ডিআরএস শতভাগ নিখুঁত ও নির্ভুল নয়!
খেলার ফল ও পরিণতি যাই হোক, বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ডের মধ্যে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে হওয়া চলতি টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচটি শুধু রিভিউ চাওয়া এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা প্রত্যাখ্যাত হবার জন্যই স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না রিভিউ আবেদন এবং এজন্য প্রযুক্তিগত সিস্টেম ব্যবহারে আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনায় এরই মধ্যে বিশ্ব রেকর্ড হয়েছে। আজ (চট্টগ্রাম টেস্টেও তৃতীয়দিন) চা বিরতি পর্যন্ত এ টেস্টে ১৬ বার আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা হয়েছে।
যা নতুন বিশ্ব রেকর্ড। অবশ্য বিশ্ব রেকর্ড হয়েছে প্রথম দিনই। ২০ অক্টোবরই এক টেস্টে সর্বাধিকবার রিভিউ নেওয়ার নতুন বিশ্ব রেকর্ড হয়েছে। এ ম্যাচের আগে এক টেস্টে সর্বাধিক আটবার রিভিউ নেওয়ার নজির ছিল।
কিন্তু ২০ অক্টোবর প্রথম দিনই ১০ বার রিভিউ নেয়া হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, আম্পায়ারের দেয়া কট বিহাইন্ড, লেগবিফোর উইকেট, রান আউট ও স্ট্যাম্পিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে দিনকে দিন বিতর্ক বেড়েই চলছে।
আম্পায়াররা কখনো ভুল করে আবার কোনো সময় আবেদনে প্রভাবিত হয়ে আঙ্গুল তুলে দিচ্ছেন; কিন্তু সে আবেদন সঠিক ছিল কি না, তা যাচাই করতেই আসলে রিভিউ সিস্টেম চালু।
আজকাল খেলা হয় প্রচুর। আউটের আবেদনের মাত্রাও বেড়েছে অনেক। বিশেষ করে লেগবিফোর উইকেট ও কট বিহাইন্ড নিয়ে প্রায়ই বিতর্ক দেখা দেয়। নানা কথা ও তীর্যক সমালোচনাও হচ্ছে।
মাঠে ২২ গজ দূরে দাঁড়িয়ে আম্পায়ার অল্প কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একটা সিদ্ধান্ত দেন, তা সঠিক কি না? তা নিয়ে কত শত প্রশ্ন জাগে দর্শক ও ভক্তদের মনে।
আচ্ছা আম্পায়ার যে অমুককে কট বিহাইন্ড দিলেন, বল কি সত্যিই ব্যাটে লেগেছিল? না কি লাগেনি? কিংবা ব্যাটে নয় প্যাড বা থাই প্যাডে লেগে কিপারের গ্লাভসে গেছে! পাশাপাশি লেগবিফোর উইকেট নিয়ে সংশয়-সন্দেহ সেই আদিকাল থেকেই। কেউ এলবিডব্লিউয়ের ফাঁদে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন ওঠে, ‘আচ্ছা বল প্যাডে লাগার আগে ব্যাটে লাগেনি তো? আরও কয়েকটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন ওঠে- ডেলিভারির পিচ আজ কি ঠিক ছিল? বল কোথায় পিচ করেছিল? লেগ স্টাম্পের বাইরে না তো?
বলার অপেক্ষা রাখে না, লেগ স্টাম্পের বাইরে পিচ পড়া ডেলিভারি যতই উইকেট সোজা আঘাত করুক ক্রিকেটীয় আইনে তা কখনই এলবিডব্লিউ হবে না। কাজেই পিচআপটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
অনেক সময় দেখা যায়, লেগস্টাম্পের বাইরে পিচ করা বল মিডল বা অফস্টাম্পে এসে প্যাডে লাগলো- আর আম্পায়ার আউট দিয়ে দিলেন। এসব বিষয় খুঁটিয়ে দেখার ইচ্ছে থেকেই আসলে রিভিউ প্রক্রিয়ার দ্বারস্থ হওয়া।
এছাড়া আরও একটি বিষয় নিশ্চিত হবার সুযোগ থাকে রিভিউ সিস্টেমে। তাহলো বল কি সত্যি সত্যিই উইকেটে আঘাত হানতো? না কি উইকেটের পাশ দিয়ে চলে যেত? কিংবা উচ্চতা বেশি ছিল কি না? থাকলে উইকেটের ওপরে বসানো বেলসের ওপর দিয়েও চলে যেত কি না?
মুলত এসব খুঁটিয়ে দেখার জন্য একটি সফটওয়্যার তৈরি করা হয়েছে। যাকে বল ট্র্যাকিং টেকনোলজিও বলা হয়। নামকরণ করা হয়েছে ‘আল্ট্রা এজ হকআই‘স এর ‘¯স্নিকোমিটার ভার্সন।’
বাংলাদেশ যে ঘরের মাঠে এবারই প্রথম রিভিউ সিস্টেম চালু করছে তা নয়। এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান ও জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধেও আম্পায়ারেরর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য রিভিউ সিস্টেমে খেলা হয়েছে।
তবে তখন হক-আই সফটওয়্যার ব্যবহৃত হয়নি। এবারই প্রথম। আর চট্টগ্রাম টেস্টে যেন এই প্রথম হকআই ব্যবহারের মহোৎসব। শুধু ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসেই ১০বার হক-আই ব্যবহৃত হয়েছে। সংখ্যায় অত না হলেও দ্বিতীয় দিন বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসেও হক-আই সফরওয়্যারের ব্যবহার হয়েছে কয়েকবার।
আজ তৃতীয় দিনও তাই। আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার এরকম প্রতিযোগিতা কে কবে দেখেছে? কেউ দেখেনি কখনো? কি করে দেখবে? এ ম্যাচেই যে সর্বাধিক রিভিউ চাওয়া হয়েছে!
