নারী ফুটবলারদের মুখে সোনার চামচ, অবহেলিত ছেলেরা
ফিফা নারী বিশ্বকাপের সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন কোন দেশ? মেয়েদের ফুটবলের সবচেয়ে বড় ও মর্যাদার এ টুর্নামেন্ট শুরু হয়েছিল কবে? প্রথম আয়োজক কারা? প্রথম ট্রফি জিতেছিল কোন দেশ? ফুটবলের খোঁজখবর যারা রাখেন তাদের অনেকেই এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে মাথা চুলকাবেন। যদি পুরুষ ফুটবল নিয়ে ঠিক এ প্রশ্নগুলো করা হয়?
ফুটবলের সামান্য খোঁজ-খবর যারা রাখেন তারাও উত্তর বলে দেবেন তোতা পাখির মতো। কারণ, কোনো দেশের ফুটবলের মানদন্ড মানেই পুরুষ দলের পারফরম্যান্স। বিশ্বের অনেক ফুটবলসমৃদ্ধ দেশ, যারা নারীদের খেলা নিয়ে মাথাই ঘামায় না। পরুষ ফুটবলকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নারী ফুটবলে থাকে তাদের অংশগ্রহণের জন্যই অংশগ্রহণ।
কিন্তু বাংলাদেশ হাঁটছে উল্টো পথে। দেশের ফুটবলের অভিভাবক সংস্থা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) এখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে নারী ফুটবলে। মেয়েদের ফুটবলে সাম্প্রতিক কিছু সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। তাও বয়স ভিত্তিক টুর্নামেন্টে। পুরুষ ফুটবল রসাতলে যাওয়ায় বাফুফে এখন মেয়েদের বয়স ভিত্তিক টুর্নামেন্টের বিচ্ছিন্ন এ সাফল্যগুলোকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। এ যেন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা।
ছেলেদের ফুটবল পিছিয়ে পড়ায় প্রশ্ন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। গত রোববার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশব্যাপী শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম উদ্বোধনকালে বাফুফের কর্মকর্তাদের শেখ হাসিনা প্রশ্ন করেছেন, ‘ছেলেদের ফুটবল পিছিয়ে কেন?’
অনুষ্ঠানে বাফুফে সভাপতি কাজী মো. সালাউদ্দিন, সিনিয়র সহ-সভাপতি সালাম মুর্শেদীসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তাদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘ছেলেরা পিছিয়ে কেন? সেটাই প্রশ্ন। ফুটবলের লোক এখানে আছে, ওখানে আছে, সব জায়গায় আছে, তো ছেলেরা কেন পিছিয়ে আছে?’
মেয়েদের ফুটবলে আছে বাফুফের সর্বোচ্চ গুরুত্ব। মেয়েদের ১২ মাস ক্যাম্পে রেখে অনুশীলন করাচ্ছে বাফুফে। কোটি কোটি ঢাকা ঢালা হচ্ছে তাদের পেছনে। সেখানে ছেলেদের বয়সভিত্তিক ফুটবলাররা পাচ্ছে কম গুরুত্ব।
সোমবার সকালে ছেলেদের অনুর্ধ্ব-১৫ যে দলটি নেপাল গেলো কিশোর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে, তাদের প্রস্তুতি মাত্র আড়াই মাসের। বাফুফের সবচেয়ে বেশি বেতনের কর্মকর্তা টেকনিক্যাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক ডাইরেক্টর পল থমাস স্মলি মেয়েদের সঙ্গে সারা বছর কাজ করেন। মেয়েদের প্রতিটি সফরে নিজের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করেছেন স্মলি। অথচ ছেলেদের ফুটবলে তার টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যায় না।
যদিও বাফুফেতে তার কাজ কোনো দলের ট্রেনিং করানো নয়। এ নিয়ে বাফুফের অন্যান্য কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভ থাকলেও সভাপতি কাজী মো. সালাউদ্দিন পল স্মলিকে মেয়েদের দলের সঙ্গেই এসাইনমেন্ট দিয়ে রাখেন। ছেলেদের দলগুলো বাফুফেতে এক প্রকার উপেক্ষিত। অনেকে মজা করে বলেন, ‘ছেলেরা যেনো কাজী মো. সালাউদ্দিনের সৎ সন্তান। তাইতো মেয়েদের মুখে সোনার চামচ, ছেলেরা উপেক্ষিত।’
গত বছর থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত এএফসি অনুর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের চূড়ান্ত পর্ব সামনে রেখে নারী ফুটবলারদের চীন, জাপান, কোরিয়ায় পাঠিয়ে অনুশীলন করিয়েছে বাফুফে। অথচ ছেলেদের ক্ষেত্রে উল্টো। কোনো মতে দেড়-দুই মাস অনুশীলন করিয়েই পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে টুর্নামেন্ট খেলতে।
অনুর্ধ্ব-১৫ যে দলটি নেপাল গেলো সেই দলের খেলোয়াড় ২৩ জন, কর্মকর্তা ৯ জন; কিন্তু কিশোর ফুটবলারদের দলে কোনো ফিজিও বা ডাক্তারের জায়গা হয়নি। ছেলেরা খেলতে গিয়ে হাত ভাঙ্গুক, পা ভাঙ্গুক- তা নিয়ে কোনো ভাবনা নেই বাফুফের। এই ফুটবলাররা অনুশীলন করেছেন নীলফামারীতে। এই আড়াই মাসের মধ্যে মাত্র ঘন্টাদুয়েকের মতো কিশোরদের অনুশীলন তদারকি করেছেন পল স্মলি। অথচ মেয়েদের এমন কোনো বিদেশ সফর নেই যেখানে পল স্মলি ছিলেন না।
গত বছর সেপ্টেম্বরে কাতারের মাঠে কাতারকে ২-০ গোলে হারিয়েছিল বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৬ ফুটবল দল। তারা দেশে ফেরার পর বাফুফে সভাপতি বলেছিলেন, তিনি এই কিশোরদের হারাতে দেবেন না। তাদেরকে দীর্ঘ মেয়াদি প্রশিক্ষণ দেবেন; কিন্তু বাফুফে সভাপতির ওই ঘোষণা শুধু ‘ঘোষণা’তেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। তবে নারী ফুটবলারদের নিয়ে কাজী সালাউদ্দিন যতগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সবই বাস্তবায়ন করেছেন। কখনো কখনো যা বলেছেন, করেছেন তার চেয়েও বেশি।
মেয়েদের ফুটবলে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিলেও এখনো জাতীয় দলের সাফল্য আসেনি। এ পর্যন্ত মেয়েদের চারটি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ হয়েছে। সব আসরের চ্যাম্পিয়নই ভারত। বাংলাদেশ একবার ফাইনালে উঠতে পেরেছে মাত্র। ২০১৬ সালে ভারতের শিলিগুড়িতে হওয়া সর্বশেষ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে বাংলাদেশ ১-৩ গোলে হেরেছে ভারতের কাছে। এ বছর হওয়ার কথা মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের পঞ্চম আসর। মেয়েদের ফুটবলে বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়ে তা বোঝা যাবে এ টুর্নামেন্টেই।
আরআই/আইএইচএস/এমএস