বিপিএল মানেই মাশরাফি
মাশরাফি নামটার সঙ্গেই কেমন যেন ‘ভাগ্য’ ‘ভাগ্য’ জড়িত। শুধু ভাগ্যই নয়, মাশরাফি যেন কোনো এক জাদুর কাঠি। যার পরশে পাথরও হয়ে যায় সোনা। জাতীয় দল, কিংবা বিপিএল- যেখানেই হাত দিয়েছেন, সোনা ফলেছে। তুখোড় বুদ্ধি আর দারুণ বিশ্লেষণী ক্ষমতা, প্রতিভা খুঁজে বের করার সহজাত প্রবণতা- সব মিলিয়ে মাশরাফির মাঝে সম্পূর্ণ এক ক্রিকেটারেরই প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। যার হাত ধরে সাফল্য আসবেই। এতে যেন কোনো সন্দেহ নেই।
শুধু বিপিএলের কথা ধরুন না! অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে। মাশরাফি নামক পরশ পাথর মানেই বিপিএলে ‘সাফল্য’। সাফল্য বলতে ‘চূড়ান্ত’ কিছু। একটা-দুটা ম্যাচে জয়কে চূড়ান্ত সফলতা বলা যায় না। চূড়ান্ত সফলতা হলো, বিজয়ের মুকুট নিজের মাথায় পরে নেয়া। মাশরাফি যেখানে বিপিএল খেলবেন, আর সেখানে অন্য কেউ বিজয়ের মুকুট ছিনিয়ে নেবে- সেটা যেন অকল্পনীয়। অন্তত বিপিএলের গত তিন আসরকে সামনে আনলেই, সেটা মানতে বাধ্য হবে সবাই।
এবারও আছেন মাশরাফি। তার নেতৃত্বে এবারও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সের হয়ে প্রথম দুই আসরের পর, তার নেতৃত্বে এবার কী তবে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সও জোড়া সাফল্য ঘরে তুলে নেবে! আপাতত এসব নিয়ে ভাবনা নেই মাশরাফি ভক্তদের। তাদের কাছে এখন বিপিএল মানেই মাশরাফি। মাশরাফি মানেই বিপিএল। ভিন্নভাবে বললে, মাশরাফি মানেই বিপিএলের ফেরিওয়ালা।
সর্বনাশা ইনজুরি মাশরাফির ক্যারিয়ারের সঙ্গী। এখন পর্যন্ত ১০ বারের বেশি হাঁটুতে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে মাশরাফির। এক-একটা ইনজুরি তাকে মাঠ থেকে সরিয়ে রেখেছিল আট থেকে দশ মাস। আবার অদম্য মানসিক শক্তি দিয়ে ফিরে এসেছেন বার বার।
অস্ট্রেলিয়ার যে চিকিৎসকের কাছে হাঁটুর চিকিৎসা করান নড়াইল এক্সপ্রেস, সেই ডেভিড ইয়াং বিস্ময় নিয়ে বলেছিলেন, যে পরিমাণ অস্ত্রোপচার মাশরাফির হাঁটুতে করা হয়েছে, তাতে তো তার উঠে দাঁড়াতেই পারার কথা নয়। যেখানে দুটির বেশি তিনটি অপারেশন করলেই ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায় একজন ক্রিকেটারের, সেখানে মাশরাফির প্রায় ১০টি! বিস্ময়কর না হলে কী কখনও সম্ভব হতো মাশরাফির বার বার মাঠে ফিরে আসা!
এসেছেন দেশের টানে। লাল-সবুজ পতাকার টানে। এই খেলাটা দিয়েই তো মাশরাফিরা বিশ্বের বুকে পতপত করে ওড়াতে পেরেছেন লাল-সবুজ পতাকাটা। বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে যখন অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড কিংবা ভারতের সাথে বাংলাদেশের পতাকা সমান উচ্চতায় উড়তে থাকে, সগৌরবে সেই পতাকাকে আরও উচ্চকিত করে তোলেন মাশরাফিরা, তখন গর্বে বুক ফুলে উঠবে না কার, বলুন!
