মেসিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ রোনালদোর
ইউরোর গ্রুপ পর্বেই আইসল্যান্ড, হাঙ্গেরি কিংবা অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে খেলতে নেমেছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, তখন তাকে বিদ্রূপের শিকার হতে হয়েছিল ‘মেসি মেসি’ বলে। সেই ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পর্তুগাল এখন ফাইনালে। আগামীকাল শিরোপার জন্য তিনি মুখোমুখি হবেন ফ্রান্সের।
আর মাত্র একটি ধাপ। এই ধাপটি পার হতে পারলেই কেল্লাফতে। লিওনেল মেসি নামক পৃথিবীর সেরা ফুটবলারটিকে হারিয়ে রোনালদো হয়ে যাবেন গ্রহের সেরা ফুটবলার। নিশ্চিতভাবেই নিজের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী লিওনেল মেসিকে হারানোর দারুণ একটি সুযোগ সিআর সেভেনের সামনে।
লিওনেল মেসির নাম শুনলে পর্তুগিজ সমর্থকরা প্রশ্নকর্তার সঙ্গে একটু ইয়ার্কি করতে বেশ পছন্দ করেন এখন। অপরিচিত কারও কাছ থেকে দুজনের তুলনা শুনে মিটিমিটি হেসে চকিতে পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘মেসি, কুইম?’
পর্তুগিজে ‘কুইম’-এর অর্থ হল ‘কে’? পর্তুগিজদের কাছে এখন আর মেসি-রোনালদোর কোনো তুলনা নেই। ‘তুলনাটা আসে কী করে’, ‘কোথায় রোনালদো আর কোথায় মেসি!’, ‘ভাই, তুমি পর্তুগিজকে জিজ্ঞেস করছ কে বড়?’- নানাবিধ ছোট-বড় খোঁচা। বিশ্বসেরা ফুটবলারের সিংহাসন নিয়ে আর্জেন্টাইন ফুটবলারের সঙ্গে সকাল-সন্ধ্যা যখন টানাটানি চলে, তখন নিজ দেশের এক নম্বর ফুটবল তারকাকে নিয়ে পর্তুগিজরা কোন বিতর্কে যেতে চাইবে না, সেটা স্বাভাবিকই।
তবে যাকে নিয়ে এত চিন্তা, আলোচনা- তার মনে কিন্তু বিতৃষ্ণার মেঘ জমে থাকা স্বাভাবিক। উপায়ও কী? পেলে-ম্যারাডোনা, ম্যাকেনরো-বর্গ, মোহাম্মদ আলি-জো ফ্রেজিয়ার, নাদাল-ফেদেরারের মতো খেলাধুলার কালজয়ী যুদ্ধ তালিকায় যে এটা ঢুকে গিয়েছে কবে!
সিআর সেভেন সমর্থকদের নিস্তারও নেই। ১২ বছর পর ইউরো ফাইনালে ওঠার অমৃতে তৃপ্ত চুমক দেবেন কী, আবার কোথা থেকে লিওনেল মেসি হাজির হয়ে যাচ্ছেন! ইউরোর ৮৫ মাইলের মধ্যে নেই, আর্জেন্টিনা লাতিন আমেরিকার দল; কিন্তু তারপরও আর্জেন্টাইনের ছায়া উপস্থিত হয়ে যাচ্ছে স্টেডে ডি ফ্রান্সে ইউরোর ফাইনালে। এখানে যেন ছায়া হয়েই রোনালদোর প্রতিপক্ষ হিসেবে হাজির হয়ে যাচ্ছেন লিওনেল মেসি।
লিওনেল মেসি আজ পর্যন্ত দেশের জার্সিতে চারটে বড় টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলেছেন। বিশ্বকাপ, কোপা আমেরিকা; কিন্তু একটাও পারেননি হাতে তুলে নিতে। ক্রিশ্চিয়ানোর এটা দুই নম্বর। ১২ বছর আগে ইউরোর ফাইনালে উঠেছিলেন। সেবার ফিগো-ডেকোদের সঙ্গে রোনালদো নতুন তারকা।
কিন্তু গ্রিসের বিরুদ্ধে ওই ম্যাচে রোনালদো সহজতম সুযোগ বারের উপর দিয়ে উড়িয়ে না দিলে কেউ তো আজ মেসির সঙ্গে তুলনায় যাওয়ার সাহসই পেত না। এক সময়ের পর্তুগিজ জলদস্যুদের মতোই তাই চরম প্রশ্নটা ইউরো-আকাশে হানা দিচ্ছে, এক যুগ পর কী হবে? রোববার পারবেন তো একত্রিশ বছরের রোনালদো? পারবেন, লিওকে ধুলিস্যাৎ করে সম্মানের মুকুট বরাবরের মতো ছিনিয়ে নিতে?
