এই আর্জেন্টিনাকে রুখবে কে?
২০০৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা দলটার কথা একবার ভাবুন! কে ছিল না সেই দলে? তখনকার সময়ে মাঠ কাঁপানো আয়ালা, স্যাভিওলা, ক্রেসপো, রিকুয়েলমে, হেইঞ্জ, আইমার, মিলিতো, ক্যাম্বিয়াসো, সোরিনসহ আরো অনেকে; কিন্তু তারাও ব্যর্থ হয়েছিল আর্জেন্টিনাকে সামান্য একটি শিরোপা এনে দিতে। সময়ের পরিক্রমায় পেরিয়ে গেছে ১০টি বছর; কিন্তু আর্জেন্টিনা কি সেই তারকাখ্যাতি ফুটবলারের তকমা থেকে সরে আসতে পেরেছে? উত্তরটা অবশ্যই ‘না’।
বিশ্বকাপের মত মর্যাদার আসর না হলেও কোপা আমেরিকাও যে কম মর্যাদার নয়, সেটি ২০১৬ সালের শতবর্ষী কোপা আয়োজনের মধ্য দিয়েই সবাই বুঝে ফেলেছেন। কোপার এই ৪৫তম আসরের মধ্য দিয়েই ১০০ বছরে পা দিচ্ছে পৃথিবীর সব থেকে পুরনো এই টুর্নামেন্ট। ১৪ বারের কোপা চ্যাম্পিয়ন হয়েও ১৯৯৩ সালের পর নেই কোন শিরোপা।
২৩টি বছর শিরোপা খরায় থেকে থেকে ক্লান্ত আর্জেন্টিনার সমর্থকরা। তার ভেতর মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে গত দু’বছরের দুটি টুর্নামেন্টের ফাইনালে হার।
আবারও কোন বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের ফাইনালে আর্জেন্টিনা। এবারও কি স্বপ্ন ভঙ্গের কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হবে আর্জেন্টিনা সমর্থকদের? বর্তমান আর্জেন্টিনা দলটির দিকে তাকালে হয়তো বুকের কোণে একটু হলেও আশা রাখতে পারে মেসিদের ভক্তরা।
বর্তমান সময়ের পৃথিবীর অন্যতম সেরা দল হচ্ছে আর্জেন্টিনা। কোপার শতবর্ষী আসরে মার্কিন মুলুকের বুকে যে পারফরম্যান্সের কীর্তি রচনা করে যাচ্ছে মেসি-হিগুয়াইনরা, এখনও পর্যন্ত যেভাবে প্রতিপক্ষকে দুমড়ে-মুচড়ে এগিয়ে যাচ্ছে তারা, তাতে নিশ্চিত করেই বলা যায়, এই আর্জেন্টিনাকে কি আসলেই রুখে দেওয়ার মতো কেউ আছে? বিশেষ করে বললে, মেসিকে?
কী দুর্বার গতিতেই না ছুটছেন পাঁচবারের বর্ষসেরা ফুটবলার! মেসি সম্পর্কে রিয়ালের সাবেক আর্জেন্টাইন ফুটবলার জর্জ ভালদানো একবার বলেছিলেন, ‘ইনজুরড মেসি পৃথিবীর দ্বিতীয় সেরা ফুটবলার। আর প্রথম হলেন তিনি নিজে।’
সেই দ্বিতীয় সেরা মেসিকে আটকাতে এবারের কোপায় সর্বস্ব দিয়েও শেষ রক্ষা হচ্ছে না প্রতিপক্ষের। পানামার বিপক্ষে মাঠে নেমে মাত্র ১৯ মিনিটের এক ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে সব। হ্যাটট্রিকের মাধ্যমেই কোপায় নিজের প্রত্যাবর্তনের ম্যাচটিকে স্মরণীয় করে রাখেন মেসি।
চিলির বিপক্ষে ইনজুরিটা এমন ছিল যে, ‘দ্বিতীয় মেসি’ও মাঠে নামতে পারেনি। দ্বিতীয় ম্যাচে নেমেছিলেন পানামার বিপক্ষে। খেলেছিলেন ২৮ মিনিট, পরের ম্যাচে বলিভিয়ার বিপক্ষে ৪৫ মিনিট; কিন্তু কোন গোল পাননি। তাতে কী? আর্জেন্টিনা যে তার গোল পাওয়ার আগেই কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করে ফেলেছিল!
