মাথার পেছন ঢাকা হেলমেট ব্যবহারের পরামর্শ
হেলমেট ছাড়া ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে ফিল্ডিং করতে গিয়ে মাথায় বল লেগে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটার রমন লাম্বা। ১৯৯৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ঘটেছিল ওই মর্মান্তিক ঘটনা। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে আবাহনীর বাঁহাতি স্পিনার শফিউল্লাহ জেমের বোলিংয়ের বিরুদ্ধে ব্যাট করছিলেন তখনকার মোহামেডান টপ অর্ডার মেহরাব হোসেন অপি।
খাটো লেন্থের ডেলিভারিতে পিছনের পায়ে গিয়ে পুল খেলেন মোহোমেডান টপ অর্ডার অপি। ঠিক ওই বলের আগে নিজে যেচে হেলমেট ছাড়া ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে এসে দাঁড়িয়েছিলেন লাম্বা। অপির পুল শট গিয়ে লাগে সরাসরি লাম্বার কান ও চোখের মাঝামাঝি জায়গায়। সেখানে বল লেগে তিন চার ফুট উপরে উঠে গেলে তা প্লাভসে নেন আবাহনী উইকেটকিপার খালেদ মাসুদ পাইলট।
আর সবার মত লাম্বাও অপি আউট হওয়ার পর সহযোগিদের সঙ্গে উল্লাসে মেতে ওঠেন। অপি আউট হওয়ার পর নতুন ব্যাটসম্যান মাঠে নামতেই সব ফিল্ডাররা নিজ নিজ পজিশনে দাঁড়ান, ঠিক তখনই অস্বস্তি বোধ করেন লাম্বা। ড্রেসিং রুমে থাকা আবাহনীর ফিজিওকে মাঠে ডাকা হয়।
আবাহনীর তখনকার ফিজিও ডাক্তার জাওয়াদ মাঠে গিয়ে লাম্বাকে ড্রেসিং রুমে নিয়ে আসেন। তার হাত ধরে হেঁটেই মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে সাজ ঘরে ফেরেন লাম্বা। ড্রেসিংরুমে গিয়ে কিছু সময় পর বমি হয়। এরপর দ্রুত তাকে স্থানীয় এক ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়; কিন্তু ধীরে ধীরে অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকলে তাকে তখনকার পিজি (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
এক সময় বোঝা যায়, মস্তিষ্কে অতিমাত্রায় রক্তক্ষরণ হয়েছে। রক্ত জমাট বেধে যায়। শেষ পর্যন্ত শত চেষ্টার পরও তাকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি। তার আইরিশ স্ত্রী এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে করে ভারতে নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু তখন আর অপারেশন করার মত অবস্থা ছিল না। অত্যন্ত দুঃখজনক ভাবে পরলোকে পাড়ি জমান রমন লাম্বা।
দেড়যুগ পর শনিবার সকালে হোম অব ক্রিকেট শের-ই বাংলা স্টেডিয়ামে মাথায় বলের আঘাত লেগে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে হাসপাতালে যেতে বাধ্য হন সোহরাওয়ার্দি শুভ। এমন নয়, শুভ হেলমেট না পরে ক্রিজে এসেছিলেন। তার মাথায় ঠিকই হেলমেট ছিল।
কিন্তু দূর্ভাগ্য তাসকিনের বাউন্সার গিয়ে আঘাত হানে মাথার পিছনে, হেলমেটের পাশের নরম অংশে। বলার অপেক্ষা রাখে না, হেলমেটের ওই অংশটা ছিল ফাঁকা; কিন্তু আজকাল মাথার পিছনে ঢাকা হেলমেটও বেরিয়েছে। কোন কোন ব্যাটসম্যান তা পরে খেলেনও। তবে বেশীর ভাগই মাথার সামনে ও পিছন ঢাকা হেলমেট ব্যবহার করেন না।
শুভ সেই হেলমেট পরে থাকলে হয়ত বলের আঘাত টেরই পেতেন না; কিন্তু কে জানতো, তাসকিনের বল মাথার পেছনে গিয়েই লাগবে? তাসকিনের বাউন্সার থেকে নিজের মুখ ও মাথা নিরাপদে সরিয়ে নিতে বলের গতি প্রকৃতি বুঝে ঠিক নিচু হয়ে বল ছেড়েও দিতে চেয়েছিলেন; কিন্তু বল তার প্রত্যাশার চেয়ে নিচু হয়ে এসে কানের ওপর দিয়ে গিয়ে সোজা মাথার পিছনের নিচের অংশে আঘাত হানার কারণেই বিপত্তি ঘটে।
এ কারণে শুভ মাথায় বল লাগার মুহুর্ত থেকে শেরে বাংলায় সবার একটাই আফসোস, অনুশোচনা- ‘ইস যদি পিছন ঢাকা হেলমেট মাথায় থাকতো, তাহলে কোন কথাই ছিল না। সব ঝড়-ঝাপটা হেলেমেটের ওপর দিয়ে যেত। শুভর কিছুই হতো না।’
