এই ব্রাজিল অচেনা
পেরুর বিপক্ষে অন্যায়ের শিকার হয়েছে ব্রাজিল। এটা এখন স্বতসিদ্ধ কথা। কেউ কেউ লিখেছেন- রুইডিয়াজ হয়ে ফিরেছেন ম্যারাডোনা। ‘হ্যান্ড অব গড’-এর প্রবক্তা শুধুমাত্র আর্জেন্টাইন কিংবদন্তিই নন, এখন এ ভুবনের বাসিন্দা বেড়েছে। রাউল রুইডিয়াজ নতুন সংযোজন।
উরুগুইয়ান রেফারি আন্দ্রেস চুনহার অমার্জনীয় ভুলের কারণে পেরুর কাছে রুইডিয়াজের ওই ‘হ্যান্ড অব গডে’র গোলের কারণে একমাত্র ব্যবধানে (১-০) হেরে কোপার শতবর্ষীয় টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিলো পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। ব্রাজিলিয়ানদের কাছে এই হার কিংবা বিদায়ের জন্য একমাত্র ভিলেনই যেন রেফারি চুনহা। তিনি গোলটি অ্যালাউ না করলে ম্যাচটি অন্তত ড্র করতে পারতো ব্রাজিল। তাহলে বিদায় নিতে হতো না, ‘জোগো বোনিতো’দের।
অবশ্য ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন এই ‘অজুহাত’ মানতে রাজি নয়। তারা বরখাস্তই করে ছেড়েছে কোচ কার্লোস দুঙ্গাকে। বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ, ভুলে যান রুইডিয়াজের হাত দিয়ে গোল করা কিংবা রেফারি আন্দ্রেস চুনহার অমার্জনীয় ভুলের কথা। আগে ভেবে দেখুন, ব্রাজিল কী করতে পেরেছিল! পেরুর গোলপোস্টের জাল কেন একবার হলেও তারা খুঁজে পেলো না? ব্রাজিলের সেই খেলা কোথায়? এই দলের ফুটবলারদের মধ্যে ক’জন পরিচিত?
অতি পাঁড় ভক্তও চোখ বন্ধ করে এই ব্রাজিলের পাঁচজন ফুটবলারের নাম বলতে পারবে না। কার্লোস দুঙ্গা এ কোন ব্রাজিল ফুটবল দল তৈরি করে যাচ্ছিলেন! ২০১৪ বিশ্বকাপে জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে হারের পর জাদুকরি কোচখ্যাত লুই ফেলিপে স্কলারিকে বিদায় করে দুঙ্গাকে ফিরিয়ে আনা হয় দ্বিতীয় মেয়াদে। এরপর তিনি পেলেন দুটি কোপা আমেরিকা। গত বছর কোপা আমেরিকার কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায়। এবার বিদায় গ্রুপ পর্ব থেকে। সাদা চোখেই দৃশ্যমান ব্রাজিল ফুটবলের উন্নতি কতটা। সুতরাং এই ব্রাজিল যে সত্যিই অচেনা, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
শিল্প, সৌন্দর্য, মোহিত, সুন্দর, দৃষ্টিনন্দন, ছন্দ, স্কিল, পাওয়ার, প্রতিভা- এই সব ক’টা শব্দ এক সময় একটা শব্দেই মিশে যেত, ব্রাজিল। পর্তুগিজ (ব্রাজিলেরও মাতৃভাষা) ভাষায় যার রূপ ‘জোগো বোনিতো’। এবারের শতবার্ষিকী কোপা আমেরিকা থেকে ‘লজ্জার’ বিদায়ের পরও কি বলা যাবে? আর কি সেগুলো মিশবে? ব্রাজিলের অন্ধভক্তদেরও দ্বীধাদ্বন্দ্বের দোলায় দুলতে হচ্ছে এ নিয়ে।
সাধারণত যে ব্রাজিলকে দেখতে আমরা অভ্যস্ত, যখন ব্রাজিল ‘ব্রাজিল’ ছিল, তখন প্রত্যেক বিশ্বকাপেই দলটিতে দেখা যেতো তাদের একটি সেট- প্রথম একাদশ তো থাকতোই। তার পাশাপাশি রিজার্ভ বেঞ্চে কিছু নতুন মুখ থাকত, যারা মাঠে নামার সুযোগ পেলেই ঝলক দেখাত। বেঞ্চের ফুটবলারদের খেলা দেখেও ফুটবলপ্রেমীদের চোখ ঝলসে যেতো। এখন সেই ব্রাজিল আর নেই। কেন নেই?
