ভিডিও EN
  1. Home/
  2. খেলাধুলা

ম্যারাডোনাকে ছাড়া আমাদের প্রথম বিশ্বকাপ

স্পোর্টস ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৩:৪৯ পিএম, ১৯ নভেম্বর ২০২২
  • নুরুল করিম

আমার দেখা বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ- ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের আর্জেন্টিনা এবং গ্রিস ম্যাচটি। ম্যাচটি দেখেছি যতটা না আর্জেন্টিনাকে ভালোবেসে, তার চাইতে হাজারগুণ বেশি ম্যারাডোনাকে ভালোবেসে।

তখন সারা বিশ্বের মতো আমাদের গ্রামও ছিল ম্যারাডোনা ম্যানিয়ায় আক্রান্ত। হাইস্কুলের ১৪ ইঞ্চি ভাঙাচোরা সাদাকালো টিভিতে ওই ম্যাচে ম্যারাডোনাকে দেখার জন্য কয়েকশ মানুষ জমায়েত হয়েছিলাম। ফুটবলের কিছুই বুজতাম না, শুধু ম্যারাডোনাকে দেখলেই চিৎকার দিতাম।

ওই ম্যাচে আর্জেন্টিনা ৪-০ গোলে জিতেছিল। ম্যারাডোনা করেছিলেন ১ গোল এবং বাতিগোল (বাতিস্তুতা) করেছিলেন হ্যাটট্রিক। প্রসঙ্গত বাতিস্তুতার ওটা ছিল প্রথম বিশ্বকাপ। বাতিস্তুতা-ম্যারাডোনার দুর্দান্ত এক জুটি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার চান্স ছিল।

এখানে উল্লেখ্য, আর্জেন্টিনা ১৯৯৪ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের প্লে-অফ খেলে এসেছিল অস্ট্রেলিয়ার সাথে। ম্যারাডোনাহীন আর্জেন্টিনা সরাসরি কোয়ালিফাই করতে পারেনি। ফিরিয়ে আনা হলো ম্যারাডোনাকে, প্লে-অফে অস্ট্রেলিয়ার সাথে বাতিস্তুতা যে গোল দিয়েছিল তার ফাইনাল পাস ছিল সর্বকালের সেরা নাম্বার-১০ এর।

এরপরের ম্যাচ ছিল নাইজেরিয়ার সঙ্গে। ওই ম্যাচে ম্যারাডোনা কোনো গোল না করলেও প্লে-মেকার রোলে ফিজিক্যাল নাইজেরিয়ার সাথে ঝলসে ওঠে। ২-১ গোলে জিতে যায় আর্জেন্টিনা। দুটি গোলই করেন ৯০-এর হিরো ক্যানিজিয়া। ফ্রন্টে বাতিস্তুতা, ক্যানিজিয়া পেছনে। ম্যারাডোনা সর্বকালের সেরা প্লে-মেকার। এর চেয়ে ভয়াবহ অ্যাটাকিং লাইনআপ ’৯৪ বিশ্বকাপে কারও ছিল কি না সন্দেহ আছে।

Maradona

ওই ম্যাচের পর থেকেই ‘ফুটবল সম্রাট’ আমার মনোজগৎ দখল করে নেয়। পরের ম্যাচ ছিল বুলগেরিয়ার বিপক্ষে। খেলা ছিল রাতে। ফলে রাতে স্কুলে খেলা দেখানো বন্ধ। আমরাও দেখা হয়নি। সকালে গেলাম হাইলাইটস দেখতে, গিয়ে শুনলাম আর্জেন্টিনা হেরে গেছে আর ম্যারাডোনা বহিষ্কার।

সিনিয়ন ভাইদের কান্না দেখে ওইদিন ম্যারাডোনার জন্য আমিও কান্না করেছিলাম। এরপর থেকেই ম্যারাডোনা হয়ে ওঠে আমার স্বপ্নের নায়ক। তখন থেকে ম্যারাডোনাকে নিয়ে যত লেখা পেতাম, পড়তাম। পাক্ষিক ক্রীড়ালোক (ক্রীড়া বিষয়ক ম্যাগাজিন) কিনে পড়তাম ম্যারাডোনাকে নিয়ে যত লেখা হতো, তার সবগুলো। যত পড়তাম ততই মুগ্ধ হতাম।

একটা মানুষ কীভাবে সারা পৃথিবীর ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়ে স্থান করে নেয়- ভেবে অবাক হতাম। ম্যারাডোনা ছিল মহানায়ক। পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ এবং জনপ্রিয় ক্রীড়াবিদ।

Maradona

গল্প শুনেছি ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার বীরত্বগাথা নিয়ে। একক প্রচেষ্টায় বিশ্বকাপ জয়, ম্যারাডোনা ছাড়া ওই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের আর একজনের নাম বলতে পারবেন? অবশ্যই না।

ফুটবল একটা দলগত খেলা; কিন্তু ’৮৬’র বিশ্বকাপে শুধু আর্জেন্টিনা নয়, বাকি দলগুলো ছাপিয়ে একটাই রব উঠেছে ‘ম্যারাডোনা’। সাদা পেলে জিকো, তিনবার ব্যালন ডি’অর জয়ী প্লাতিনিকে টেক্কা দিয়ে একেবারে অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে গোল্ডেন বল জয় করা, ভাবা যায়!

