বুদ্ধিদীপ্ত ফরোয়ার্ড ছিলেন বাদল রায়
অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে দুঃসংবাদটি শুনলাম। বাদল রায় আর নেই। শুনেই বুকের মধ্যে কেমন করে উঠলো- ‘চলেই গেলেন বাদল রায়?’
ক্রীড়া সাংবাদিক ক্যারিয়ারে বাদল রায়ের খেলা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। এখনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার ফুটবলসেন্স ও স্কিলের কথা। কী বুদ্ধিদীপ্ত ফরোয়ার্ডই না ছিলেন ‘মোহামেডানের বাদল!’
দেশের ফুটবল তারকাদের নিয়ে বই লেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। বাদল রায়ও ছিলেন আমার বইয়ের একজন তারকা ফুটবলার। বাদল রায় চলে গেলেন। স্মৃতি হিসেবে তাকে নিয়ে লেখাটা থাকবে আমার কাছে। কেমন ফুটবলার ছিলেন বাদল রায় এ প্রজন্মের মানুষের কাছে সেটা তুলে ধরতেই আমার পূর্বের লেখাটি আবার উপস্থাপন করলাম।
১৯৮২ সালে ভারতের দুর্গাপুরে অনুষ্ঠিত আশীষ-জব্বার স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। এটি বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের কোনো দলের প্রথম শিরোপা জয়। মোহামেডানের কৃতিত্বপূর্ণ এই সাফল্যে নেতৃত্ব দেন বাদল রায়।
ছোট বাদল হিসেবেই তিনি ক্রীড়াঙ্গনে অত্যন্ত সুপরিচিত। তিনি ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত ফরোয়ার্ড। নিজে গোল করার চেয়ে সতীর্থদের দিয়েই গোল করাতে পছন্দ করতেন। ফুটবল সেন্স যেমন ছিল, তেমনি ছিল স্কিল। বল নিয়ে অহেতুক ছোটাছুটি না করে গোলের উৎস তৈরি করে সতীর্থ খেলোয়াড়কে পাস দিয়ে দিতেন। আর তা থেকেই অবধারিত গোল। গোল করার অ্যাবিলিটিও ছিল। প্রয়োজনে নিজেও গোল করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেপথ্য নায়ক হয়েই থেকেছেন।
১৯৫৭ সালের ৪ জুলাই কুমিল্লার দাউদকান্দিতে বাদল কুমার রায়ের জন্ম। দাউদকান্দির ইলিয়টগঞ্জ স্কুলে ফুটবলে হাতেখড়ি হয়। বাড়ির পাশের মাঠেও নিয়মিত ফুটবল খেলতেন। ১৯৭২ সালে মেট্রিক পাস করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হবার পর ফুটবলে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লিগে সিএন্ডবি’র হয়ে কয়েকটি ম্যাচ খেলেন।
১৯৭৫ সালে ইয়ংম্যান স্পোর্টিংয়ের হয়ে হ্যাটট্রিকসহ গোলদাতার শীর্ষে অবস্থান করেন। ১৯৭৬ সালে প্রথম বিভাগে ইয়ংম্যান সোসাইটির এবং ১৯৭৭ সালে আঞ্চলিক সুতাকলের হয়ে খেলে সাড়া জাগাতে সক্ষম হন। পাশাপাশি চট্টগ্রাম লিগে কাস্টমস দলের হয়ে খেলতেন।
১৯৭৭ সালে ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ফুটবল লিগে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হলে দলকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। তারই অংশ হিসেবে মোহামেডান বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিভাবান ফুটবলার সংগ্রহ করার দিকে মনোযোগী হয়।
এ জন্য মোহামেডানের দুই ফুটবলার ভানু ও নীহার কুমিল্লায় যান। ওই বছর আঞ্চলিক সুতাকল কুমিল্লা প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় তা উদযাপন করার জন্য অন্য খেলোয়াড়দের সঙ্গে বাদল রায়ও ছিলেন। বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ-খবর পেয়ে ভানু ও নীহার বাদল রায়ের শরণাপন্ন হন। তাদের প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমান তিনি। সেই যে মোহামেডানে যোগ দিলেন এরপর সাদা-কালোর জার্সির এই ক্লাবই হয়ে ওঠে তার ঘর-সংসার ও ভালোবাসা।
১৯৭৭ সালে আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবলে ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে মোহামেডানের হয়ে জীবনের প্রথম ম্যাচ খেলেন। ১৯৭৮ সাল থেকে তিনি হয়ে ওঠেন মোহামেডানের সারথি; মোহামেডানের সুখ-দুঃখের সহচর। ১৯৭৮ সালে প্রথম লিগ খেলতে নেমেই তিনি শিরোপার উষ্ণতা পান। সেবার মোহামেডান অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়। লিগে তার দল ছয়বার (১৯৭৮, ১৯৮০, ১৯৮২, ১৯৮৬, ১৯৮৭, ১৯৮৮) চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
