তীরে এসেই তরি ডোবাল বাংলাদেশ
এমন অসাধারণ একটি ম্যাচ। নিশ্চিত জিতে যাচ্ছিল বাংলাদেশ। অথচ এমন ম্যাচেই কী না তীরে এসে তরি ডুবিয়ে ফেললো বাংলাদেশ। নিশ্চিত জয়ের ম্যাচটি হেরে গেলো ২১ রানের ব্যবধানে।
অথচ ইমরুল-সাকিবের ১১৮ রানের জুটির ওপর ভর করে বাংলাদেশ কত বল হাতে রেখে জিতে যাবে সে হিসেব কষতে শুরু করেছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকরা। অথচ হঠাৎ করেই দৃষ্যপট পাল্টে দিলেন জ্যাক বাল। পর পর দুই বলে ফিরিয়ে দিলেন সাকিব আল হাসান এবং মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতকে।
পুরো ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট ওই একটাই। ৫৫ বলে ৭৯ রান করা সাকিব জ্যাক বালকে পুল করতে চেয়েছিলেন। ব্যাটে-বলে ঠিকমত সংযোগ ঘটাতে পারেনি। মিডউইকেটে দাঁড়ানো ছিলেন ডেভিড উইলি। একপাশে হাত বাড়িয়ে ক্যাচটি তালুবন্দি করে ফেললেন তিনি। ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিলো ওই ক্যাচ।
এরপরও আশা ছিল। ইমরুলের সঙ্গে যদি মোসাদ্দেক সৈকত জুটি বাধতে পারেন; কিন্তু না, পারলেন না। পরের বলেই অফস্ট্যাম্পের বাইরে দিয়ে চলে যাচ্ছিল যে বল, সেটিকে টেনে স্ট্যাম্পে নিয়ে আসলেন সৈকত। হয়ে গেলন বোল্ড। পরপর দুই বলই ধ্বংস ডেকে আনে বাংলাদেশের।
মাশরাফি এসে হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনা ঠেকিয়ে দেন। তবে বেশিক্ষণ নয়। পরের ওভারেই ফিরে যান তিনি। ইমরুল কায়েস ছিলেন ভরসার প্রতীক হয়ে; কিন্তু পুরো ম্যাচে একপ্রান্তে হাল ধরে বাংলাদেশকে একেবারে তীরে এনে তরীটা ডুবিয়ে দিলেন যেন তিনি নিজের হাতেই। আদিল রশিদের একটি ওয়াইড বল খেলতে গিয়ে এগিয়ে এলেন। ব্যাটে লাগাতে পারলেন না। হয়ে গেলেন স্ট্যাম্পিং। তিনি তখন যদি দায়িত্বটা কাঁধে নিতেন, তাহলে তীরে এসে তরি ডুবতো না আর বাংলাদেশের। ১০৫ বলে সেঞ্চুরি করা ইমরুল ১১৯ বলে ফিরলেন ১১২ রান করে।
শেষ মুহূর্তে মোশাররফ রুবেলের সঙ্গী হন শফিউল ইসলাম। আশার আলো ছিল তখনও। কিন্তু শফিউল তো আর সব ম্যাচে ব্যাট হাতে জ্বলে উঠবেন না। তিনি ফিরে গেলেন কোন রান না করেই। এরপর তাসকিন আহমেদ আউট হলে শেষ হয়ে যায় বাংলাদেশের ইনিংস। ২৮৮ রানে অলআউট হয়ে বাংলাদেশ।
অথচ ইমরুল কায়েসের দুর্দান্ত সেঞ্চুরি এবং সাকিব আল হাসানের অসাধারণ হাফ সেঞ্চুরির ওপর ভর করে ঐতিহাসিক এক জয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশ। ইংল্যান্ডের ছুড়ে দেয়া ৩১০ রানের বিশাল লক্ষ্যকে সহজ বানিয়ে ফেলেছিলেন বাংলাদেশের এই দুই ব্যাটসম্যান।
৪২তম ওভারে ২৭১ রানের মাথায়ই ম্যাচের মোড় ঘুরে যায়। এ সময়ই আউট হন সাকিব আর মোসাদ্দেক। জ্যাক বাল এই দু’জনকে ফিরিয়ে দেয়ার পর নেন আরও ২ উইকেট। মূলতঃ অভিষিক্ত এই পেসারের হাতেই পতন ঘটে বাংলাদশের। ৫১ রান দিয়ে তিনি নেন ৫ উইকেট। সঙ্গে ছিলেন স্পিনার আদিল রশিদ। ৪৯ রান দিয়ে তিনি নিয়েছেন ৪ উইকেট।
৩১০ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে শুরু থেকে দুর্দান্ত ব্যাটিং উপহার দেন ইমরুল কায়েস। যার ফলশ্রুতিতে এলো তার ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় হাফ সেঞ্চুরি। পাশাপাশি অন্য ব্যাটসম্যানরা যখন ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছিলেন, তখন সাকিব আল হাসান এসে হাল ধরেন। ৩৯ বলে হাফ সেঞ্চুরি করার পর ইংলিশ বোলারদের সামনে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন তিনি। একের পর এক বলকে পাঠাচ্ছেন বাউন্ডারির বাইরে।