বলার অপেক্ষা রাখে না, সময়ের প্রবাহমানতায় এখন পেস ও ফাস্ট বোলিংয়ের বিপক্ষে হেলমেট পরা প্রায় রীতিতে দাঁড়িয়েছে। এক সময় ভিভ রিচার্ডস, গাভাস্কার, কার্ল হুপাররা হেলমেট না পরেই দিব্যি ফাস্ট বোলিং মোকাবিলা করেছেন; কিন্তু এখন আর সে অবস্থা নেই। ফাস্ট বোলিংয়ের বিরুদ্ধে তো বটেই, অনেকে স্পিন বোলিংয়ের সময়ও হেলমেট পরেই ব্যাটিংয়ে নামেন। তবে এখনো বেশিরভাগ ব্যাটসম্যানের পরনে থাকে মাথার পিছনের অংশ উন্মুক্ত হেলমেট।
তবে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার ফিলিপ হিউজেস মাথায় বল লেগে অকালে মারা যাবার পর হেলমেটের নির্মাণ শৈলিতে এসেছে পরিবর্তন। তারপর পুরো মুখ, চিবুক, কপাল, চোখ, কান, নাক মাথার সামনে ও পিছন পুরো ঢাকা হেলমেট তৈরী হয়েছে।
ওই হেলমেট বাধ্যতামুলক নয়, বিধায় বেশীর ভাগ ব্যাটসম্যান পিছন খোলা হেলমেটই ব্যবহার করেন। এখন প্রশ্ন হলো মাথার পিছন দিকেও বল লাগে। শুভর ক্ষেত্রে বল তার প্রত্যাশার চেয়ে নীচে থেকে পিছনে আঘাত হানে। আবার খাটো লেন্থের বা বাউন্সার থেকে ব্যাটসম্যান চোখ সরিয়ে নিলেও মাথার পিছনে গিয়ে বল আঘাত হানতে পারে।
তাহলে ব্যাটসম্যানদের নিরাপত্তার জন্য করনীয় কী? এ প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশের বেশিরভাগ ক্রিকেট বিশ্লেষকই মনে করেন পিছন ঢাকা হেলমেট পরিধানই হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ। এ বিষয় নিয়ে শনিবার রাতে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন জাতীয় দলের দুই সাবেক অধিনায়ক নাইমুর রহমান দুর্জয় এবং হাবিবুল বাশার সুমন ও বিসিবির প্রধান চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরী।
তিনজনই একমত, বাউন্সার কিংবা খাট লেন্থের এক্সপ্রেস ডেলিভারি থেকে মাথাকে নিরাপদ রাখতে পিছন ঢাকা হেলমেটের বিকল্প নেই। প্রথম টেস্ট অধিনায়ক নাইমুর রহমান দুর্জয় বলেন, আজকাল বাজারে পিছন ঢাকা নতুন এক ধরনের হেলমেট এসেছে। যা অনেক নিরাপদ। মুখ, মাথার সামনে ও পিছনের অংশ ঢাকা এ হেলমেট যদিও এখনো পরিধান করা বাধ্যতামুলক নয়। তবে আমার মনে হয় সবারই ওই নিরাপদ হেলমেট পরে ব্যাটিংয়ে নামা উচিত।
২০০৭ সালের বিশ্বকাপে অধিনায়কত্ব করা হাবিবুল বাশার সুমনের কথা, ‘পেসার ও ফাস্ট বোলাররা বাউন্সার ছোড়ে। ছুড়ছে। ছুড়বেও। তাই বলে, তা থেকে প্রতিদিন আর দুর্ঘটনা ঘটে না। ঘটবেও না। তবে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এজন্য সর্বাধুনিক ও সবচেয়ে নিরাপদ হেলমেট পরাই হচ্ছে সেরা সতর্কতা। কোন কোন দেশ বাউন্সার থেকে মাথা নিরাপদ রাখতে পিছন ঢাকা হেলমেট বাধ্যতামুলক করার কথা ভাবছে।’
বলে রাখা ভাল ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া বেশ জোরে-সোরে ওই পিছন ঢাকা হেলমেট পরা বাধ্যতামুলক করার চিন্তায় আছে। নাইমুর ও বাশারের কথা শুনে মনে হলো তারাও বাংলাদেশে ওই ধরনের সর্বোচ্চ সতর্কতামুলক হেলমেট পরা বাধ্যতামুলক করার পক্ষে।
ডাক্তার দেবাশীষ চৌধুরীও একই সুরেই কথা বলেছেন। তার কথা, বাউন্সার তা থেকে নিজেকে এবং মাথা মুখ ও চিবুক নিরাপদে রাখতে আছে হেলমেট। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মাথাকে পুরোপুরি নিরাপদ রাখতে পিছন ঢাকা হেলমেট ব্যবহারের পক্ষে। বাংলাদেশে মুশফিকুর রহীম ও সাকিব আল হাসান তা ব্যবহার করেন। আমার মত ও পরামর্শ- হেলমেট পরলে সবচেয়ে নিরাপদটাই ব্যবহার করা উচিৎ। পিছনের অংশ ঢাকা হেলমেট পরলে আজ সোহওরাওয়ার্দি শুভকে এভাবে আঘাত পেয়ে হাসপাতালে যেতে হতো না।’
ডাক্তার দেবাশীষের আরও একটা উপলব্ধি আছে। তার পরামর্শ, এছাড়া আমার আরও একটা কথা মনে হয়, ত্রিশোর্ধ্ব ক্রিকেটারদের চোখ পরীক্ষা করা উচিৎ। সেটা বোর্ড ও করতে পারে। আমার মনে হয়, ক্রিকেটারদের নিজ উদ্যোগেই তা করে নেয়া ভাল। সেটাও দ্রুত গতির ডেলিভারি থেকে মাথা নিরাপদ রাখার একটা কার্যকর পন্থা হতে পারে।’
এআরবি/আইএইচএস/এবিএস