কাতারের সঙ্গে ওমান কুয়েতও ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক!
আট বছর আগে নির্ধারণ হয়ে গিয়েছিল ২০২২ বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক হবে কে। মধ্যপ্রাচ্যের ছোট্ট দেশ কাতারকেই নির্ধারণ করা হয়েছিল বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য। সে অনুযায়ী তীব্র গতিতে এগিয়ে চলছে তেল সমৃদ্ধ দেশটির বিশ্বকাপ প্রস্তুতির কাজ। ৩২ দেশের বিশ্বকাপ আয়োজনেরই প্রস্তুতিতে ব্যস্ত তারা।
কিন্তু ফুটবলের অভিভাবক সংস্থা ফিফার ৪৮ দলের বিশ্বকাপ আয়োজনের পরিকল্পনা ৪ বছর এগিয়ে আসার দারুণ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ২০২৬ সালের পরিবর্তে ২০২২ সাল থেকেই ৪৮ দলের বিশ্বকাপ আয়োজন করা যায় কি না সে সম্পর্কে সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে গত এক বছর ধরে।
সম্প্রতি ফিফার সেই সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পুরো কপি ফাঁস হয়ে গেছে মিডিয়ার কাছে। ফ্রান্সের বিখ্যাত সংবাদ সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেস’র (এপি) কাছে ৮১ পৃষ্ঠার সেই রিপোর্ট ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর জানা গেছে, ২০২২ সালে ফিফার ৪৮ দলের বিশ্বকাপ আয়োজনের বৃত্তান্ত।
ফিফা বদ্ধপরিকর, ২০২২ সালেই ৪৮ দলের বিশ্বকাপ আয়োজন করার জন্য। তবে এ আয়োজন যে খুব সহজ নয় তা ফাঁস হওয়া রিপোর্টেই জানা গেছে। রয়েছে নানা জটিলতাও। মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতময় রাজনীতিও এ ক্ষেত্রে বড় একটি বাধা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে সেই রিপোর্টে।
তবে ফিফার কাছে সবচেয়ে অগ্রগণ্য বিষয় হচ্ছে, ৪৮ দলের বিশ্বকাপ আয়োজন করলে ৪০০ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৩ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা) অতিরিক্ত রাজস্ব আয় হবে তাদের। এ কারণে, ২০২৬ সালের পরিবর্তে ২০২২ সালেই ৪৮ দলের বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য এতটা উঠে পড়ে লেগেছে তারা। গত শুক্রবারই যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামিতে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বসে ফিফার গভর্নিং কাউন্সিল। আগামী জুনেই এ বিষয়ে ফাইনাল সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
তবে, ছোট্ট দেশ কাতার কোনোভাবেই ৪৮ দলের বিশ্বকাপ আয়োজন করতে সক্ষম নয়। যদিও কাতারি কর্তৃপক্ষ গত বছর থেকেই বলে আসছিল, দায়িত্ব দেয়া হলে তারা ৪৮ দলের বিশ্বকাপ আয়োজন করেও দেখিয়ে দিতে পারবে।
কাতারি কর্তৃপক্ষ বললেও ফিফার হিসাব ভিন্ন। তারা কাতারের পাশাপাশি আরও একটি কিংবা দুটি দেশকে আয়োজক হিসেবে নির্ধারণ করতে চায়। এ ক্ষেত্রে ফিফার বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের আরও দুটি ছোট দেশ কুয়েত এবং ওমান।
