আক্ষেপ কি তবে কাতার বিশ্বকাপে ঘুচবে মেসির?
এ নিয়ে পঞ্চম বিশ্বকাপ এবং লিওনেল মেসি আগেই ঘোষণা দিয়েছেন, এবারই শেষ। এরপর আর আকাশী-সবুজ জার্সিটা পরে বিশ্বকাপ জয়ের জন্য মাঠে নামবেন না। কাতার থেকেই ফুটবলের বিশ্ব আসরকে গুডবাই জানিয়ে রাখবেন তিনি।
ফুটবলকে দু’হাত ভরে দিয়েছেন, এবার ফুটবলের পালা তাকে কিছু দেয়ার। শতাব্দীকাল ধরে বিশ্বকাপ ফুটবলের সবুজ মাঠে ছবি আঁকতে আভির্ভাব হয়েছে কত শত ফুটবলারের। এরমধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন এসেছেন যারা অর্জন করেছেন ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা। পেলে-ম্যারাডোনা তাদের মধ্যে।
লিওনেল মেসি ভালোবাসাটা কুড়িয়েছেন তাদের চেয়ে বেশি। কিন্তু সৌভাগ্য হয়নি বিশ্বকাপ ট্রফিটা হাতে নেয়ার। পেলে তিনবার, ম্যারাডোনা একবার ট্রফির ছোঁয়া পেয়েছিলেন। প্রায় একক নৈপুন্যে ১৯৮৬ বিশ্বকাপটা জিতিয়েছিলেন ম্যারাডোনা।
২০১৪ সালে ট্রফির স্পর্শ থেকে বলতে গেলে নিঃশ্বাস ফেলা চুল পরিমাণ দুরে থাকতে হৃদয় ভেঙেছে মেসির। রিও ডি জেনিরোর মারাকানা স্টেডিয়ামে সোনালি ট্রফিটার পাশ দিয়ে বিষণ্ন বদনে হেঁটে যাওয়া মেসির সেই ছবি এখনও হুল ফোটায় আর্জেন্টিনা ভক্তদের হৃদয়ে। অথচ, নিঃশ্বাস ফেলার দুরত্বে থাকা ট্রফিটিকে ছোঁয়ার সাধ্য তখন তার নেই। অধিকারটাই তো অর্জন করতে পারেননি। তার খানিক আগেই যে মেসির স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলেন জার্মান ফুটবলার মারিও গোৎসে।
‘কত কাছে, অথচ কত দুরে’- মেসির জন্য জনম জনমের দুরত্বেই হয়তো থেকে যাচ্ছে বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফিটা। যদি না শেষবারের মতো এবার কাতার থেকে সুযোগটা নিজের করে নিতে না পারেন ফুটবলের এই ক্ষুদে জাদুকর। বিশ্বকাপ জয়ের সর্বশেষ এবং সেরা সুযোগটা মেসির সামনে। ১৮ ডিসেম্ভর লুসাইল স্টেডিয়ামের সাজানো মঞ্চে উঠে সতীর্থদের নিয়ে শিরোপা উল্লাসে কী শেষ পর্যন্ত মেতে উঠতে পারবেন মেসি? আপাতত সে পর্যন্ত অপেক্ষার পালা।
পেলে না ম্যারাডোনা? কে সেরা? ফুটবলে এটা এক চিরকালীন দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব কিংবা প্রশ্নের সমাধান করার যোগ্যতা রয়েছে একমাত্র লিওনেল মেসির। আর্জেন্টাইন এই জীবন্ত কিংবদন্তি ক্লাব ফুটবলে এমন কোনো ট্রফি নেই, যা জেতেননি। জাতীয় দলের হয়েও সেই খরাটা বিদ্যমান ছিল তার নামের পাশে। তবে, ২০২১ সালে কোপা আমেরিকার ফাইনালে সেই মারাকানায় ব্রাজিলকে হারিয়ে শিরোপা জয় করে নেন মেসি। এখন তার সামনে বাকি শুধুই বিশ্বকাপ শিরোপা জয় করা। এই একটিমাত্র বিশ্বকাপ যদি হাতে তুলে নিতে পারতেন, তাহলে নিশ্চিত পেলে-ম্যারাডোনার শ্রেষ্ঠত্ব ম্লান হয়ে যেতো আর্জেন্টাইন ক্ষুদে জাদুকরের সামনে।
মেসি নিজেও খুব করে চান, অন্তত তার জীবনে এই অপূর্ণতাটা ঘুচে যাক। নিজেই বার বার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 'ফুটবলের দায় শোধ করার এখনই সময়, আমার হাতে একটি ট্রফি তুলে দিয়ে।' কিংবা এমনও বলছেন, 'ইশ্বর চান, আমার হাতে বিশ্বকাপ ট্রফিটা তুলে দিতে।'
ফুটবলের ইতিহাস এতটাই নির্মম যে, সেটা কোনো পারফরমার কিংবা তারকাকে চেনে না। চেনে কেবল বিজয়ীকে। পৃথিবীর ইতিহাসটাও সম্ভবত এমন। বিজয়ীর কীর্তিগাঁথাই ইতিহাসে সোনালী অক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকে। না হয়, ২০১৪ বিশ্বকাপে এমন অসাধারণ ফুটবল খেলে দলকে বিশ্বকাপে তুলে আনার পরও কেন মেসির নামটা ইতিহাসের পাতায় লিখা হবে না!
