এত কাছে তবু কত দূর!
স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা কত কষ্টের সেটা ক্রিকেটাররা ছাড়া আর কেউ বা সবচেয়ে বেশি বোঝে! বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের এই কষ্টের অনুভূতি একবার নয়, অনেকবার হয়েছে। চট্টগ্রাম টেস্ট আবারও সেই কষ্টের অনুভূতিটা বিঁধিয়ে দিলো ক্রিকেটারদের হৃদয়ে। যে অনুভূতি ছড়িয়ে গেছে পুরো বাংলাদেশে। লক্ষ-কোটি সমর্থকের মাঝেও।
চট্টগ্রাম জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের কিউরেটর জাহিদ রেজা বাবু। আজ (সোমবার) সকালে ফেসবুক পেজে একটা স্ট্যাটাস দিলেন। লিখলেন, ‘সারা দেশব্যাপী অনেক উত্তেজনা। জীবনে এই প্রথম অনুভব করছি। সকল ধর্মের আপামর জনতা কিছুক্ষণের জন্য হলেও বিধাতাকে ডাকছে এবং সাহায্য প্রার্থনা করছে।’
সত্যি কথাই লিখেছেন বাবু। সারা দেশের মানুষ যেভাবে প্রার্থনা করেছে, সেটা হয়তো নিজের জন্যও মানুষ এমনভাবে কখনও করে না। মাত্র ৩৩টি রান। চট্টগ্রামের এমন রহস্যময় উইকেটে এত কাছে এসে গেছে। স্বপ্ন সম্ভবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। এই ৩৩টি রান করলেই পাস!
সাব্বির রহমান আগের রাতে ঠিক ঘুমাতে পেরেছিলেন কি না সন্দেহ আছে। তাইজুলের ওপরই বা চাপটা পাহাড় সমান হয়ে বসেছিল কি না জানা নেই। তবে টিম ম্যানেজমেন্ট যে তাদের একেবারেই হালকা রাখার চেষ্টা করেছে তাতে সন্দেহ নেই। সবাই বলে আসছিল, আত্মবিশ্বাস রাখলেই চলবে। সকালে মাঠে নেমে তাইজুল-শফিউল শুধু সাব্বিরকে সঙ্গ দিলেই হয়ে যাবে।
কিন্তু ভাগ্য কেন এতবার বাংলাদেশের সঙ্গে এতটা হেয়ালি করে বোঝা বড় মুশকিল। বিতর্কিত আম্পায়ারিংই বা কেন এতটা হবে বাংলাদেশের বিপক্ষে! আম্পায়ার ডিসিশন রিভিউ সিস্টেমে (ইউডিআরএস, সংক্ষেপে ডিআরএস) প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়েছে। রিভিউ সিস্টেমে রিভিউ চালিয়ে একের পর এক নতুন আইন তৈরি করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম টেস্টে সেই সব আইনই প্রয়োগ হলো বাংলাদেশের বিপক্ষে! ২৭টি রিভিউর ঘটনা। যেন তেন ঘটনা নয়। টেস্ট ক্রিকেটে এক ম্যাচে এর আগে এত রিভিউর ঘটনা ঘটেনি। রিভিউ সিস্টেমটাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে দিলো চট্টগ্রাম টেস্ট। আর দুর্ভাগ্য হলো, অধিকাংশ রিভিউর ফলই গেছে বাংলাদেশের বিপক্ষে। নিরেট স্পোর্টস স্পিরিটের দিক থেকে দেখতে গেলে এটা স্বাভাবিক ঘটনাই; কিন্তু সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে এই ঘটনা কী অসাধারণ, প্রশ্ন সৃষ্টিকারী নয়?
জয়টা বাংলাদেশের এত কাছে! ১৪ মাস পর খেলতে নেমে ইংল্যান্ডের মত একটি পরাশক্তির বিপক্ষে এভাবে একেবারে জয়ের দ্বারপ্রান্তে চলে আসবে মুশফিক বাহিনী, তা কে ভাবতে পেরেছিল। খোদ কোচও পারেননি। যে কারণে টেস্ট শুরুর আগে তিনি বলেছিলেন, এ টেস্টে জয় পাওয়াটা হবে বোনাস। আবার বলেছিলেন, ২০ উইকেট নেয়ার মত বোলার বাংলাদেশের নেই।
কিন্তু মুশফিক বাহিনী দেখিয়ে দিয়েছিল, কীভাবে ২০ উইকেট নিতে হয়। এরপর ব্যাট হাতেও ব্যাটসম্যানরা নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছিলেন। যদিও প্রথম ইনিংসে তৃতীয় দিনের শুরুতে সাকিব আল হাসানের ওই শট, ওই ব্যাটিংটা আক্ষেপ হয়েই থাকবে ক্রিকেট সমর্থকদের হৃদয়ে। সবারই আক্ষেপ, ইস! সাকিব যদি শটটা না খেলতেন!