প্রথম দিনই ১০ বার হক-আইয়ের প্রয়োগ ঘটানো হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষে সিদ্ধান্ত এসেছে মোটে দুবার। পরের দু’দিনে, মানে আজ চা বিরতি পর্যন্ত আরও ছয় বার আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত রিভিই হয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বেশিরভাগই স্বাগতিকদের বিপক্ষে। কাজেই চট্টগ্রাম টেস্ট হক-আই ব্যবহারে বিশ্ব রেকর্ডের টেস্ট হয়ে থাকবে, নিশ্চিত।
সে সঙ্গে স্বাগতিক বাংলাদেশের বঞ্চিত হবারও ম্যাচ এটা। পুরো খেলায় ১৬ বার রিভিউয়ের আবেদন হলেও ৭৫% ভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আশা পূর্ণ হয়নি। এ কারণেই বাংলাদেশ ভক্ত ও সমর্থকদের মধ্যে রাজ্যের হতাশা।
প্রথম ইনিংসে এক মঈন আলির বিরুদ্ধেই পাঁচবার রিভিউ হয়েছে। প্রতিবারই তিনি বেঁচে গেছেন। প্রথম ইনিংসে লঙ্কান আম্পায়ার কুমারা ধর্মসেনা একাই ইংল্যান্ডের মঈন আলিকে তিনবার আউট দিয়েছিলেন। আর দু’বার আবেদনে আম্পায়াররা সাড়া না দিলেও বাংলাদেশ রিভিউয়ের আবেদন করে। বলার অপেক্ষা রাখে না প্রতিবারই প্রত্যাখ্যাত হতে হয় স্বাগতিকদের।
সে কারনেই স্বাগতিকদের ক্রিকেট ভক্ত ও সমর্থকরা হতাশ। তবে এটাও ঠিক, যে প্রক্রিয়ায় (হক আই) আম্পায়ারের দ্ধিান্ত পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে সেটা পুরোপুরি মেশিনচালিত; মানে ‘কম্পিউটারাইজড। ’
এটি একটি কম্পিউটার সফটওয়্যার প্রোগ্রাম। যা বিশেষভাবে তৈরি। সেটাকে ইচ্ছেমত ব্যবহারের সুযোগ নেই। মূলতঃ এই কম্পিউটার সফটওয়্যার দিয়েই ওসব খুঁটিয়ে দেখা হয়। তবে যতই, কম্পিউটারাইজড হোক না কেন, আসল কথা হলো- এটা নিছকই একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম। এর ফল শতভাগ নিখুঁত আসার কথাও নয়।
বাংলাদেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও কুশলি ম্যাচ রেফারি রকিবুল হাসানও নিশ্চিত করতে পারেননি এই টেকনোলজি শতভাগ নিখুঁত কি না? আজ দুপুরে জাগো নিউজের সাথে আলাপকালে রকিবুল হাসান বলেন, হক-আই অবশ্যই অনেক আধুনিক ও কার্যকর প্রযুক্তি। তবে শতভাগ নিখুঁত নয়। তবে নিখুঁতের কাছাকাছি।’
তার দাবি এখন পর্যন্ত এ সিস্টেমের বিরুদ্ধে কোন বড় সড় অভিযোগ পাওয়া যায়নি। আর সবচেয়ে বড় কথা, এটাতে একটা প্রোগ্রামিং সেট করা থাকে। যা নির্দিষ্ট কিছু ইনপুট নেয় এবং সে অনুযায়ী আউটপুট দেয়। এখানে আসলে নড়াচড়ার কোনই সুযোগ নেই।’
প্রায় একই সুরে কথা বলেছেন বাংলাদেশের আম্পায়ার মাসুদুর রহমান মুকুলও। হক-আই রিভিউ সিস্টেম সম্পর্কে জাগো নিউজের সাথে আলাপে মুকুল বলেন, এ সিস্টেম কতটা পারফেক্ট? আমার তা জানা নাই। তবে আমি এটুকু বলতে পারি, এটা একটা কম্পিউটার সিস্টেম, যা দেখায়, বল কোথায় পিচ করেছে। সেখানে বল পড়ে কতটা টার্ন নিত। উইকেটেই থাকতো, না বেরিয়ে যেত- এসব বোঝা যায়। আবার আদৌ বল জায়গামত পিচ করেছে কি না সেটাও বোঝা যায়। তবে সে বোঝা যাবার মাত্রাটা শতভাগ নিখুঁত কি না, তা বলতে পারবো না।’
পুরো প্রক্রিয়াটি শতভাগ নিখুঁত ও নির্ভুল নয় বলেই ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড বিসিসিআই বেশিরভাগ সময় এই রিভিউ সিস্টেম এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। ভারতীয়দের ধারণা, আম্পায়ারদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার প্রক্রিয়ায় গলদ আছে। তাতে কখনও কখনও আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত নিয়ে ধূম্রজালও তৈরি হতে পারে। বলাই যায়, যেমনটা হয়েছে চট্টগ্রাম টেস্টে।
এআরবি/আইএইচএস/আরআইপি