১৯৮১ সালে তার নেতৃত্বে মোহামেডান লিগ রানার্সআপ হলেও ১৯৮৬ সালে শিরোপা জয়ের গৌরব অর্জন করে। মোহামেডানের হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়নশিপের পর শুরুটা হয় তার নেতৃত্বে। ১৯৮১ সালে তার অধিনায়কত্বে মোহামেডান ফেডারেশন কাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়।
তার খেলোয়াড়ি জীবনে মোহামেডান ফেডারেশন কাপ ফুটবলে ছয়বার চ্যাম্পিয়ন হয় (১৯৮০, ১৯৮১, ১৯৮২, ১৯৮৩, ১৯৮৭ ও ১৯৮৯)। ১৯৭৯ সালে ধানমন্ডির সঙ্গে লিগের প্রথম খেলায় এবং ১৯৮১ সালে ফেডারেশন কাপ ফুটবলের ফাইনালে আবাহনীর সঙ্গে স্মরণীয় খেলা উপহার দেন। ধানমন্ডির বিপেক্ষে হ্যাটট্রিকসহ চারটি গোল করেন।
১৯৮২ সালে মোহামেডানের আব্দুস সালাম মুর্শেদী ২৭ গোল দিয়ে লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হলেও এর সিংহভাগ অবদান বাদল রায়ের। তিনি যেভাবে সালামকে গোলের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন, তা ছিল এক কথায় অবিশ্বাস্য। গোল করার সহজ সুযোগ পেয়েও তিনি সালামের পায়ে বল ঠেলে দিয়েছেন। তারপরেও ১৪ গোল দিয়ে তিনি সেবার লিগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন। ঢাকা লিগে অসংখ্য গোল তার পা থেকে এসেছে। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি মোহামেডানের হয়ে খেলে ফুটবল থেকে অবসর নেন। এরপর তিনি সংগঠক হিসেবে সম্পৃক্ত হন।
৫ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার সুদর্শন, অমায়িক ও মিশুক স্বভাবের বাদল রায় ১৯৮১ সাল জাতীয় দলের হয়ে খেলেন। সেবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ সবুজ দলের হয়ে অভিষেক হয়।
এরপর ১৯৮২ সালে করাচিতে কায়েদে আজম স্মৃতি ফুটবল, ঢাকায় দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ সবুজ দল, দিল্লিতে নবম এশিয়ান গেমস, ১৯৮৩ সালে ঢাকায় তৃতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ সবুজ দল, ১৯৮৫ সালে পেশোয়ারে কায়েদে আজম স্মৃতি ফুটবল, ঢাকায় দ্বিতীয় সাফ গেমস, বিশ্বকাপ ফুটবলের গ্রুপ-৩-এর কোয়ালিফাইং রাউন্ডের হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ম্যাচ এবং ১৯৮৬ সালে ঢাকায় চতুর্থ প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ সবুজ দলের হয়ে খেলেছেন।
তিনি ঢাকায় দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে পাকিস্তানের সঙ্গে, নবম এশিয়ান গেমসে মালয়েশিয়ার সঙ্গে, পেশোয়ারে কায়েদে আজম ফুটবলে পাকিস্তান সবুজ দলের সঙ্গে একটি করে গোল করেন। ১৯৮২ সালে ঢাকায় দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে তিনি বাংলাদেশ সবুজ দলের নেতৃত্ব দেন।
খেলোয়াড়ি জীবন থেকে অবসর নেয়ার পর বাদল রায় মোহামেডানের ম্যানেজার ছিলেন তিন বছর। তিনি তার প্রিয় ক্লাবটির পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেছেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন। ২০০৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তিনি টানা তিন মেয়াদে ছিলেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সহসভাপতি। গত ৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বাফুফের সর্বশেষ নির্বাচনে তিনি সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেছিলেন কাজী মো. সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে।
২০০১ সালে সৌদি আরবে বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে বাংলাদেশ জাতীয় দলের ম্যানেজার ছিলেন। এছাড়া তিনি ফ্রান্স এবং লস অ্যাঞ্জেলসে ফিফা কংগ্রেসে যোগ দেন। মনের আনন্দে ফুটবলে জড়িয়ে থাকা বাদল দর্শকদেরও আনন্দ দিয়েছেন অপার।
লেখক : সম্পাদক, পাক্ষিক ক্রীড়াজগত
আরআই/আইএইচএস/এমকেএইচ