সেই আক্ষেপ দীর্ঘায়িত হলো চতুর্থ দিন বিকেলেও। সবারই এক কথা, প্রথম ইনিংসে শেষ মুহূর্তে যদি ওভাবে ভেঙে না পড়তো বাংলাদেশ, তাহলে নিশ্চিত চতুর্থ দিন বিকেলেই জয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারতো মুশফিকরা। দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘায়িত হয়ে রাত পেরিয়ে এলো পঞ্চম দিন সকালে। এখানে এসে আর ভাগ্যেরও সহায়তা পেলেন না তাইজুল-শফিউলরা।
ডিআরএসের বিতর্কিত ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশ এক ওভারেই হারিয়ে ফেললো শেষ দুই উইকেট। জয়ের থেকে মাত্র ২৩ রান দূরে তখন। ২২ রানে জয় ছিনিয়ে নিলো ইংল্যান্ড। এত কাছে এসে এভাবে হেরে যাওয়াটা অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন সাব্বির রহমান। ব্যাটে ভর দিয়ে বসে পড়লেন মাঠে। ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা দেখিয়েও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরতে হচ্ছে তাকে। এই দুঃখ কোথায় রাখবেন তিনি!
স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা এর আগেও অনেকবার হয়েছে। ২০০৩ সালে মুলতান টেস্টের সেই ক্ষত এখনও শুকায়নি ওই টেস্টে খেলা বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের হৃদয় থেকে। মাত্র এক উইকেটে হারা ওই টেস্টটিতে নিশ্চিত জিতে যাচ্ছিল বাংলাদেশ। রশিদ লতিফের জোচ্ছুরি আর ইনজামামের অসাধারণ ব্যাটিং বাংলাদেশের স্বপ্ন আর আশা কেড়ে নিয়েছিল সেদিন। ম্যাচ শেষে অঝোরে কেঁদেছিলেন তখনকার অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ সুজনসহ অনেক ক্রিকেটার।
২০০৬ সালে ফতুল্লা ট্র্যাজেডি ঘটেছিল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। শাহরিয়ার নাফিসের দুর্দান্ত সেঞ্চুরি, মাশরাফির বিধ্বংসী বোলিং- বাংলাদেশকে ঐতিহাসিক এক টেস্ট জয়ের স্বপ্ন দেখাচ্ছিল। কিন্তু রিকি পন্টিংয়ের দুর্দান্ত সেঞ্চুরি আর সেই অসম্ভবত স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে দিলো না। খুব কাছে গিয়েও হলো না অস্ট্রেলিয়ার মত পরাশক্তির বিপক্ষে বাংলাদেশের টেস্ট জয়।
২০০৮ সালে এই চট্টগ্রামেই নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে দিচ্ছিল প্রায় বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের ২৪৫ রানের বিপরীতে নিউজিল্যান্ড অলআউট ১৭১ রানে। ৭৪ রানের লিড। দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ করেছিল ২৪২ রান। চট্টগ্রামের এই রহস্যময় উইকেটেই কিউইদের ৩১৬ রানের বিশাল টার্গেট বেঁধে দিয়েছিল টাইগাররা। ২১৬ রানে ৫ উইকেট তুলেও নিয়েছিল তারা। কিন্তু ড্যানিয়েল ভেট্টোরি আর ড্যানিয়েল ফ্লিন বাংলাদেশের স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছিল সেদিন। শেষ মুহূর্তে এসে ৩ উইকেটে হারতে হলো।
স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছিল ২০১২ সালে এশিয়া কাপের ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে। মাত্র ২ রানের পরাজয়ে সেদিন সাকিব-মুশফিকদের সঙ্গে কেঁদেছিল পুরো দেশ। এত কাছে এসেও জয় ধরা দিল না বাংলাদেশের। গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে শেষ মুহূর্তে ১ রানের পরাজয়ের কষ্ট এখনও জ্বলজ্বল করছে ক্রিকেটপ্রেমীদের হৃদয়ে।
আশা ভঙ্গের বেদনা এবার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজেও। নিজেদের প্রথম ম্যাচে ইংল্যান্ডের ৩১০ রানের বিশাল লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে একসময় জয়ের দ্বারপ্রান্তেই চলে এসেছিল বাংলাদেশ; কিন্তু শেষ ১৭ রানে ৬ উইকেট হারানোর ফলে ২৩ রানের পরাজয়ের দুঃখ-বেদনায় পুড়তে হলো। এভাবেই একের পর এক তীরে এসে তরি ডুবিয়েছে মুশফিকরা। এত কাছে, তবু এত দূরে। এভাবে পরাজয়ের দুঃখ কবে ঘোচাতে পারবে বাংলাদেশ!
আইএইচএস/আরআইপি