বাংলাদেশের হারের দুটি কারণ
কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে চতুর্থ দিন শেষেই পারফরমেন্সের জের টেনেছেন। তার দাবি, তারা একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও পরিকল্পনায় দল সাজিয়েছিলেন। পাশাপাশি কৌশল নির্ধারণ করেছিলেন। যার অনেকটাই সফল।
এটা ঠিক স্লো ও টার্নিং পিচে খেলা আয়োজন, একাদশে তিজন স্পেশালিষ্ট স্পিনার খেলানোর চিন্তা অনেকটাই সঠিক। সবাই একবাক্যে মানছেন, কন্ডিশন উপযোগি পারফরমেন্সের কারণেই টাইগাররা ইংলিশদের ভীত কাঁপিয়ে দিতে পেরেছিলেন।
তিন স্পিনার সাকিব আল হাসান, মেহেদী হাসান মিরাজ ও তাইজুল ইসলাম টিম ম্যানেজমেন্টের আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন। তাদের স্পিন জাদুতেই ইংলিশ ব্যাটসম্যানরা ঘায়েল। তিন স্পিনার সাকিব (৭), মিরাজ (৭) ও তাইজুল (৪) ১৮ উইকেটের পতন ঘটানোর কারণেই ইংলিশরা দুই ইনিংসে একবারও ৩০০‘র ঘরে পৌঁছাতে পারেনি। প্রথমবার ২৯৩ আর আর পরেরবার ২৪০‘এ অলআউট হয়েছে।
ব্যাটসম্যানরাও টার্নিং উইকেটে সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন। তামিম প্রথম ইনিংসে দারুণ দায়িত্ব নিয়ে খেলেছেন। দ্বিতীয়বার ইমরুল কায়েস, অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম ও অভিষেক হওয়া সাব্বির রহমানও রেখেছেন প্রতিশ্রতির ছাপ।
তাদের সন্মিলিত চেষ্টায়ই তৈরি হয়েছিল জয়ের সম্ভাবনা; কিন্তু তারপরও দুটি জায়গায় পার্থক্য স্পষ্ট। প্রথম জায়গা হলো দু’দলের লেট অর্ডার। ম্যাচের চাল-চিত্রটা একবার ভাল মত খেয়াল করলেই তা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
দুই ইনিংসেই ইংলিশ ব্যাটিংকে টেনে তুলেছেন মিডল ও লেট অর্ডাররা। প্রথম ইনিংসে ১০৬ রানে পাঁচ উইকেট খোয়া যায় তাদের। আর দ্বিতীয় বার ৬২ রানে শেষ হয় ইনিংসের প্রথম অর্ধেক। অথচ দু’বারই শুরুর ধাক্কা সামলে ওঠে অ্যালিস্টার কুকের দল।
প্রতিবারই সাত, আট ও নয় নম্বর ব্যাটসম্যান ঠিক জ্বলে উঠে শুরুর বিপর্যয় কাটিয়ে দিয়েছেন। প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ডের টপ স্কোরার ছিলেন মঈন আলি (৫৯)। আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫২ রান করেন সাত নম্বরে উইকেটে যাওয়া উইকেটকিপার বেয়ারস্টো।
একইভাবে দ্বিতীয় ইনিংসে চরম বিপর্যয়ে হাল ধরেন ছয় নম্বরে ক্রিজে যাওয়া বেন স্টোকস (৮৫)। আর তাকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন উইকেট রক্ষক বেয়ারস্টো (৪৭)। ঠিক এই জায়গায় চরম মার খেয়েছে বাংলাদেশ।
দ্বিতীয় ইনিংসে সাব্বির সাত নম্বরে নেমে হাল ধরলেও প্রথম বার সাত, আট ও নয়ে কেউ রান পাননি। আর সে কারণেই প্রথম ইনিংসে ২৬ রান তুলতেই হারিয়েছে শেষ ৬ উইকেট।
যদিও ওই বিপর্যয়ের জন্য সাকিবের বলগাহীন শট খেলতে যাওয়াকে বড় করে দেখা হচ্ছে; কিন্তু কঠিন সত্য হলো সাকিব তো ৩১ রান করার পর অফস্পিনে উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে মারতে গিয়ে আউট হয়েছেন; কিন্তু বাকিরা কি করলেন?
