পুরুষ ফুটবল দলের কোচ হওয়া একজন নারীর গল্প
বাংলাদেশের নারীরা এখন কোথায় নেই? পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তারা। অফিস, আদালত আর দোকাটপাট থেকে শুরু করে উড়োজাহাজের ককপিটে-নারীরা এখন এগিয়ে চলার সাহসী প্রতীক। এক একজন সাহসী নারীর গল্প এখন আরেক নারীর এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা। তেমনই একজন নারী মিরোনা। খেলার মাঠে তিনি এক ইতিহাস। পুরুষ ফুটবল দলে দেশের প্রথম নারী কোচ।
মিরোনার বাড়ী বাগেরহাটে। পড়তেন রহিমাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন ইভেন্টে অংশ নিয়ে সবার নজর কেড়েছিলেন মিরোনা। দেখতে ছোটখাটো। উচ্চতা ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি। অনেকের চোখে ‘পিচ্চি।’ কিন্তু মাঠে মিরোনা অপ্রতিরোধ্য। স্কুলের বারান্দা থেকে মাঠ এবং এখন জাতীয় পর্যায়ে একজন সফল নারী।
স্কুল জীবনে বড় নেশা ছিল অ্যাথলেটিক। দৌড়টা বেশ ভালোই পারতেন। বিশেষ করে দূরপাল্লার দৌড়ে মিরোনাকে হারানোটা ছিল কঠিন। জাতীয় পর্যায়ে তিনি স্বর্ণ জিতেছেন ৮০০,১৫০০ ও ৩০০০ মিটার দৌড়ে। ম্যারাথনেও অপ্রতিরোধ্য এক নাম মিরোনা।
অ্যাথলেটিকের পাশাপাশি ফুটবলও খেলতেন মিরোনা। মজার বিষয় হলো, এই ফুটবলারকে খুঁজে বের করেছিলেন একজন ক্রিকেট কোচ। তার নাম ইমতিয়াজ হোসেন পিলু। তার আগে থেকেই বাগেরহাটে ফুটবল অনুশীলন শুরু করেছিলেন মিরোনা। ২০০৮ সালে খুলনার হয়ে তিনি ঢাকায় আসেন জাতীয় মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে। কমলাপুর বীরশ্রেষ্ট মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে মাতিয়ে সেরা ফুটবলারের পুরস্কার নিয়ে ঘরে ফিরেছিলেন মিরোনা।
মিরোনার বাবার শেখ আবদুল গনি। তিন ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে মিরোনা তৃতীয়। প্রতিভা দিয়েই তিনি দেশের অ্যাথলেটিক ও ফুটবলে পরিচিত এক মুখ। জাতীয় নারী ফুটবল দলের সাবেক এ ডিফেন্ডার বুট জার্সি তুলে রেখে নেমে পড়েছে কোচিং পেশায়। ২০০৮ সালে জাতীয় পর্যায়ের ফুটবলে অভিষেক। পরের বছরই জাতীয় দলে। টানা ৭ বছর লাল-সবুজ জার্সিতে দেশের রক্ষণ পাহাড়া দিয়েছেন তিনি।
খেলা ছেড়েই খেলোয়াড় তৈরির কাজে নেমে পড়েন মিরোনা। ২০১৩ সালে এএফসি ‘সি’ লাইসেন্স ও ২০১৮ সালে এএফসি ‘বি’ লাইসেন্স কোর্স করেছেন মিরোনা। অ্যাথলেট হিসেবে ২০১৪ সালে চুক্তিভিত্তিক চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। পারফরম্যান্সই তাকে এক বছরের মধ্যে নৌবাহিনীতে স্থায়ী করে দেয়। সেই নৌবাহিনীর সহযোগিতায় তিনি এখন পুরুষ ফুটবল দলের ডাগআউটে।