এপির কাছে ফাঁস হওয়া সেই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ৪৮ দলের বিশ্বকাপ আয়োজনের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে গিয়ে ৩টি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছে ফিফা। এর মধ্যে রাজনৈতিক, যৌক্তিক এবং আইনি দিক। কারণ হচ্ছে, ৩২ দলের বিশ্বকাপ হলে হবে ৬৪টি ম্যাচ। ৮টি গ্রুপ। প্রতি গ্রুপে চারটি করে দল। গ্রুপ পর্ব শেষে কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল এবং ফাইনাল।
৪৮ দলের টুর্নামেন্টে মোট ম্যাচ হবে ৮০টি। গ্রুপ করা হবে ১৬টি। প্রতি গ্রুপে দল থাকবে ৩টি করে। প্রতি গ্রুপের সেরা দুটি দল উঠবে দ্বিতীয় রাউন্ডে। ৩২ দলের বিশ্বকাপ হলে সেমিফাইনাল পর্যন্ত যাওয়া দলগুলোর সর্বোচ্চ ৭টি করে ম্যাচ খেলতে হয়। ৪৮ দলের বিশ্বকাপেও এই ফরম্যাটটা পরিবর্তন হবে না। সর্বোচ্চ ৭ ম্যাচই খেলতে হবে।
ফিফার সেই রিপোর্টে কাতারের পাশাপাশি আয়োজক হিসেবে সম্ভাব্য কয়েকটি দেশের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, বাহরাইন, কুয়েত, ওমান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। এদের মধ্যে কাতারের সঙ্গে সৌদি আরব, বাহরাইন এবং আরব আমিরাতের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চরমে।
২০১৭ সাল থেকেই কাতারের সঙ্গে সব ধরনের অর্থনৈতিক, কুটনৈতিক এবং ভ্রমণ বা পর্যটন সম্পর্কিত সব ধরনের সম্পর্ক স্থগিত সৌদি, বাহরাইন এবং আরব আমিরাত জোটের। এমনকি কাতারের সঙ্গে এসব দেশের বিমান যোগাযোগ পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছে। ফিফা উপলব্ধি করেছে, বিদ্যমান রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে বিশ্বকাপ আয়োজনে কাতারের সঙ্গে সৌদি, বাহরাইন কিংবা আরব আমিরাতকে জুড়ে দেয়া যাবে না।
এপি’ই জানাচ্ছে, বিকল্প হিসেবে ফিফা ওমান এবং কুয়েকতেই ভেবে রেখেছে। উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজনৈতিক এবং কুটনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করেই এই বিকল্প চিন্তা করে রেখেছে তারা। যদিও পার্টনার হিসেবে বাছাই করার সম্পূর্ণ এখতিয়ার কাতারেরই। সে ক্ষেত্রে তারা দুই দেশকেই কিংবা কেবল একটি দেশকে বাছাই করে নিতে পারে।
সম্ভাব্যতা যাচাই রিপোর্টে লেখা হয়েছে, ‘বর্তমান পরিস্থিতি বিচারে বাহরাইন, সৌদি আরব এবং আরব আমিরাতের সঙ্গে কাতারের বিদ্যমান রাজনৈতিক খারাপ সম্পর্কের কারণে এক সঙ্গে বিশ্বকাপ আয়োজন করা সম্ভব নয়। কাতারের পার্টনার হিসেবে এমন কোনো দেশকে নির্বাচন করা প্রয়োজন, যাদের মধ্যে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। একই সঙ্গে জুটি নির্বাচন করার পর যেন দু’দেশের মধ্যে আবার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব লেগে না যায়। সে জন্য কুয়েত এবং ওমানই রয়েছে কাতারের জুটি হিসেবে সবচেয়ে বেশি বিবেচনার তালিকায়।’