যেখানে ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংসে শেষ ৫ উইকেটে ১৮৭ রান যোগ করার পর দ্বিতীয়বার খাদের কিনারায় পড়ে গিয়েও পেয়েছে ১৭৮ রান, সেখানে বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসে ২৬ রানে পতন ঘটেছে ৬ উইকেটের। আর মুশফিকের দল দ্বিতীয়বার শেষ ৫ উইকেটে পেয়েছে ১২৩ রান। যার ৬৪ রানই সাব্বিরের।
এখানেই পরিষ্কার দু’দলের পার্থক্য। এর বাইরে আরও একটা জায়গা আছে। যেখানে বাংলাদেশ দারুণভাবে মার খেয়েছে। সেটা হলো পেস বোলিং। অনেকের প্রশ্ন, মানা গেল টার্নিং উইকেটে স্পিনাররা তাদের দায়িত্ব ঠিকমত পালন করে দলকে একটা ভাল জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন; কিন্তু পেসাররা কি করলেন?
অথচ দুই ইংলিশ ফাস্ট বোলার বেন স্টোকস এবং স্টুয়ার্ট ব্রড পুরনো বলে রিভার্স সুইং কওে টাইগারদের মিডল ও লেট অর্ডার ব্যাটিংয়ের লেজ মুড়িয়ে দিয়েছেন। তিন স্পিনার মঈন আলি, গ্যারেথ ব্যাটি ও আদিল রশিদ ১২ উইকেটের পতন ঘটালেও স্টোকস এবং ব্রডও পিছিয়ে ছিলেন না। তারা ভাইটাল ব্রেক থ্রু‘র পাশাপাশি ৬ উইকেট ভাগ করে নিয়েছেন।
অথচ সেখানে বাংলাদেশের দুই পেসর শফিউল (দুই ইনিংসে ১২-১-৪৩-০) ও কামরুল ইসলাম রাব্বি (১৬-০-৬৫-১) কিছুই করতে পারেননি। এ টেস্টের পোস্ট মর্টেম করলে পরিষ্কার বেরিয়ে আসবে পেসারদের ধার ও বৈচিত্রহীন নির্বিষ বোলিং। যা বাংলাদেশের পরাজয়ের অন্যতম কারণ।
যে পেসারদের হাত ধরে ইংলিশরা মুশফিক বাহিনীর মিডল ও লেট অর্ডারকে রীতিমত শাসন করেছেন, সেখানে বাংলাদেশের পেসাররা শাসন তো দুরের কথা, এতটুকু প্রভাবও ফলতে পারেননি।
একটি পরিসংখ্যানই বাংলাদেশের পেসারদের অকার্যকরিতার জ্বলন্ত প্রমাণ। প্রথম ইনিংসে এক পর্যায়ে ইংলিশরা ১০৬ রানে ৫ উইকেট খুইয়ে বসেছিল। যার সবকটাই মিরাজ ও সাকিবের; কিন্তু এরপর উইকেটকিপার বেয়ারস্টো (৫২), ক্রিস ওকস (৩৬) ও আদিল রশিদ (২৬) যথাক্রমে সাত, আট ও নয় নম্বরে নেমে বিপর্যয়ের মধ্য থেকেও ইনিংসকে টেনে নিলেন।
তাদের তিন জনের দৃঢ়তায় শেষ ৫ উইকেটে ইংলিশরা পেল ১৮৭ রান। একই ভাবে দ্বিতীয় ইনিংসে ৬২ রানে ইনিংসের অর্ধেকটা খুইয়েও শেষ পর্যন্ত বেন স্টোকস (৮৫), বেয়ারস্টোর (৪৭) দৃঢ়তায় ইংল্যান্ডের স্কোর দাঁড়াল ২৪০। তার মানে আবারও শেষ ৫ উইকেটে অ্যালিস্টার কুকের দল পেলো ১৭৮ রান।
দুই ইনিংসে ষষ্ঠ উইকেটে দুটি বড় জুটি হলো তৈরি। প্রথম ইনিংসে বেয়ারস্টো আর স্টোকস মিলে ৮৮ আর দ্বিতীয় বার স্টোকস ও বেয়ারস্টো জুটি জুড়ে দিলেন ১২৭ রান। শফিউল ও রাব্বির গড়া পেস ডিপার্টমেন্ট এই জুটি ভাঙ্গার কাজ করতে পারেননি। সেই না পারাই হয়েছে কাল।
যদিও খালি চোখে প্রথম ইনিংসে সাকিবের হঠাৎ ছক্কা মারতে গিয়ে উইকেট হারানো আর শেষ দিন তাইজুল ও শফিউলের কারো সহায়ক ভুমিকা নিতে না পারকেই দায়ী করা হচ্ছে; কিন্তু আসল সত্য মিডল ও লেট অর্ডারে বড় ইনিংস খেলতে না পারা এবং পেসারদের অকার্যকরিতার কারণেই ম্যাচ হেরেছে বাংলাদেশ।
এআরবি/আইএইচএস/এবিএস