বিশ্ব ফুটবলের দুই মহাতারকার প্রেক্ষাপটটাই এখন এত বিপরীতধর্মী আর নাটকীয় যে, তুলনা আরও বেশি করে চলে আসছে। সিআর সেভেন ব্যর্থতার মৃত্যুগুহা থেকে এক রাতে বেরিয়ে সাফল্যের সূর্যোদয় দেখছেন। পর্তুগালের পত্রিকায় গোলের পর তার ট্রেডমার্ক সেলিব্রেশনের ছবি এদিন কভারপেজ জুড়ে নেওয়া হয়েছে। নীচে বড় একটা আর্টিকেল- রোনালদো দেশকে ফাইনালে তো তুললেনই, ইউরোয় মিশেল প্লাতিনির গোলের রেকর্ডও ছুঁলেন একই সঙ্গে।
রোনালদো রাতে মেসি কোথায়? না, কোপা হারের শোকতাপে অবসর- সিদ্ধান্তের পর আর এক অপমানের সম্মুখীন তিনি। রোনালদো-উচ্ছ্বাসের দিনেই আদালতের আদেশ বেরিয়েছে- মেসি কর ফাঁকি দিয়েছেন। শাস্তি একুশ মাসের জেল। স্পেনের নিয়মে কারাগারবাস এই আর্জেন্টাইনকে করতে হচ্ছে না; কিন্তু এরপর সম্মান আর অক্ষুণ্ণ থাকে কতটুকু?
দু’পক্ষের দীর্ঘ দিনের বৈরিতার উদাহরণও ইউরো ফাইনাল মঞ্চ বেয়ে উঠে আসছে। মেসি একবার বলেছিলেন, ‘রোনালদোর সঙ্গে তিনি লড়েন না। মিডিয়া লড়িয়ে দেয়। শুনে সিআর সেভেন বলেছিলেন, মেসিকে তিনি এক নম্বর বলেই ভাবতে পারেন না। নিজের বাইরে কাউকে সেরা হিসেবে দেখেনও না। লোকের রোনালদোকে তখন উন্নাসিক মনে হয়েছিল; কিন্তু সে দিনের উন্নাসিকতাই ধ্রুব সত্য হয়ে যাবে রোববারের ফাইনালটা রোনালদো জিতলে। যার আগাম হুঙ্কারও যথাযথ।’
পর্তুগাল কোচ ফার্নান্দো সান্তোস বলছেন, ‘কীভাবে জিতছি না জিতছি, আমার ভাবার সময় নেই। জিতছি, সেটাই আসল। দারুণ খেলে হার আমার কাছে যুক্তিহীন।’ পর্তুগিজ জনতাও বলছে। ১২ বছর আগের রাত যাদের মনে আছে। মনে আছে, কান্নার রোনালদো। নিজেদের নির্ঘুম রাত। কোথাকার কে এক ক্যারিস্তিয়াস এসে যে দিন সর্বস্ব লুট করে নিয়ে গিয়েছিলেন।
১২ বছর পর পর্তুগাল চায় একটা শান্তির ঘুম। চায় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে মেসিকে হারিয়ে মুকুটটা চলে যাক রোনালদোর মাথায়। এটুকু পারবেন না সিআর সেভেন? না পারলে তিনি আর কীসের সিআর!
আইএইচএস/এমএস