৮ বছর ধরে লাল-সবুজ জার্সির অপেক্ষায় এক ‘বলবয়’
মতিঝিলে বাফুফে ভবনের সামনের যে গলির রাস্তা তার দুই পাশে আছে অনেক অস্থায়ী খাবার হোটেল। অফিস ডেগুলোতে ফুটপাতের এসব হোটেগুলোয় বেশ ভিড় থাকে। স্বল্প আয়ের মানুষরা এখানে ভোজ সারেন দুপুরে। এ গলিতেই ২০ বছর ধরে হোটেলের ব্যবসা করছেন হবিগঞ্জের ছুনারঘাট উপজেলার মো. জহির আলী। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে বাফুফে ভবনের পেছনেই একটি ভাড়া বাসায় থাকেন জহির আলী ও মনোয়ারা বেগম দম্পতি।
বাসার সামনে বালুর মাঠ (এখন বাফুফের টার্ফ), মাঠের দেয়ালের ওপারে বাবার হোটেল। বাবাকে হোটেলে সহযোগিতা ও বালুর মাঠে ফুটবলের পেছনে ছুটেই বেড়ে ওঠা জহির আলীর দুই ছেলে হাবিবুর রহমান টুটুল ও মোহাম্মদ জুয়েলের। দুই ভাইয়ের ছোটজন জুয়েল বল কুড়িয়েই বেশি সময় পার করতেন। মাঠ থেকে বল উড়ে এসে পড়ত জহির আলীর খাবার হোটেলের সামনে, কখনও দোকানের ওপরে টানানো পলিথিনে। মোহাম্মদ জুয়েল সেই বল ধরে এক কিকে পাঠিয়ে দিতেন মাঠে। বল ধরার জন্য কখনও কখনও দেয়ালেও উঠে বসে থাকতেন। অনেক সময় ওখানেই যে বল আটকে যেত, টেলিফোন ও ডিশ লাইনের তারের জঞ্জালে।
বল কুড়াতে কুড়াতে এক সময় জুয়েল নজরে পড়েন বালুর মাঠে ছেলেদের ফুটবল শেখানো ইব্রাহিম খলিলের (কালা)। তার হাত ধরেই ফুটবল খেলা শুরু। আবাহনীর সোহেল রানা, সাইফ স্পোর্টিংয়ের গোলরক্ষক পাপ্পু হোসেন, মোহামেডানের গোলরক্ষক সুজনদের সঙ্গে একসাথেই কালার কাছে ফুটবল দিক্ষা নেন জুয়েল।
সেই জুয়েল এখন জাতীয় দলের ক্যাম্পে। জেমি ডে’র নজরে পড়ে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ক্যাম্পের ২৮ ফুটবলারের একজন মোহাম্মদ জুয়েল। জাতীয় দলের ক্যাম্পে অবশ্য নতুন নন জুয়েল। এর আগে গত মার্চে নেপালে তিন জাতি টুর্নামেন্টেও ছিলেন অনূর্ধ্ব-২৩ দলের কোটায় নেয়া ৬ জনের মধ্যে।
এবার চলতি প্রিমিয়ার লিগের দ্বিতীয় পর্বে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে জেমির প্রথম ২৮ জনের তালিকায় ঢুকে গেছেন জুয়েল। সর্বশেষ ম্যাচে উত্তর বারিধারার বিপক্ষে জোড়া গোল করে দলকে জিতিয়ে আলোচনায় চলে এসেছেন পুলিশ ফুটবল ক্লাবের এই ফরোয়ার্ড। ঐ ম্যাচের দুই গোলের ভিডিও ক্লিপ এখন ভাসছে ফেসবুকে। সেই সঙ্গে প্রশংসায় ভাসছেন জুয়েলও।
দেশের লাল-সবুজ জার্সি গায়ে জড়াবেন। এর আগে দুইবার অনূর্ধ্ব-১৬ দলে থেকেও সে সুযোগ আসেনি। ২০১৩ সালে নেপালের কাঠমান্ডুতে ও ২০১৫ সালে সিলেটে সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দলের সদস্য ছিলেন। কিন্তু লাল-সবুজ জার্সি গায়ে খেলা হয়নি। বয়সভিত্তিক দল থেকে এখন জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পেয়ে স্বপ্নটা আরও বড় হয়েছে এক সময়ের বলবয় জুয়েলের।
কিভাবে পাল্টে গেলো বলবয় জুয়েলের জীবন? গল্পটা জানা যাক তার কাছ থেকেই।
