ফুটবলে ইতিহাস গড়ার বছর বাংলাদেশের
কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে আরেকটি বছর। আর পাঁচদিন পর দেয়ালের পুরনো ক্যালেন্ডারটি সরিয়ে জায়গা করে নেবে নতুন একটি। ২০১৯ সালকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে গোটা বিশ্ব। স্মৃতির খেরোখাতা থেকে ইতোমধ্যেই মানুষ মেলাতে শুরু করছে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব। সমাজের অন্যসব ক্ষেত্রের মতো ক্রীড়াঙ্গনেও চলছে সফলতা ও ব্যর্থতার চুলচেরা বিশ্লেষণ। বিদায়ী বছরে দেশে ও দেশের বাইরে ক্রীড়াঙ্গনের উল্লেখযোগ্য দিকগুলো নিয়ে ধারাবাহিক পর্যালোচনার আজকের পর্ব- ফুটবল।
২০১৭ সাল বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য হতাশার এক বছর। কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ না খেলেই বছরটি কাটিয়েছিল বাংলাদেশ। সে তুলনায় ২০১৮ সালটি জাতীয় দলের জন্য খারাপ কাটেনি। দুটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজনের পাশাপাশি ৮টি ম্যাচ খেলেছে লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। যার তিনটিতে জিতে একটি ড্র করে চারটি হেরেছে।
ফিফা র্যাংকিংয়ে বড় কোনো পরিবর্তন না হলেও গ্রাফটা ছিল উন্নতির দিকে। ১৯৭ র্যাংকিং নিয়ে বছর শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের। শেষ করছে ১৯২ তে থেকে। পুরো বছরে র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ঘোরাঘুরি করেছে ১৯২ থেকে ১৯৭ এর মধ্যে। জানুয়ারি থেকে মে- টানা এই ৫ মাস ১৯৭ তে ছিল বাংলাদেশ। জুন থেকেই অবস্থার উন্নতি হতে থাকে একটু একটু করে। ১৯৪, ১৯৩ থেকে বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ১৯২।
কোনো দেশের ফুটবলের মানদন্ড মানেই জাতীয় দলের পারফরম্যান্স। নারী কিংবা বয়সভিত্তিক দলের সাফল্য ম্লান হয়ে যায় জাতীয় দল ভালো কিছু না করতে পারলে। বাংলাদেশ আগের বছর আন্তর্জাতিক ফুটবলের বাইরে ছিল। ১৬ মাস পর বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ফুটবলে ফেরে এ বছর মার্চ। ২৭ মার্চ লাওসে ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচে স্বাগতিকদের সঙ্গে ২-২ গোলে ড্র করে আন্তর্জাতিক ফুটবলে ফেরে বাংলাদেশ।
বছরের বাকি সময়ে বাংলাদেশ একটি ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলে শ্রীলংকার বিরুদ্ধে ২৯ আগস্ট নীলফামারীতে। ম্যাচটি স্বাগতিকরা হারে ১-০ গোলে। তারপর দুটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট হয় বাংলাদেশে। ৪ সেপ্টেম্বর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ ২-০ গোলে ভুটানকে হারিয়ে প্রতিশোধ নেয় প্রায় দুই বছর আগের হারের। দ্বিতীয় ম্যাচে পাকিস্তানকে ১-০ গোলে হারায় লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। তবে নেপালের কাছে ২-০ গোলে হেরে টানা চতুর্থবারের মতো গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেয় বাংলাদেশ।
অক্টোবরে ঢাকা, সিলেট ও কক্সবাজারে বসে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট। বাংলাদেশ সেমিফাইনাল পর্যন্ত উঠেছিল জাতির জনকের নামের এ টুর্নামেন্টে। সিলেটে লাওসকে ১-০ গোলে হারিয়ে এবং ফিলিপাইনের কাছে ১-০ গোলে হেরে গ্রুপ রানার্সআপ হয়ে সেমিফাইনালে উঠে বাংলাদেশ। কক্সবাজারে সেমিফাইনালে ফিলিস্তিনের কাছে ২-০ গোলে হেরে যায় স্বাগতিক বাংলাদেশ।
জাতীয় দলের ভালো-মন্দের মিশেলের বছরে অবশ্য অনূর্ধ্ব-২৩ দল ইতিহাস সৃষ্টি করেছে এশিয়ান গেমসে। আগস্টে ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত এ গেমসে কাতারেরমত শক্তিশালী দলকে হারিয়ে বাংলাদেশ গ্রুপ পর্ব টপকে উঠেছিল নকআউট পর্বে। গেমসের সেরা ১৬ দলে নাম লিখিয়ে ইতিহাস রচনা করে বাংলাদেশ। এশিয়ার সবচয়ে বড় ক্রীড়া আসরের ফুটবলে বাংলাদেশ আগে কখনো সেরা ১৬ দলে নাম লেখাতে পারেনি।