প্রফেশনাল ফুটবলের দ্বিতীয় স্তর বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের (বিসিএল) নতুন ঢাকা সিটি এফসির প্রধান কোচের দায়িত্ব নিয়েছেন মিরোনা। ২৬ বছরে তিনি ইতিহাস তৈরি করেছেন দেশের ফুটবলে। অন্যান্য ডিসিপ্লিনে ছেলেদের কোচিং করানোয় মেয়েদের অভিজ্ঞতা থাকলেও ফুটবলে আগে কখনো এ নজির ছিল না। মিরোনাই তৈরি করেছেন সেই নতুন ইতিহাস।
খেলা ছেড়ে যেদিন কোচিং কোর্স শুরু করেছিলেন মিরোনা, সেদিন মনে পণ করেছিলেন বড় কোচ হওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু এটা কখনো ভাবেননি যে কোচ হিসেবে অভিষেকটা হবে পুরুষ দলের ডাগআউটে। মিরোনার সামনে এ সুযোগটা এসেছে হঠাৎ করেই। সিটি এফসির প্রস্তাবের আগে মিরোনাকে পেতে চেয়েছিল ভারতের একটি রাজ্য দল থেকে। তিনি সে প্রস্তাব রাখতে পারেননি বিপিএড পরীক্ষার কারণে।
সিটি এফসির কোচ আবু আবু নোমান এএফসি ‘সি’ লাইসেন্সধারী। চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের নিয়ম অনুযায়ী ক্লাবের প্রথম কোচ হতে হবে ‘বি’ লাইসেন্সধারী। তাইতো এই ক্লাবের প্রধান কোচ হওয়ার প্রস্তাবটা পেয়ে যান মিরোনা। গত ডিসেম্বরে এই ক্লাবের কোচ হিসেবে যোগ দিয়েছেন জাতীয় নারী ফুটবল দলের সাবেক এ ডিফেন্ডার।
জাতীয় দলে ফুটবল খেলেছেন। খেলেছেন ঘরোয়া ফুটবলে বিভিন্ন ক্লাবে। এমন কী দেশের বাইরে লিগ খেলার অভিজ্ঞতাও আছে তার। ২০১৪ সালে মালদ্বীপের ঘরোয়া ফুটবলে বাংলাদেশের ৩ নারী ফুটবল অংশ নিয়েছিলেন। স্ট্রাইকার সাবিনা খাতুন, গোলরক্ষক সাবিনার সঙ্গে মিরোনাও খেলে এসেছিলেন মালদ্বীপের ঘরোয়া ফুটবলে।
এসব ইতিহাস পেছনে ফেলে মিরোনা তৈরী করেছেন নতুন ইতিহাস-বাংলাদেশে পুরুষ ফুটবল দলের প্রথম নারী কোচ। এখানেই থেমে থাকতে চাননা মিরোনা। দাঁড়াতে চান আরো বড় লিগের ডাগআউটে। ঢাকা সিটি এফসি প্রিমিয়ার লিগে ওঠার লক্ষ্য নিয়েই দল গড়েছে। যদিও লিগের দলবদল শুরু হওয়ার মাত্র এক মাস আগে বাফুফে ক্লাবটিকে খেলার অনুমতি দিয়েছে। তাই অন্য ক্লাবগুলোর দল গোছানোর পর মাঠে নামতে হয়েছে তাদের। যে কারণে প্রত্যাশা অনুযায়ী দল তারা করতে পারেনি।
প্রথম কোনো দলের প্রধান কোচ। তার ওপর আবার ছেলেদের। কোন সমস্যা অনুভব করছেন মিরোনা? ‘কোনো সমস্যা নেই। ফুটবল তো ফুটবলই। সে পুরুষদের হোক আর মেয়েদের। আমি যখন অনুশীলন করাই তখন মনে করি ফুটবলারদের অনুশীলন করাচ্ছি। তারা ছেলে নাকি মেয়ে তা মাথায় নেই না। আমার বিশ্বাস একজন ফুটবলারের সামনে তার কোচও পুরুষ কি নারী সেটা বিষয় না। সব খেলোয়াড়কেই সম্মান দিতে হবে কোচকে। তাহলেই শিখতে পারবে’-বলছিলেন মিরোনা খাতুন।