‘২০১৩ সাল পর্যন্ত কালা স্যারের অধীনেই বালুর মাঠে অনুশীলন করি। ঐ বছর বিকেএসপিতে (বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) ফুটবলে পরীক্ষা দেই, সুযোগ পেয়ে যাই। ভর্তি হওয়ার পরই আমি ডাক পাই অনূর্ধ্ব-১৬ দলে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য। বয়স তখন ১৪ বছরের মতো ছিল আমার। যে কারণে দুই বছর পর সিলেটে হওয়া অনূর্ধ্ব-১৬ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপেও আমি দলে জায়গা পাই। কিন্তু একবারও আমার খেলা হয়নি। ৮ বছর ধরে আমি লাল-সবুজ জার্সির অপেক্ষায় আছি’- বলছিলেন মোহাম্মদ জুয়েল।
২০১৭-১৮ মৌসুমে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের জার্সিতে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে অভিষেক জুয়েলের। মারুফুল হকের কোচিংয়ে স্বাধীনতা কাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়া আরামবাগ দলের সদস্য ছিলেন জুয়েল। পুলিশ ফুটবল ক্লাবে যোগ দেন গত মৌসুমে (পরিত্যক্ত)। ২০ বছর বয়সী জুয়েল লিগে এ পর্যন্ত তিন গোল করেছেন। একটি শেখ জামালের বিপক্ষে, সর্বশেষ ম্যাচে জোড়া গোল উত্তর বারিধারা ক্লাবের বিপক্ষে।
বিকেএসপি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে এখন পড়াশোনা করছেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে। তার বড় ভাই হাবিবুর রহমান টুটুলও বিকেএসপির ছাত্র ছিলেন। এখন খেলেন প্রফেশনাল ফুটবলের দ্বিতীয় স্তর বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের দল ঢাকা সিটি এফসিতে।
ফুটপাতে খাবার হোটেল চালিয়ে চার সন্তানকে মানুষ করেছেন জহির আলী। ফুটবল খেলে টুটুল ও জুয়েলের বেশ ভালোই রোজগার। বাবাকে এখন আর ফুটপাতে খাবার হোটেল চালাতে দিতে চাননা ছেলে রা।
‘আমরা অনেক আগে থেকেই চাচ্ছি বাবা ওখানে হোটেল ব্যবসা না করেন। আমরা চাই, বাবা এখন বিশ্রামে থাকুন। কিন্তু তিনি কিছুতে কাজ ছাড়া থাকতে চান না। হোটেল চালালেও আমরা লোক রেখে দিয়েছি বাবার ওপর থেকে চাপ কমাতে। তবে আর বেশিদিন তাকে কাজ করতে দেবো না’- বাবাকে নিয়ে জুয়েলের ভবিষ্যত পরিকল্পনা।
নিজের লক্ষ্য জাতীয় দলে খেলা। লাল-সবুজ জার্সি তাকে অনেক টানে। ২০১৩ সাল থেকে অপেক্ষায়। সুযোগ পেতে পেতেও পাননি। এখন নিজেকে আরও ভালো প্রস্তুত করে দেশের জার্সিতে খেলতে চান এক সময়ের এই বলবয়।
সর্বশেষ ম্যাচে জোড়া গোল নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে সেটা জেনেছেন জুয়েল। গোল দুটিও ছিল সুন্দর। জুয়েলের মতে, ‘আমরা যখন বড় দলের বিপক্ষে খেলি তখন কৌশল ভিন্ন থাকে। আমাকে একটু নিচে নেমে খেলতে হয়। যে কারণে গোল পাওয়া কঠিন হয়। উত্তর বারিধারার বিপক্ষে ওপরে খেলার সুযোগ পেয়ে দুই গোল করেছি। আমি ওপরেই খেলতে চাই। বয়সভিত্তিক দলের হয়ে লাল-সবুজ জার্সি গায়ে জড়াতে পারিনি। এবার জাতীয় দলের হয়ে সে স্বপ্ন পূরণ করতে চাই।’
আরআই/এসএএস/এমএস