প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে ‘আফগান মেসি’
মোর্তাজা আহমেদি, যাকে পুরো বিশ্ব চিনে আফগান মেসি হিসেবেই। পলিথিন ব্যাগ দিয়ে বানানো আর্জেন্টাইন খুদে জাদুকর লিওলেন মেসির জার্সি পরা মোর্তাজার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল ২০১৬ সালে। যার পর মেসির সঙ্গে দেখা করারও সৌভাগ্য হয়ে যায় আফগান বালকের। রাতারাতি সে হয়ে উঠে বিখ্যাত।
সেই খ্যাতিই যেন আফগান মেসির জীবনটা শঙ্কায় ফেলে দিয়েছে। সাত বছর বয়সী মোর্তাজাকে খুন করতে হন্যে হয়ে খুঁজছে তালিবান সন্ত্রাসীরা। প্রাণভয়ে তাকে নিয়ে ঘর ছেড়েছে পরিবার। আফগানিস্তানে গাজনি প্রদেশের দক্ষিণপূর্বাঞ্চলের বাড়িটি ছেড়ে গত নভেম্বরে নিরুদ্দেশ হয়েছেন তারা।
শুধু মোর্তজার পরিবার নয়, তালিবান সন্ত্রাসীদের ভয়ে এলাকা ছেড়েছে শত শত পরিবার। গাজনি ছেড়ে তারা পারি জমিয়েছেন কাবুলে। যেখানে প্রতিটি পরিবারই রীতিমত মানবেতর জীবনযাপন করছে।
২০১৬ সালে আফগানিস্তানের যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে দাঁড়িয়ে তোলা মোর্তাজার একটি ছবি ভাইরাল হয়ে যায়। যেটিতে দেখা যায়, মেসির দশ নাম্বার জার্সি পরে আছেন ছোট্ট মোর্তাজা। কিন্তু আর্জেন্টিনার নীল-সাদা স্ট্রাইপের সেই জার্সিটি ছিল পলিথিন ব্যাগ দিয়ে বানানো। মেসির প্রতি ভালোবাসা তার অগাধ, কিন্তু দরিদ্র পরিবার একটি জার্সি কিনে দিতে পারেনি-এমন ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে বাতাসের বেগে।
মিডিয়ার কল্যাণে সেটি পড়ে মেসির চোখেও। সে বছরই কাতারে আর্জেন্টাইন জাদুকরের সঙ্গে দেখা করার সৌভাগ্য হয় মোর্তাজার। বার্সেলোনার প্রীতি ম্যাচের দিনে তাকে কোলে নিয়ে ঘুরেছেন মেসি। অটোগ্রাফ সম্বলিত জার্সি ও ফুটবলও উপহার দিয়েছেন। বিশ্বজুড়ে সাড়া পড়ে যায়, মোর্তাজার মতো ভাগ্যবান বোধ হয় আর কেউ নেই!
সেই সৌভাগ্য দুভার্গ্য হতে বেশি দিন সময় লাগলো না। তালিবান সন্ত্রাসীদের ভয়ে নিজের ভিটে মাটি ছেড়ে কাবুলে পালিয়ে এসেছে মোর্তাজা ও তার পরিবার। সেখানেই আরেকটি দরিদ্র পরিবারের সঙ্গে বাসা ভাড়া নিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটছে তাদের।
'এএফপি'র কাছে মোর্তাজার মা জানালেন, নিজ জেলায় এক রাতে গুলির আওয়াজ শোনার পরই পালিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তারা। স্কার্ফের মাঝে শুধু তার মুখটা দেখা যাচ্ছিল। সেখানেও বোঝা যাচ্ছিল, চোখে পানি টলটল করছে।
মোতার্জার মা শফিকা জানালেন, তার সন্তান বিখ্যাত হওয়াতেই আরও ভয় বেশি তাদের। কান্নাজড়িত কন্ঠে বলছিলেন, ‘আমরা কিছু সঙ্গে নিয়ে আসতে পারিনি। শুধু নিজের জীবনটা নিয়ে এসেছি। তারা বলছিল, যদি তাকে (মোর্তাজা) ধরতে পারে, তবে কেটে টুকরো টুকরো করবে।’
ছেলেকে সন্ত্রাসীদের চোখের আড়ালে রাখতে স্কার্ফ দিয়ে মুখ ঢেকে রাখেন বলেও জানিয়েছেন শফিকা। বিখ্যাত হওয়ায় মোর্তাজাকে নিয়েই সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে আছেন তারা।
মোর্তাজার মা আরও বলেন, ‘তালিবানদের ফিরে আসার সম্ভাবনা আছে। ফিরে যাওয়া তাই কোনো সমাধান নয়। স্থানীয় প্রভাবশালিরা বলতেন, তোমরা বড়লোক হয়েছ। মেসির কাছ থেকে যে টাকা পেয়েছ তা দিয়ে দাও, না হলে তোমার ছেলেকে নিয়ে যাব। রাতে আমরা মাঝেমধ্যে দেখতাম, অপরিচিত মানুষ ঘোরাঘুরি করছে। আমাদের ঘরবাড়ি তল্লাশি করছে। ওই দিনগুলোতে আমরা তাকে অন্য ছেলেদের সঙ্গে খেলতে দিতেও ভয় পেতাম।’
মোর্তাজাকে নিয়ে তার মা চলে এলেও তার বাবা আরিফ জাঘোরিতে রয়ে গেছেন। সেখানে তিনি কৃষিকাজ করেন। কাবুলে পালিয়ে পরিবারের সঙ্গে পালিয়ে আসা মোর্তাজার বড় ভাই হুমায়ুন, যিনি ওই বিখ্যাত জার্সিটা বানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি জানালেন, এখানেও তারা নিজেদের নিরাপদ মনে করেন না। হুমায়ুন বলেন, ‘আমরা সবসময় ভয়ে থাকি, যদি তারা জানে মোর্তাজা এখানে তবে বিপদ হতে পারে।’
ছোট্ট মোর্তাজা অবশ্য এখনও এসব কিছু বোঝে না। সে তার বাড়িতে ফেলে আসা মেসির জার্সি আর ফুটবলটাকে খুব মিস করে। সারল্যমাখা চেহারা নিয়ে সে বলে, ‘আমি সেগুলো ফেরত চাই, তাহলে খেলতে পারব। আমি মেসিকে মিস করি। তার সঙ্গে দেখা হলে আমি তাকে সালাম দেব, জিজ্ঞেস করব কেমন আছো? সে বলবে ধন্যবাদ, ভালো থাকো। আমি তার সঙ্গে মাঠে যাব, যেখানে সে খেলে। আমি তাকে দেখব।’
এমএমআর/জেআইএম