এর আগে সম্ভাবনা তৈরী করে একে একে ফিরে যান বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। প্রথমে তামিম ইকবাল। এরপর সাব্বির রহমান, মাহমুদউল্লাহ এবং সর্বশেষ আউট হয়ে গেলেন মুশফিকুর রহীমও। ১৭ রান করে তামিম, ১৮ রান করে সাব্বির এবং ২৫ রান করে ফিরলেন মাহমুদুল্লাহ, মুশফিক ফেরেন ১২ বলে ১২ রান করে। চারজনই ফিরলেন বিগ শট খেলতে গিয়ে। অথ্যাৎ এক কথায় উইকেট বিলিয়ে দিয়ে এলেন তারা।
যদিও তামিম আর ইমরুল শুরুটা করেছিলেন অসাধারণ। প্রথম বলে তামিম ইকবাল নিলেন ১ রান। স্ট্রাইকে আসলেন ইমরুল কায়েস। দ্বিতীয় বলে ক্রিস ওকসের ইনসুইংগার বলটি দেখে-শুনে খেললেন। রান নিলেন না। তৃতীয় বলেই বাউন্ডারির ওপর দিয়ে হাঁকিয়ে দিলেন বিশাল এক ছক্কা। বল মনে হচ্ছিল যেন হারিয়েই গিয়েছে। একটি বিজ্ঞাপনের ব্যানার ভেদ করে আটকে ছিল বলটি। এক দর্শক কুড়িয়ে অবশেষে ফেরত পাঠালেন বলটি।
সূচনাটা এভাবেই হয়েছিল বাংলাদেশের। সৌম্য সরকারের পরিবর্তে ওপেনিংয়ে যে ইমরুল কায়েসকে সুযোগ দেয়া হলো, তার দারুণ প্রতিদানও দিতে শুরু করলেন ইমরুল। অন্তত ইনিংসের শুরুতেই উইকেট হারিয়ে বসলো না বাংলাদেশ। তবে ১০ম ওভারে গিয়ে তামিমের উইকেট হারাতে হলো। অভিষিক্ত জ্যাক বালের বলটি খেলতে গিয়ে তুলে ফেলেন আকাশে। ক্যাচটা ধরেন জেমস ভিন্স।
৩১০ রানের বিশাল লক্ষ্য। এই লক্ষ্য তাড়া করতে গিয়ে যেমন রান তুলতে হবে, তেমন সতর্কও হতে হবে। সেটা মাথায় রেখেই উইকেটে সেট হওয়ার চেষ্টা করছিলেন তামিম ইকবাল এবং ইমরুল কায়েস। কিন্তু ভুলটা করে বসলেন তামিম। উইকেট বিলিয়ে দিলেন তিনি। আউট হওয়ার সময় তামিমের রান ৩১ বলে ১৭।
তামিম আউট হওয়ার মাঠে নামেন সাব্বির রহমান। দারুণ আত্মবিশ্বাসী ব্যাটিং উপহার দিচ্ছিলেন তিনি। ১১ বলে করে ফেলেন ১৮ রান। ১৪তম ওভারের শেষ বলে জ্যাক বালকে দারুণ এক শট খেলেন সাব্বির। বল উড়ে যাচ্ছিল ওভার বাউন্ডারির লক্ষ্যে। কিন্তু ঠিক বাউন্ডারিতে দাঁড়িয়ে অসাধারণ এক ক্যাচ ধরলেন ডেভিড উইলি।
বলটা প্রথমে তিনি লাফিয়ে উঠে তালুবন্দী করলেন। এরপর যখন দেখলেন বলসহ বাউন্ডারির বাইরে চলে যাচ্ছেন, তখন বলকে আকাশে তুলে নিজে বাউন্ডারির ওপাশে চলে যান উইলি। আবার দ্রুত ভেতরে ঢুকে সেই বল মাটিতে পড়ার আগেই তালুবন্দী করে নেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আউট হয়ে সম্ভাবনাময় একটি ইনিংসের অপমৃত্যু ঘটলো।
২৩তম ওভারের দ্বিতীয় বলে আদিল রশিদকে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে সুইপ খেলতে যান মাহমুদউল্লাহ। ডিপ মিডউইকেটে দাঁড়িয়েছিলেন বদলি ফিল্ডার স্যাম বিলিংস। তালুবন্দী করতে মোটেও কষ্ট হয়নি তার। ২৬ বলে ২৫ রান করে ফিরে যান তিনি।
এরপর ইমরুলের সঙ্গে জুটি বাধেন মুশফিকুর রহীম। ভালো খেলার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনিও। কিন্তু আদিল রশিদের স্পিনেই ঘায়েল হয়ে গেলেন তিনি। মোটামুটি সহজ বল ভেবে উঁচিয়ে খেলতে গিয়েছিলেন মুশফিক। ঠিক একই জায়গায় বলটি গিয়ে জমা পড়লো স্যাম বিলিংসের হাতে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
টস : ইংল্যান্ড (ব্যাটিং)
ইংল্যান্ড : ৩০৯/৮, ৫০ ওভার (বেন স্টোকস ১০১, বাটলার ৬৩, বেন ডাকেট ৬০, জেসন রয় ৪১, জেমস ভিন্স ১৬, ক্রিস ওকস ১৬, মঈন আলি ৬, জনি ব্যারেস্ট ০, ডেভিড উইলি ০*; মাশরাফি বিন মর্তুজা ২/৫২, শফিউল ২/৫৯, সাকিব ২/৫২)।
বাংলাদেশ : ২৮৮/১০, ৪৭.৫ ওভার (ইমরুল ১১২, সাকিব ৭৯, মাহমুদুল্লাহ ২৫; জ্যাক বাল ৫/৫১, আদিল রশিদ ৪/৪৯)।
ফল : ইংল্যান্ড ২১ রানে জয়ী।
ম্যাচ সেরা: জ্যাক বাল।
আইএইচএস/এএম