মাশরাফির মতো ক্রিকেটাররা শত ইনজুরি সত্ত্বেও দেশের টানে এভাবে নিজের বুক পেতে দেন ক্রিকেটের সবুজ জমিনে। তবুও নিজেদের অর্জনকে তারা কোনোভাবেই মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তুলনা করতে পারেন না। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের বিশ্বকাপে যখন বাংলাদেশ একের পর এক বিস্ময় সৃষ্টি করে যাচ্ছিলো, যখন ভক্তরা তাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তুলনা করছিল, তখন মাশরাফি নিজেই বলেছিলেন, ‘আমরা নই। দেশের প্রকৃত বীর তো মুক্তিযোদ্ধারা। যারা আমাদের একটা দেশ, একটি পতাকা উপহার দিয়েছেন। আমরা তো শুধু কিছুক্ষণের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা করি মাত্র।’
মাঠে নামার আগে একটা কাজ নিয়মিতই করতে হয় মাশরাফিকে। ৩০ থেকে ৪০ মিনিট ধরে হাঁটুতে পট্টি বাধতে হয়। তারপর লাগাতে হয় ‘নি’ ক্যাপ। এরপরই মাঠে নামার জন্য উপযোগী হয় তার হাঁটু। শুধু তাই নয়, নিয়মিতই সিরিঞ্জ দিয়ে হাঁটুতে জমে থাকা পানি টেনে বের করতে হয় তাকে। অসম্ভব একটি কাজ। কেউ কল্পনাও করতে পারবে না; কিন্তু দেশের হয়ে খেলার জন্য মাশরাফি এভাবেই নিজেকে তৈরি করেন।
সেই মাশরাফি যখন জাতীয় দলের নেতৃত্ব হাতে তুলে নিলেন, সাফল্যও লুটোপুটি খেয়ে পড়তে লাগলো তার পায়ে। ২০১৪ সালের শেষ দিকে জিম্বাবুয়ে সিরিজ থেকে শুরু। এরপর বিশ্বকাপ, পাকিস্তান, ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ, এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টি, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, আফগানিস্তান কিংবা ইংল্যান্ড সিরিজ। একের পর এক বাংলাদেশকে শুধু সাফল্যের মালাই পরিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
গত বছর নতুন ফ্রাঞ্চাইজি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। সাবেক বিসিবি এবং আইসিসি প্রেসিডেন্ট, বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামালের মেয়ে নাফিসা কামালের মালিকানাধীন দলটির নেতৃত্ব তুলে দেয়া হয় মাশরাফির কাঁধে। ভিক্টোরিয়ান্সের আইকনই নন শুধু, দলটির সবচেয়ে বড় ভরসার নামই হলেন মাশরাফি। তার অধীনে বলার মতো বড় মাপের কোনো ক্রিকেটারই ছিল না গত আসরে, যার ওপর নির্ভর করে এগিয়ে যেতে পারে কুমিল্লা।
মাশরাফির হাতে ভরসা বলতে একঝাঁক প্রতিভাবান ক্রিকেটার আর তিনি নিজে। যে দলটিকে টুর্নামেন্টের শুরুতে গোনায় ধরতেও বেশ চিন্তা-ভাবনা করতে হয়েছে বোদ্ধাদের, সেই দলটিকে নিয়েই কিনা মাশরাফি তুলে ধরলেন বিপিএলের শিরোপা।
অথচ ওই আসরে ইনজুরিতে পড়েও দলের নেতৃত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। জাতীয় দলের সামনের ব্যস্ত সূচি থাকার পরও বিশ্রাম নেননি তিনি। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স মালিকপক্ষ মাঠে শুধু ‘নেতা’ মাশরাফিকে চেয়েছিল। বলেছিল, বোলিং-ফিল্ডিং-ব্যাটিং কিছুই করা লাগবে না। শুধু মাঠে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিলেই চলবে। তাতেই তাদের দলের সাফল্য এসে যাবে।
এসেছেও। তার হাতে থাকা দলটির প্রত্যেকটি ক্রিকেটারকে তিনি পরিণত করেছিলেন যেন শাণিত তরবারিতে। ভাঙাচোরা দলটি পরিণত হয়েছে দুর্দান্ত একটি দলে। যে ইমরুলকে টেস্ট স্পেশালিস্ট ছাড়া কিছুই ভাবা হতো না, সেই ইমরুলই কিনা মাশরাফির ছোঁয়ায় পরিণত হয়েছিলেন টি-টোয়োন্টি স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যানে। হারিয়ে যাওয়া অলক কাপালিকে দিয়েই বাজিমাত করেছিলেন ফাইনালে। মাশরাফির ছোঁয়ায় অলক কাপালিই হয়েছিলেন ফাইনালের নায়ক। ওই সময় মাশরাফি বের করে এনেছিলেন আরেক পেসার, আবু হায়দার রনিকে। গত বিপিএলে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বলতে ছিল শুধুই রনি।
বিপিএলের আগের দুই আসরে মাশরাফি ছিলেন ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সের অধিনায়ক। দু’বারই বিজয়ের মুকুট উঠেছে তার মাথায়। ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সকে বানিয়েছেন চ্যাম্পিয়ন। তবে, এবারের তুলনায় আগের দু’বার শক্তিশালী দলই ছিল তার হাতে। মাশরাফির সঙ্গী হিসেবে ছিলেন সাকিব আল হাসানও; কিন্তু কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স ছিল তার তুলনায় অনেক দুর্বল। তারওপর তিনি নিজে ছিলেন ইনজুরিপ্রবণ। খেলতে পারছিলেন না। শুধু নেতৃত্বগুণ দিয়ে দলকে জিতিয়েছেন বিপিএলের শিরোপা।
এবারও মাশরাফি কুমিল্লার অধিনায়ক এবং সবচেয়ে বড় তারকা। এবারও তার দলে খুব বেশি তারকার ছড়াছড়ি নেই। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন হলেও, তার দল নিয়ে খুব বেশি আলোচনা নেই। আবু হায়দার রনি নেই। তবে, ইমরুল কায়েস আছেন। পাকিস্তানি আসহার জাইদি, সোহেল তানভিরসহ একঝাঁক তারকা ক্রিকেটার।
সাদা-মাটা দল হোক আর শক্তিশালী দল হোক, মাশরাফি মানেই যে এখন বিপিএলের চূড়ান্ত সাফল্য- সেটা তো প্রমাণ হয়ে গেলো আরও একবার। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের অধিনায়ক হিসেবে তার মাথায় বিজয়ের মুকুট একবার উঠেছে। আরেকবার উঠুক বা না উঠুক, বিপিএল মানেই শুধুই মাশরাফি। বাক্যটি ভক্তরা আরও কঠিন করে খোদাই করে নেবে তাদের হৃদয় মন্দিরে।
জাগো চ্যাম্পিয়নের ১৪তম সংখ্যা পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে
আইএইচএস/বিএ