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের কথা বাদই দিলাম। সেমিফাইনালে বেলজিয়ামের বিপক্ষে ২ গোল যেন বড় আসরের সলো গোলের বেস্ট উদাহরণ হয়ে থাকবে। বেলজিয়ামের বর্তমান অধিনায়ক কয়েক দিন আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বেলজিয়াম আর্জেন্টিনার কাছে হারেনি, হেরেছিল ম্যারাডোনার কাছে।’

এমনকি ইংল্যান্ডের সাথে প্রথম গোলের (হাত দিয়ে করা গোল) আগে ডি-বক্সের সামনে ম্যারাডোনার মুভমেন্ট ছিল যেন আমাদের দেশের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিনের তুলির আঁচড়। তার দ্বিতীয় গোলকে কোনো লেখক কখনো তাদের ভাষা দিয়ে তুলে ধরতে পারবেন কি না সন্দেহ।

Maradona

ওপার থেকে যেন ভ্যানগগ-পিকাসোরা সেদিন ম্যারাডোনার বাম পায়ে ভর করেছিল। ফাইনালের সেই লাস্ট মোমেন্টে জাদুকরী পাসের কথা না বললে অবিচার হয়ে যায়। এতগুলো খেলোয়াড়ের মধ্যে খেলার শেষ দিকে একটা টাচে বল বের করে দেওয়া আধুনিককালের ডিপ-লায়িং প্লে-মেকার, রিয়্যাল প্লে-মেকার এবং ফলস নাইন- সবার স্বপ্ন।

১৯৯০ বিশ্বকাপের ফাইনাল তো তাকে ফুটবল বিশ্বে চির অমরত্ব এনে দিয়েছিল। কাপ হাতে ম্যাথিউসের উল্লাসের ছবির থেকে ম্যারাডোনার কান্নার ছবি বেশি প্রচারিত হয়েছিল সেবার। ওই ম্যাচের পর নাকি বাংলাদেশে রেফারির কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছিল। ঝাড়ু মিছিলও বের করা হয়েছিল।

মাঠের ম্যারাডোনা ছিল নিবেদিত প্রাণ, সত্যিকারের নেতা। ১৯৯০ বিশ্বকাপের ফাইনালে যখন আর্জেন্টিনার দুজন খেলোয়াড়কে লাল কার্ড দেখায় এবং গোল বাতিল করে দেওয়া হয়- তখন সতীর্থরা খেলা চালিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু ম্যারাডোনা খেলা চালিয়ে যান, সত্যিকারের স্পোটর্সম্যানশিপ মানসিকতা নিয়ে।

Maradona

ইন্টারনেট আসার পর ম্যারাডোনাকে নিয়ে শত শত লেখা পড়েছি, আর অবাক হয়েছি- তার সম্পর্কে যত জেনেছি। ম্যারাডোনা আমার কাছে পৃথিবীর সেরা, জনপ্রিয় খেলোয়াড়। পৃথিবীর সেরা সেলিব্রিটি।

মেসি নাকি ম্যারাডোনা? অবশ্যই ম্যারাডোনা। ম্যারাডোনা যদি হয় প্রশান্ত মহাসাগর, তবে মেসি তার সামনে সর্বোচ্চ বঙ্গোপসাগর। জাতীয় দলের মতো ক্লাব ফুটবলেও ম্যারাডোনা অবিসংবাদিতভাবেই সর্বকালের সেরা।

একটু উদারহণ দেই, ধরেন ইতালীয় ক্লাব সাম্পদোরিয়া যদি এখন সিরি আ, কোপা ইতালিয়া এবং চ্যাম্পিয়নলিগ জিতে যায়, তাহলে অবশ্যই অবাক হয়ে যাবেন! অথচ এমনটাই সম্ভব করেছিলেন ম্যারাডোনা। ন্যাপোলির মতো এক অখ্যাত এক দলকে করেছিলেন ইতালি এবং ইউরোপের সেরা।

আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ নায়ক, সেলিব্রিটি এই ম্যারাডোনা। পৃথিবীর ফুটবলপ্রেমীদের কাছে যেমন কিংবদন্তি, তেমনি ন্যাপোলিবাসীদের কাছেও তিনি পুজনীয়তুল্য।