লজিস্টিক্যাল (যৌক্তিক) চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, কাতার ৩২ দলের বিশ্বকাপের ৬৪টি ম্যাচ আয়োজন করার জন্য মোট ৮টি স্টেডিয়াম প্রস্তুত করছে। মাত্র ৩০ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যেই অবস্থিত এই ৮টি স্টেডিয়াম। ফিফা বলছে, ৪৮ দলের বিশ্বকাপ আয়োজন করার জন্য আরও দুই থেকে চারটি স্টেডিয়াম নির্মাণ করা প্রয়োজন। যেগুলো হবে একটি কিংবা দুটি দেশের মধ্যে।
ফিফা আবার একই সঙ্গে জানিয়েছে, যে’ই সহযোগি-আয়োজক হতে চাইবে, তাদেরকে সেই দেশের সরকারের লিখিত অনুমতি এবং মানবাধিকার পরিস্থিতির সার্টিফিকেট প্রদান করতে হবে। সেই রিপোর্টেই বলা হয়েছে, ‘সহযোগি আয়োজক হওয়ার প্রার্থীদের জন্য নির্ধারিত নিয়ম-কানুন প্রযোজ্য হবে। একই সঙ্গে মূল আয়োজক দেশ কাতারের সর্ব সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত থাকতে হবে এ ব্যাপারে। এসব বিষয়ছাড়া ফিফা এই মুহূর্তে বলতে পারছে না, কাতারের সঙ্গে কারা সহযোগি-আয়োজক হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হতে পারবে।’
মূলতঃ ফিফার পরিকল্পনা ছিল ৪৮ দলের বিশ্বকাপ আয়োজন করা হবে ২০২৬ সাল থেকেই। সে হিসেবেই ২০২৬ সালের ৪৮ দলের বিশ্বকাপের জন্য আয়োজক নির্ধারণ করে ফেলেছে ফিফা। সে সময় ফিফার একটি শর্ত ছিল বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য প্রতিটি স্টেডিয়ামে অন্তত ৪০ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন হতে হবে। তবে ২০২২ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য ফিফার সেই শর্তটা কি, তা এবার উল্লেখ করা হয়নি।
যদিও মধ্যপ্রাচ্যে মাত্র ৮টি অতিরিক্ত স্টেডিয়াম পাওয়া গেছে বিশ্বকাপ আয়োজন করার মত। কিন্তু এগুলোর মধ্যে আরব আমিরাতে দুটি, সৌদি আরবে একটি এবং কুয়েতের একটি স্টেডিয়াম পাওয়া গেছে, যেগুলোর দর্শক ধারণক্ষমতা ৪০ হাজার কিংবা তার বেশি।
ফাঁস হওয়া রিপোর্টেই বলা হয়েছে, ‘অন্তত ১০টি স্টেডিয়াম থাকা প্রয়োজন ৪৮ দলের বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য। তাহলে গ্রুপ পর্বে একদিনে অন্তত ৬টি ম্যাচ আয়োজন করা সম্ভব হবে। একই ভেন্যুতে পরপর ম্যাচ আয়োজন করতে হবে তখন। তবে ১২টি স্টেডিয়াম হলেই সবচেয়ে ভালো হয়।’
২০১০ সালে কাতারকে ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে নির্ধারণের পর থেকেই একের পর এক বিতর্ক লেগে রয়েছে। এর মধ্যে কাতার আয়োজক নির্ধারিত হওয়ার কারণে ফিফা আগামী বিশ্বকাপের সূচিতেও পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে। সাধারণত জুন-জুলাইয়ে আয়োজন করা হয় বিশ্বকাপের আসর। কিন্তু ওই সময় কাতারে থাকবে পুরোপুরি গ্রীষ্মকাল। প্রচন্ড গরম। সুতরাং, টুর্নামেন্ট নেয়া হয়েছে নভেম্বর-ডিসেম্বরে। ইউরোপিয়ান লিগগুলোর সূচির সঙ্গে সংঘাত সত্ত্বেও এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় ফিফা।
তবে, ৩২ দল থেকে বাড়িয়ে ৪৮ দলের করা হলেও টুর্নামেন্টের সময় বাড়ানো হবে না। ২৮ দিনের মধ্যেই শেষ করা হবে বিশ্বকাপের খেলা। ২১ নভেম্বর থেকে শুরু হবে ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ করা হবে বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো।
আইএইচএস/এমএস