মূলত ব্রাজিল সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যগতভাবেই একটি সমৃদ্ধ দেশ। অথচ অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংকট দেশটিকে দুর্বল করে দিয়েছে। বেকারত্বের হার ২০ ভাগেরও বেশি। দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে বিশাল একটা জনগোষ্ঠী। তার ওপর দুর্নীতির কালোজাল বিস্তার ঘটেছে দেশটির রন্দ্রে রন্দ্রে। ফিফায় দুর্নীতিবিরোধী যে অভিযান শুরু হয়েছে, তাতে গ্রেফতার হয়েছেন ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি।
এখানেই বোঝা যাচ্ছে, ফুটবল ঐতিহ্যের দেশটিতে দুর্নীতি কতটা প্রকট। এ পরিস্থিতির প্রতিফলন ব্রাজিল ফুটবলে। তারই প্রতিদান দিতে হচ্ছে বর্তমান দলটিকে। একই সঙ্গে চরম আর্থিক দৈন্যদশার প্রভাবও পড়ছে দেশটির ফুটবলে।
দেশটিতে ইয়থ ডেভেলপমেন্ট ঠিকমতো হচ্ছে না। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের যে মজা, সারা পৃথিবীকে মাতিয়ে রাখত যে ফুটবল, সঙ্গে ইউরোপের ফুটবলের পাওয়ার আর গতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারত, সেই ছন্দময় ফুটবল যেন ব্রাজিল ছেড়ে দিল! ছেড়ে দিল তার কারণ হচ্ছে, সেই ছন্দের ফুটবল, সেই সৌন্দর্যের ফুটবল ব্রাজিলের নতুন প্রজন্ম উপহার দিতে ব্যর্থ। এর কারণও আছে। কোনও উঠতি ফুটবলারের মধ্যে সামান্য প্রতিভার উন্মেষ লক্ষ্য করা গেলে, সঙ্গে সঙ্গে তাকেই ইউরোপ থেকে কোনও না কোনও দল তুলে নিয়ে আসতে শুরু করলো।
এখন ব্রাজিলের যে দলটি দেখা যাচ্ছে, সেখানে প্রথম একাদশ কেন, ১৮ জনের দলে তারা প্রত্যেকেই হয়ত ইউরোপের কোনও না কোনও ক্লাবে খেলছে। হয় জার্মানি কিংবা ইংল্যান্ড, প্রথম সারির ফুটবলার হলে স্পেন, কেউ ইতালিতে খেলছে। ফলে ব্রাজিলের ফুটবল কৌশল তাদের পক্ষে আর রপ্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। যে ফুটবল খেলে ব্রাজিল বিশ্ব মাতিয়ে দিত, সেটা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে।
কোপার বিপর্যয়ের পর দুঙ্গা বরখাস্ত হলেন। নতুন কোচ নিয়োগ দেয়া হলো করিন্থিয়াসের টিটেকে। রোনালদো, রিভালদো থেকে ব্রাজিলিয়ান গ্রেটরা অভিনন্দন জানিয়েছেন টিটেকে। এবার দেখার বিষয়, টিটে পারেন কি না জোগো বোনিতো ফেরাতে!
জাগো চ্যাম্পিয়নের চতুর্থ সংখ্যা পুরোটা পড়তে ক্লিক করুণ এই লিংকে...
আইএইচএস/পিআর