Maradona

ন্যাপোলিয়ানরা ভাবে, হাজার বছর পরে ন্যাপোলির মাটি খুঁড়লে প্রত্মতাত্ত্বিকরা এত এত ম্যারাডোনার মূর্তি পাবে যে, তারা হয়তো ভাববে, এই লোকটি হয়তো ছিল বড় রাজা কিংবা সম্রাট।

এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, দক্ষিণ ইতালির ক্লাবের মধ্য একমাত্র ন্যাপোলি সিরি-এ জিতেছে, তাও ম্যারাডোনার নেতৃত্বে। ভাবা যায়! মাঠের মতো মাঠের বাইরেও বর্ণিল আমার ম্যারাডোনা।

সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর কঠোর সমালোচনা করে তিনি হয়ে যায় পৃথিবীর নির্যাতিত মানুষের কণ্ঠস্বর। কিউবার বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ত্রো তার বন্ধু। ফুটবল থেকে বিদায় নিলেও, একটা সময় কোচ হয়ে আবার ফিরে আসেন তিনি।

২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার কোচ ছিলেন তিনি। মাঠে মেসি, ডাগ আউটে ম্যারাডোনা। সবাই স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছিল- ফুটবলের দুই বরপুত্রকে নিয়ে; কিন্তু ব্যর্থ হয় সেই জুটি। জার্মানদের কাছে হেরে ভঙ্গ হয় স্বপ্নযাত্রা।

Maradona-messi

এরপর তিনি আবার হারিয়ে যান ফুটবল থেকে। কিন্তু তার মন থেকে তো ফুটবল হারায় না। বিশ্বকাপ কিংবা আর্জেন্টিনার খেলা মানেই গ্যালারিতে ম্যারাডোনার সরব উপস্থিতি। এটা নিয়মিত দৃশ্য। মাঠে যে যতই প্রেরণা দিক, গ্যালারিতে ম্যারাডোনা গলা ফাটাচ্ছেন- এটাই যেন আর্জেন্টিনার ফুটবলারদের জন্য অনেক বড় এক অনুপ্রেরণার নাম।

২০১৪ এবং ২০১৮ বিশ্বকাপেও ছিলেন গ্যালারিতে। আর্জেন্টিনার প্রতিটি খেলা তিনি মাতিয়ে রাখতেন গ্যালারি থেকে। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে মাস্ট উইন ম্যাচে তিনি এতটাই উত্তেজিত হয়ে যান যে, দুই পাশে দুজন তাকে ধরে রেখেছিলেন- এই বুঝি তিনি হার্ট অ্যাটাক করেন, এমন অবস্থা।

১৯৮২ সালে বিশ্বকাপে তার যাত্রা শুরু হয়। প্রতিটি বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন অন্যতম আলোচনার বিষয়। কখনো মাঠে, কখনো ডাগ আউটে বা কখনো গ্যালারিতে।

Maradona-messi

কিন্তু ২০২২ বিশ্বকাপে তাকে কোথাও দেখা যাবে না। ১৯৬০ সালের (এই সালে তার জন্ম) যতগুলো বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে, তিনি ছিলেন পৃথিবীতে। ১৯৭৮ বিশ্বকাপে নিজ দেশে বিশ্বকাপ জিতেছিলেন মারিও ক্যাম্পেসরা। বিতর্কিত হলেও ম্যারাডোনা গলা ফাটাতে পেরেছিলেন তরুণ বয়সে।

পরেরবার পরিণত হয়েই বিশ্বকাপ মাতাতে আসেন। এর পরের ইতিহাস তো সবারই জানা। ৬০টি বছর ম্যারাডোনাময় ছিল বিশ্ব ফুটবল। যেভাবেই হোক তার শারীরিক উপস্থিতি ছিল ফুটবলে।

কিন্তু ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। তিনি নেই দুই বছর হয়ে গেলো। থাকলে হয়তো কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামের একটি আসন নির্দিষ্ট হতো তার জন্য। হয়তো মেসিরা মাঠ থেকে অনুপ্রেরণা নিতেন, গ্যালারিতে আনন্দ-উল্লাসে বিভোর থাকা কিংবা খারাপ খেললে হতাশায় মুষড়ে যাওয়া ম্যারাডোনা দেখে।

Maradona

কিন্তু দু’বছর হয়ে গেলো ম্যারাডোনা নেই। হয়তো ওপারে বসে তিনি খেলা দেখবেন। হয়তো উত্তেজিত হবেন মেসিদের ব্যর্থতায়, হয়তো আনন্দিত হবেন মেসিদের সাফল্যে...। হাজার কিলোমিটার দূরে, এই বাংলাদেশ থেকে আমরা মিস করবো ফুটবল জাদুকরকে।

মিস ইউ ম্যারাডোনা... মিস ইউ।

লেখক: নুরুল করিম, সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, নীলফামারী সরকারী কলেজ।

আইএইচএস/