সঙ্গীর অভাবে বিফলে গেল সাব্বিরের একার লড়াই
কি বলবেন, স্বপ্ন ভঙ্গ? তীরে এসে তরী ডোবা? সম্ভাবনার প্রদীপ হঠাৎ দপ করে নিভে যাওয়া? নাকি যা হবার ছিল, তাই ঘটেছে। প্রিয় জাতীয় দলের হার একেক জনের কাছে একেক রকম।
কেউ কেউ শুধু অংকের হিসেব কষে একটু বেশি আশাবাদী ছিলেন। কারো মুখে এমনও শুনেছি, ‘আর মাত্র তো ৩৩ রান। সাব্বির আছেন ক্রিজে। আগের দিন মঈন আলি, গ্যারেথ ব্যাটি, আদিল রশিদের স্পিন ঘূর্ণি ও স্টোকস-স্টুয়ার্ট ব্রডের পেস এবং রিভার্স সুইং সামলেছেন সাহসী বীরের মত। আজ শেষ দিন ঠিক জ্বলে উঠে দলকে জয়ের বন্দরে পৌছে দিবেন রাজশাহীর এ ২৪ বছরের যুবা।’
আবার কেউ কেউ বলেছেন, একদিন পুরো বাকি আর মোটে ৩৩ রান দরকার, তাতে কী! ইংলিশদের প্রয়োজন দুটি ভাল ডেলিভারি। তাহলেই তো সব সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটবে।
তারপরও সাব্বিরকে ঘিরেই ছিল সব আশা আকাঙ্খা। চতুর্থ দিন শেষ সেশনে দারুণ খেলা এ যুবা সোমবার সকালেও আস্থা ও আত্মবিশ্বাসের প্রতিমূর্তি। হিমালয় সমান দৃঢ়তার সঙ্গে একদিক আগলে রেখেছিলেন। দুই ইংলিশ পেসার স্টুয়ার্ট ব্রড আর বেন স্টোকসের বিরুদ্ধে একদম আস্থার সঙ্গে ব্যাটের মাঝখান দিয়েই খেলেছেন।
কিন্তু তার একার পক্ষে তো আর দল জেতানো সম্ভব ছিল না। ক্রিকেট খেলাটাই এমন। একজন একদিকে যতই ভাল খেলুন না কেন, তার ব্যাট যতই বিদ্যুতের মত চমকে উঠুক না কেন- অন্য প্রান্তে আরেক জন সঙ্গী ছাড়া জয়ের নাগাল পাওয়া যায় না।
হাতে উইকেটই ছিল মোটে দুটি। সঙ্গী ছিলেন তাইজুল ও শফিউল। সাব্বির একা নটআউট থাকলে কি হবে? দুই সঙ্গীর দু’জন আউট হয়ে গেলে তো আর জয়ের বন্দরে পৌছানো যাবে না। অন্তত একজনের সাপোর্ট তো প্রয়োজন। তাইজুল ও শফিউল কি সাপোর্ট দিতে পারবেন?
এমন প্রশ্নই আসলে ঘুরেফিরে উঠছিল সবার মনে। তবে যেহেতু তাইজুল ও শফিউল- দুজনারই আগে ম্যাচ জেতানোয় ভুমিকা নেবার রেকর্ড আছে, তা শঙ্কার মাত্রা কম ছিল। হোক তা দূর্বল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, অতীত রেকর্ড জানাচ্ছে, তাইজুল এর আগে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে টেস্ট জেতাতে সহায়ক ভুমিকা রেখেছিলেন।
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। ২০১৪ সালের অক্টোবরে শেরে বাংলায় জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে ১০১ রানের মামুলি টার্গেটের পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে ধুঁকছিল বাংলাদেশ। অষ্টম উইকেটে অধিনায়ক মুশফিক আর তাইজুল মিলে অবিচ্ছন্ন ১৯ রান তুলে দল জিতিয়েছিলেন।
আর শফিউল ২০১১ সালে এই জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে একইভাবে অষ্টম উইকেটে মাহমুদউল্লাহর সঙ্গী হয়ে দল জিতিয়েছিলেন। ২২৬ রানের জয়ের লক্ষ্যমাত্রা পিছু ধাওয়া করে ১৬২ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে প্রায় হারের রাস্তায় পৌঁছে গিয়েছিল টাইগাররা; কিন্তু শফিউল ২৪ বলে ২৪ রানের হার না মানা ইনিংস উপহার দিয়ে দলকে জয়ের বন্দরে পৌছে দেন।