সেই যে ফাইনাল যুদ্ধে পরাজিতের দলে তারা! পরাজয়ের গ্লানি গ্রাস করেছে এরপর আরও দু'বার। ২০১৫ এবং ২০১৬- দুটি কোপা আমেরিকার ফাইনালে। গ্লানিতে নিমজ্জিত মেসি শেষ পর্যন্ত ঘোষণাই দিয়েছিলেন, জাতীয় দলের হয়ে আর খেলবেন না। যদিও এই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে শেষে তিনি ফিরেও এসেছেন। এরপর খেলেছেন রাশিয়া বিশ্বকাপ এবং এবার খেলছেন কাতার বিশ্বকাপ।
৭বারের ব্যালন ডি'অর যার হাতে ওঠে, যারা বিশ্বকাপে সবসময়ই থাকে ফেবারিটের তালিকায় তার একটি বিশ্বকাপ ট্রফি চাওয়া তো বেশি কিছু নয়। কিন্তু ২০০৬ সালে হলো না, ২০১০ সালেও নাম লেখাতে হয় ব্যর্থদের কাতারে। আর ২০১৪ সালে তো রীতিমত ট্র্যাজেডি রচনা হলো মারাকানায়।
২০১৫ কোপা আমেরিকার ফাইনালেও উঠেছিল লা আলবিসেলেস্তারা। ১৯৯৩ সালের পর যে টানা শিরোপা খরায় ভোগা আর্জেন্টাইনরা নিশ্চিত ছিল, এবার বুঝি সেই খরা কাটতে চলেছে। সামনে ছিল স্বাগতিক চিলি। কিন্তু তারাও যে শেষ পর্যন্ত আর্জেন্টিনার সামনে পরাশক্তি (!) হয়ে উঠবে, তা কে ভাবতে পেরেছিল!
নির্ধারিত সময়, অতিরিক্ত সময় গোলশূন্য ড্র থাকার পর টাইব্রেকারে গিয়ে আর্জেন্টিনার হয়ে মেসি শট জালে জড়াতে পারলেও মিস করে বসেন গঞ্জালো হিগুয়াইন আর এভার বানেগা।
পরেরবার কোপা আমেরিকার শতবর্ষ। আসর বসেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এবারও দুর্বার আর্জেন্টিনা। মেসির ওপর ভর করে আবারও কোপার ফাইনালে লা আলবিসেলেস্তেরা। প্রতিপক্ষ সেই চিলি। এবারওও চিলি যেন আরো বেশি দুরন্ত, দুর্বার।
কিন্তু মেটলাইফ স্টেডিয়ামে গোলশূন্য ড্র থাকার পর খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। কী দুর্ভাগ্য, এবার মেসি নিজেই মিস করে বসলেন টাইব্রেকারের পেনাল্টি শট। মিস করলেন লুকাস বিলিয়াও। সুতরাং, টানা তৃতীয় বছরে আরও একবার চরম হতাশায় মুষড়ে পড়তে হলো আর্জেন্টিনা এবং মেসিকে। সেই রাগ এবং ক্ষোভ থেকেই অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন।
২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডেই ফ্রান্সের কাছে হেরে বিদায় নিতে হয় আর্জেন্টিনাকে। স্বপ্নটা অধরা থেকে গেলো রাশিয়ায়ও। এবার কাতারেও সেই ফেবারিটের তালিকায় রয়েছেন মেসি। তার দলটি টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত। আর মাত্র সাতটা ম্যাচ অপরাজিত থাকতে পারলেই হবে। বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফিটা উঠে যাবে মেসির হাতে।
আইএইচএস/