাধিক্ষেত্র বেলো হরিজন্তেতে তো প্রোথিত হয়ে যায় স্বপ্নের নতুন চারা। সৌন্দর্য-সাফল্যে একদিন যা মহীরুহ হয়ে ওঠার আশা।
ব্রাজিলের এই ঘুরে দাঁড়ানোর মহানায়ক তিতে। কোপা আমেরিকার পর কার্লোস দুঙ্গার কাছ থেকে দায়িত্ব পান তিনি। যে দায়িত্ব আরো অন্তত দুবার পাওয়ার কথা ছিল। ২০১২ সালে মানো মেনেজেসের বরখাস্তের পর তিতেকে উপেক্ষা করে জাতীয় দলের কোচ করা হয় লুইস ফেলিপে স্কলারিকে। ২০১৪ বিশ্বকাপের পর দুঙ্গাকে। কিন্তু এবার আর উপেক্ষার উপায় থাকে না! তিতে বরং প্রস্তাব পাওয়ার পর অপেক্ষায় রাখেন ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ফেডারেশনকে। শেষ পর্যন্ত তিনি ‘হ্যাঁ’ বললে তা বড় এক স্বস্তির সুবাতাস বইয়ে দেয় সে দেশের ফুটবলের অন্দরমহলে।
তাই বলে বিশ্বাসের যে পাহাড় ধসে পড়ে, সেটিকে যে এত তাড়াতাড়ি আবার দাঁড় করিয়ে দেবেন তিতে- এতটা ভাবা যায়নি। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের মাঝপথে শুরু তাঁর অভিযান। দায়িত্ব নেওয়ার সময় টেবিলের ছয় নম্বরে ব্রাজিল। কিন্তু ছয় ম্যাচের ছয় জয়ে এখন সবার উপরে। এতে ১৭ গোল দেওয়ার বিপরীতে হজম করে মাত্র এক গোল। পরিসংখ্যানের পাতাতেই সেলেসাওদের কি জোগো বোনিতোর সুরটা শোনা যাচ্ছে না?
তিতের সাফল্য-সূর্য মধ্যগগণে ছিল করিন্থিয়ানসে। সে ক্লাবের হয়ে কোপা লিবের্তাদোরেস জেতেন তিনি। ওই দল ছিল রক্ষণাত্মক ফুটবলের পূজারি। স্ট্রাইকারবিহীন ৪-৬-০ ফর্মেশনে অভ্যস্ত; কিন্তু মাঝে এক বছরের স্বেচ্ছা নির্বাসনে আধুনিক ফুটবল নিয়ে এই কোচ পড়াশোনা করেন ব্যাপক। ঘুরে বেড়ান আর্সেনাল, রিয়াল মাদ্রিদ সহ ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবে। তাতেই বদলে যায় তিতের মনোজগত। যে কারণে এবার ব্রাজিলের ফুটবলারদের দেন তিনি সৃষ্টিশীলতার অনুমোদন।
তাই তো নেইমার হয়ে ওঠেন আরো পরিণত। প্রতিশ্রুতিকে পারফরম্যান্সে রূপান্তর শুরু করে কৌতিনিয়ো। চীনের ঘরোয়া ফুটবলে খেলায় সামর্থ্যরে মরচে ধরার সংশয় দূর করে দেন পাওলিনিয়ো-রেনাতো অগুস্তো। আর গ্যাব্রিয়েল জেসুস? বহু বছর পর যেন সত্যিকারের আরেক ‘নাম্বার নাইন’ পায় ব্রাজিল। ছয় ম্যাচে পাঁচ গোল করে যার প্রমাণ দেন তিনি। স্বয়ং কিংবদন্তি রোনালদোর পর্যন্ত ১৯ বছরের জেসুসের খেলা দেখে মনে যায় নিজের প্রথম যৌবনের কথা। এর চেয়ে বড় স্বীকৃতি আর কী হতে পারে!
আর তিতের ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি আবার ‘জোগো বোনিতো’র কক্ষপথে ফেরা। আমাজনে হারিয়ে যাওয়া প্রজাপতির রং-সৌন্দর্য ফেরানো। শুধু ব্রাজিলিয়ান সমর্থক না, বিশ্ব ফুটবলের জন্যও এ যে পরম প্রাপ্তি!
আইএইচএস/পিআর