তারা যে ম্যাচ জেতাতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারেন- ঐ ম্যাচই তার প্রমাণ। এ কারণেই আশা ছিল, আজ সকালে দু’জনার যে কেউ সাব্বিরকে সাপোর্ট দেবেন; কিন্তু জায়গামত তাইজুল-শফিউলের কেউই আগের মত ব্যাট হাতে জ্বলে উঠে সাব্বিরের পাশে দাঁড়াতে পারলেন না। তাই সময়ের দাবিও মেটানো সম্ভব হলো না।
সাব্বির ঠিক একপ্রান্তে নটআউট। তার দুই সঙ্গী তাইজুল-শফিউলও আউট। আগের দিনের অপরাজিত ব্যাটসম্যান তাইজুল আজ সকালে ১৯ মিনিট ক্রিজে থেকে ৫ রান যোগ করলেন। তাতে শেষ দিন জমা পড়ল আরও ১০ রান। আর শফিউল কিছুই করতে পারলেন না। দুই বল খেলে ফিরে গেলেন শূন্য হাতে।
দুজনই বিদায় নিলেন ইংলিশ ফাস্ট বোলার বেন স্টোকসের ভিতরে আসা ডেলিভারিতে লেগবিফোর উইকেটের ফাঁদে পড়ে। অন্যদিকে পাহাড় সমান দৃঢ়তায় একদিক আগলে রেখেও বিফল মনোরথ সাব্বির।
জীবনের প্রথম টেস্টে এই যুবা যে ব্যাটিং করেছেন, তাকে এক কথায় ‘ভাল’ বললে অনেক কম বলা হবে। উইকেটে এসে মঈন আলি- গ্যারেথ ব্যাটি আর আদিল রশিদের জাদুকরি স্পিন সামলেছেন অসামান্য দৃঢ়তায়। কোনরকম পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও আগের দিন পড়ন্ত বিকেলে স্টোকস আর স্টুয়ার্ট ব্রডের রিভার্স সুইং মোকাবিলা করেছেন বড় ব্যাটসম্যানের মত।
আজ শেষ দিন সকালেও ওই দুই ফাস্টবোলারের বোলিংয়ের বিরুদ্ধে ছিলেন সাবলীল। আস্থা ও আত্মবিশ্বাস নিয়েই খেলেছেন। একবারের জন্যও বিচলিত মনে হয়নি। বার বার মনে হয়েছে বিপরীত প্রান্তে একজন সঙ্গী পেলে সাব্বিরই হবেন জয়ের নায়ক। তার হাত ধরেই আসবে ঐতিহাসিক জয়।
কিন্তু হায়! শেষ পর্যন্ত সাব্বিরের নায়ক হওয়া হলো না। নিজের ব্যর্থতা কিংবা ভুলে নয়। সঙ্গীদের কারো কাছ থেকে সহায়তা না পেয়ে। তার ব্যাটিংটা হতে পারতো বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ম্যাচ জেতানো ইনিংস। সেটাই ফিকে হয়ে গেল সঙ্গীদের ব্যর্থতায়।
তাইজুল ও শফিউলের কাছ থেকে সহায়তার অভাবে এমন বীরোচিত ইনিংস গেল বিফলে। নায়ক হতে গিয়েও পারলেন না এ যুবা। উল্টো ট্র্যাজেডি কিং হয়েই থাকতে হলো। দল জিতাতে না পারার হতাশা অবশ্যই আছে। নিশ্চয়ই থাকবে আরো কিছু দিন; কিন্তু এই না পারার মাঝেও সাব্বির খুঁজে পেতে পারেন আলোর সন্ধান।
এই ভেবে মনকে প্রবোধ দিতে পারেন- ‘দল জেতেনি সত্য; কিন্তু আমি তো ঠিক ব্যাট হাতে জ্বলে উঠেছি। জীবনে প্রথম টেস্ট খেলতে নেমে শক্তিশালী ও ধারালো ইংলিশ বোলিংয়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছি। তার মানে আমি পারবো। আজ হয়নি তাতে কী, আগামীতে আমার হাত ধরেই জিতবে দেশ। আমি হবো জয়ের নায়ক।’
এআরবি/আইএইচএস/এমএস