খেলোয়াড় হিসেবে এসএ গেমস, অলিম্পিক বাছাই, এশিয়ান বাছাই খেলেছেন। ফুটবলার হিসেবে দেশে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলো ছড়ানো মিরোনা কোচ হিসেবেও নিজেকে নিতে চান অনন্য উচ্চতায়। মিরোনা সেটা পারবেন বলেই দৃঢ় বিশ্বাস ঢাকা সিটি এফসির সাধারণ সম্পাদক মো. শামসুদ্দোজা খান তুহিনের। ফুটবলে নতুন এই ক্লাবটি প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিলে। সাধারণ সম্পাদক অবশ্য একজন ব্যবসায়ী।
মিরোনা প্রসঙ্গ উঠতে মঙ্গলবার মো. শামসুদ্দোজা খান তুহিন বলেন, ‘মিরোনা খুবই মেধা সম্পন্ন এক মেয়ে। তার কোচিং করানোর স্টাইল আধুনিক। আমাদের যখন ‘বি’ লাইসেন্সধারী একজন কোচ দরকার হলো তখন তাকে পছন্দ করি। কারণ, সে নৌবাহনীতে থাকায় আমাদের অনেকেরই মিরোনা সম্পর্কে ধারণা ছিল। এক কথায় আমি বলবো-মিরোনা খুবই বুদ্ধিমতী মেয়ে।’
ঢাকা সিটি এএফসির কোচের দায়িত্ব নেয়ার আগে ভারতের একটি রাজ্য দল থেকেও প্রস্তাব পেয়েছিলেন মিরোনা। বিপিএড (শারীরিক শিক্ষায় স্নাতক) না থাকায় সে সুযোগটা নিতে পারেননি। সেটা যেন মিরোনার জন্য শাপেবরই হয়েছে। ভারতের ওই রাজ্য দলের দায়িত্ব নিলে মিরোনার যে এ যাত্রায় পুরুষ দলের প্রধান কোচ হয়ে ইতিহাস গড়া হতো না।
নারী হয়ে পুরুষ ফুটবলারদের কোচিং। এটা বড় একটা চ্যালেঞ্জ। মিরোনা সেই চ্যালেঞ্জটা ভালোভাবেই নিয়েছেন। অনুশীলন করাতেও তার ভালো লাগছে। ‘আমি চ্যালেঞ্জিং এ দায়িত্বটাকে বেশ উপভোগ করছি। ঢাকা সিটি এফসি দলে অনেক ভালো মানের ফুটবলার আছেন। আশা করি, এ দলটিকে প্রিমিয়ারে তুলতে পারবো। আর তাহলে তো বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের কোচ হিসেবে কাজ করতে পারবো’- কথাগুলো বলতে গিয়ে নিজের আরো বড় স্বপ্নের জালবোনার গল্প শোনালেন ইতিহাস গড়া মিরোনা।
জাতীয় দলের নিয়মিত ফুটবলারের পাশাপাশি অ্যাথলেটিকসেও মিরোনার ছিল গৌরবময় উপস্থিতি। সেখানেও কাটিয়েছেন সোনালী সময়। আর অ্যাথলেটিকসের ট্র্যাক মাতিয়েছেন বিজেএমসি ও নৌবাহিনীর হয়ে। দূরপাল্লার দৌড়ে ৮০০, ১৫০০ ও ৩০০০ মিটারে জাতীয় আসরে সোনা জিতেছেন ১৩টি। ফুটবল মাঠ আর অ্যাথলেটিক ট্র্যাকের পর এবার কোচ হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চান মিরোনা খাতুন।
আরআই/এমএমআর/এমকেএইচ