কোয়ার্টারেও ছিল মেসি শো; কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে উঠে এসেছিল গঞ্জালো হিগুয়াইনের জোড়া গোল। হিগুয়াইন নামটা শুনলেই আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মনের ভেতর এক রকম হাহাকার কাজ করে। ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে জার্মানির গোলরক্ষককে একা পেয়েও গোল করতে পারেননি তিনি।
পাপ মোচনের সুযোগ পেয়েছিলেন কোপার ফাইনালেও; কিন্তু সেখানেও চরমভাবে ব্যর্থ। পেনাল্টি শুটআউটে গোল করতে ব্যর্থ হন। আর্জেন্টিনা পরাজিত দুই ফাইনালেই। তাতে মূল ভিলেন কিন্তু হিগুয়াইন।
অথচ এবার তিনি এতটা ফর্মে যে, তার এমন বিধ্বংসী রূপ এর আগে কেউ দেখেনি। সেমিফাইনালেও সেটি ধরে রেখেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের হাউস্টন স্টেডিয়ামের ৭০ হাজার দর্শকের সামনে জোড়া গোল করে স্বাগতিক যুক্তরাষ্ট্রকে হারাতে মূল অবদান রাখেন হিগুয়াইন। তার কথা না হয় বাদই দিলাম।
বুড়ো বয়সেই কি ভেল্কি না দেখাচ্ছেন চাইনিজ লিগে খেলা এজেকুয়েল লাভেজ্জি। বলিভিয়ার সঙ্গে গোলের পর সেমিফাইনালের মত গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচেও আর্জেন্টিনা গোলের খাতা খোলে তার মাধ্যমে; কিন্তু সেমিফাইনালে হাতে ব্যথা পাওয়ায় ফাইনালে আর খেলতে পারবেন না তিনি।
লাভেজ্জি, মেসি, হিগুয়েনদের প্রশংসায় চাপা পড়ে যাচ্ছে ডি মারিয়া নামক এক আতঙ্কের নাম। কোপার প্রথম ম্যাচেই মুখোমুখি হতে হয়েছিল গতবারের চ্যাম্পিয়ন চিলির বিপক্ষে। দলে ছিলেন না মেসি। সেই আর্জেন্টিনাকে একাই টেনে নিয়ে এক গোলের পাশাপাশি অন্য গোলে সহায়তা করে দলকে ২-১ ব্যবধানে জয় এনে দেন এই পিএসজি তারকা; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পানামার বিপক্ষে ম্যাচের দিনই ইনজুরিতে পড়েন তিনি। তিনটি ম্যাচ খেলা হয়নি তার। তবে দ্রুতই সেরে উঠেছেন। ফাইনালে হয়তো দেখা যেতে পারে ডি মারিয়াকে।
এভার বানেগার কথাও বিশেষ করে বলতে হয়। মাঝমাঠের পুরো দায়িত্বটা যেন তার কাঁধেই। মাঝমাঠ থেকে বল জোগান দেওয়ার কাজটা ভালোভাবেই করছেন তিনি। টুর্নামেন্টে তার পা থেকে এসেছে একটি গোলও। সেটিই কি না আবার চিলির বিপক্ষে জয়সূচক গোল।
বার্সা তারকা হ্যাভিয়ের মাচেরানোর কথা না বললে অন্যায়ই হয়ে যাবে। জাতীয় দলে তিনি খেলেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে। নিজেদের হাফ থেকে বল বানিয়ে দেয়া কিংবা প্রতিপক্ষের আক্রমণ রুখে দেয়ার কাজ তো তিনিই করেন বেশি।
সব সময়েই আর্জেন্টিনার ডিফেন্স লাইন নিয়ে কথা উঠতো। আর্জেন্টিনার ডিফেন্স খারাপ- এটা যেন চিরাচরিত আর্জেন্টিনার জন্য; কিন্তু এবারের আর্জেন্টিনার ডিফেন্স ভাঙার ক্ষমতা আছে কার? টুর্নামেন্টে মাত্র দুই গোল খেয়েছে।
ডিফেন্ডাররা যেন নিজেদের উজাড় করে জানপ্রাণ দিয়েই খেলে যাচ্ছেন প্রতিটা ম্যাচ। আর্জেন্টিনার ডিফেন্ডারদের টুর্নামেন্টে এতটা ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলতে এর আগে কেউ দেখেনি। ওতামেন্ডি-ফিউনেস মুরি-রোহো-মার্কাদো এই চারজন মিলে আর্জেন্টিনাকে উপহার দিয়েছে চীনের প্রাচীর।
মূলতঃ চারজনের তিনজনই খেলে থাকেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের মত পেশী শক্তি প্রদর্শনের লিগে। সে কারণেই অন্যদের থেকে শক্তি কিংবা দক্ষতায় একটু হলেও এগিয়ে তারা। আর মার্কাদোতো প্রতিনিয়তই নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। ২৯ বছর বয়সী এই খেলোয়াড়ের খেলায় মুগ্ধ হয়ে তাকে কিনতে চাইছেন লিভারপুলের কোচ। অচিরেই হয়তো তাকেও দেখা যাবে অলরেডদের জার্সি গায়ে।
সব তারকার ভীড়ে সার্জিও রোমেরো সবসময়েই অবহেলিত থেকে যান। এবারও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রত্যেকটা ম্যাচেই অসাধারণ সব সেভ করে দলকে ম্যাচে, তথা টুর্নামেন্টে টিকিয়ে রেখছেন এই গোলরক্ষক। ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে বুদ্ধিদীপ্ত উপায়ে একটি পেনাল্টিও রুখে দেন তিনি।
সার্জিও আগুয়েরোর মতো তারকা সাইড বেঞ্চে বসে সময় কাটাচ্ছেন। এতো এতো তারকা ফুটবলারের ভিড়ে শুধু ট্রফিটাই নেই আর্জেন্টিনার। বিগত দশকের সবচেয়ে ভালো অবস্থায় থেকে কোপার ফাইনাল শুরু করবে আর্জেন্টিনা।
তাদের প্রতিপক্ষ গত কোপার ফাইনালে যাদের কাছে হেরে গিয়েছিল, সেই চিলি। গত কোপায় হারের প্রতিশোধ নেওয়ারও ভালো একটি সুযোগ। বিধ্বংসী যে আর্জেন্টিনাকে দেখা যাচ্ছে, ফর্মের বারুদে ঠাঁসা যে মেসিকে দেখা যাচ্ছে- সেই মেসি এবং সেই আর্জেন্টিনাকে এবার রুখতে পারবে তো ভার্গাস, সানচেজ এবং ভিদালদের চিলি?
জাগো চ্যাম্পিয়নের পঞ্চম সংখ্যা পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে
আইএইচএস/পিআর