এশিয়ান গেমস ফুটবলে বাংলাদেশ খেলেছে ‘বি’ গ্রুপে। প্রতিপক্ষ ছিল উজবেকিস্তান, থাইল্যান্ড ও কাতার। ধরেই নেয়া হয়েছিল আগের গেমসগুলোর মতো এবারও বিদায় নিতে হবে গ্রুপ পর্ব থেকে। প্রথম ম্যাচে উজবেকিস্তানের কাছে ৩-০ গোলে হারের পর সে আশঙ্কা আরো বড় হয়েছিল।
কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচে থাইল্যান্ডের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে আশা তৈরি করে জেমি ডে’র শিষ্যরা। শেষ ম্যাচে কাতারকে ১-০ গোলে হারিয়ে রচনা করে নতুন ইতিহাস। শেষ ষোলোতে বাংলাদেশের খেলা ছিল উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে। এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী দলের সঙ্গে ৩-১ গোলে হারে লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। এশিয়ান গেমস ফুটবলে এ সাফল্য ২০১৮ সালে মনে রাখার মতো।
আগের বছরের মতো ২০১৮ সালেও ছেলে ও মেয়েদের বয়সভিত্তিক ফুটবলে বেশ সাফল্য এসেছে বাংলাদেশের। মার্চে হংকংয়ে অনুষ্ঠিত মেয়েদের চারজাতি অনূর্ধ্ব-১৫ জোকি কাপে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে প্রতিপক্ষ দলগুলোকে গোলবন্যায় ভাসিয়ে। মালয়েশিয়াকে ১০-০, ইরানকে ৮-০ ও স্বাগকিতদের ৬-০ গোলে হারিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় মারিয়া-তহুরারা।
আগস্টে ভুটানে মেয়েদের সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপে ফাইনালে উঠেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ভারতের কাছে ১-০ গোলে হেরে শিরোপা হাতছাড়া করে বাংলাদেশের কিশোরীরা। আগের বছর ঢাকায় ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশের মেয়েরা।
সেপ্টেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইয়ে বাংলাদেশ অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় বাহরাইন, লেবানন, আরব আমিরাত ও ভিয়েতনামকে হারিয়ে। চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা নাম লেখায় চূড়ান্ত পর্বে।
অক্টোবরে ভুটানে বসেছিল প্রথম সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ চ্যাম্পিয়নশিপ। প্রথম আসরের ট্রফি জিতে আনে বাংলাদেশের মেয়েরা। ফাইনালে বাংলাদেশ ১-০ গোলে হারায় নেপালকে।
একই মাসে ছেলেদের সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপ হয় নেপালে। বাংলাদেশের কিশোররা ঘরে ফেরে ট্রফি নিয়ে। ভুটানকে ৯-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে শুভ সূচনা করে বাংলাদেশ। নেপালকে ২-১ গোলে নিশ্চিত করেছিল সেমিফাইনাল। সেমিফাইনালে ভারতকে ও ফাইনালে পাকিস্তানকে টাইব্রেকারে হারিয়ে শিরোপ পুনরুদ্ধার করে বাংলাদেশের কিশোররা। এর আগে ২০১৫ সালে সিলেটে অনুষ্ঠিত সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিল বাংলাদেশ।
নভেম্বরে বাংলাদেশের মেয়েরা অংশ নিয়েছিল টোকিও অলিম্পিক গেমস ফুটবলের বাছাই পর্বে। তবে ফলটা ভালো হয়নি। মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতা থেকে বাংলাদেশ ফিরেছে মাত্র ১ পয়েন্ট নিয়ে। প্রথম ম্যাচে মিয়ানমারের কাছে ৫-০ গোলে হারের পর ৭-১ গোলে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হয় সাবিনারা। শেষ ম্যাচ নেপালের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে বাংলাদেশ।
অক্টোবরে তাজিকিস্তানে নারী অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলে বাংলাদেশ ৪ দেশের মধ্যে তৃতীয় হয়ে ফিরেছিল মারিয়া-মৌসুমীরা। দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে ৭-০ গোলে হার দিয়ে শুরু হয়। দ্বিতীয় ম্যাচে ২-০ গোলে হারা চাইনিজ তাইপের কাছে। তৃতীয় ম্যাচে বাংলাদেশ ৫-১ গোলে হারায় তাজিকিস্তানকে।
আরআই/আইএইচএস/পিআর