লেভ ইয়াসিনের দেখা মিললো ঝোপঝাড়ের আড়ালে!
মস্কো এসে কী লেভ ইয়াসিনের সঙ্গে দেখা না করলে হয়? বিশ্বকাপ কাভার করতে রাশিয়ায় পা রাখার মাসপূর্তি হয়ে গেছে। কিন্তু এ শহর ও শহরে ছুটতে গিয়ে লেভকে দেখার সময়ই হয়ে উঠছিল না। অবশেষে সেন্ট পিটার্সবার্গ, কাজান, সামারার কয়েকদিনের মিশন শেষ করে ফের মস্কো পৌঁছানোর পরদিনই মনস্থির করলাম ‘আজ বিশ্বের সর্বকালের সর্বসেরা গোলরক্ষককে দর্শন করতেই হবে।’
ছুটলাম ইয়াসিনের ক্লাব ডায়নামো মস্কোতে। সেখানে গেলে নিশ্চয় দেখা মেলবে ক্যারিয়া ১৫১টি পেনাল্টি ঠেকানো এ ফুটবল নায়ককে। তো কীভাবে যাবো ডায়নামো মস্কোতে? ভুলটা হয়েছে শুরুতেই, এর কাছে ওরা কাছে জানতে চেয়েছি মস্কো ডায়নামো যাওয়ার পথ কী? কারো জবাব ‘নো ইংলিশ। মানে ইংলিশ জানেন না। কারো জবাব ‘আই অ্যাম সরি।’ মানে বলতে পারেন না।
হঠাৎই মনে হলো, আরে যাকে দেখতে যাবো তার নাম বলছি না কেন? ব্যাস, কাজ হয়ে গেলো। ‘ওহ, ইয়াসিন? গ্রেট ফুটবলার? জাস্ট এ মিনিট’-বলেই হাতের মোবাইলে গুগলে সার্স। মেট্রো ম্যাপে ডায়নামো স্টেশন দেখিয়ে একজন বলে দিলেন ‘এখানে গিয়ে প্রথমে ডানে, তারপার বামে, আবার ডানে, এরকম।’
তবে ডায়নামো স্টেশন থেকে বের হয়ে তেমন ভোগান্তি হয়নি। পাশেই বিশাল স্টেডিয়াম। চারিদিকে টিন আর লোহার জালে ঘেরা। ভেতরে শতশত শ্রমিক নানা কাজে ব্যস্ত। সামনেই রাশিয়ান অক্ষরে লেখা ডায়নামো। লেভ ইয়াসিনের ক্লাব ডায়নামো মস্কোর হোম ভেন্যু, যার নাম ‘ভিটিবি অ্যারেনা’। এ নামটি আর থাকছে না। সংস্কার শেষে স্টেডিয়াম যখন উম্মুক্ত করা হবে তখন লেখা হবে ‘লেভ ইয়াসিন স্টেডিয়াম।’ ক্লাবের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩২৬ ম্যাচ খেলা লেভের নামেই নতুন করে সাজছে ডায়নামো মস্কোর হোম ভেন্যু।
সমস্যাটা হলো সংস্কার কাজের জন্য স্টেডিয়ামের চারপাশটাই টিন আর লোহার জাল দিয়ে ঘেড়া। দূর থেকে দেখা ছাড়া উপায় নেই। চারিদিক দিয়েই হাঁটতে শুরু করলাম। সংস্কার কাজে নিয়োজিত এক বয়স্ক শ্রমিক বাইরে এসে সিগারেট ফুঁকছেন। ভাবলাম, তার কাছেই জেনে নেই এখানে ইয়াসিনের দেখা পাবো কি না। হ্যালো বলতেই শারীরিক ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন লাভ নেই, তার সঙ্গে প্যাচাল পেড়ে। বোমা মারলেও এক অক্ষর ইংরেজি বের হবে না তার মুখ দিয়ে। তারপরও পাসিবা (রাশিয়ান শব্দ। মানে ধন্যবাদ) বলতেই বুড়োর মুখে চওড়া হাসি।
কয়েকশ গজ হেঁটে আরেক গেটে দাঁড়িয়ে কাউকে খোঁজার চেষ্টা। বুঝতে পেরে এগিয়ে এলেন স্টেডিয়ামের নিরাপত্তায় নিয়োজিত এক যুবক। ওমা, তার মুখে যেন ইংরেজির খই ফুটে। মনে মনে বললাম ‘তুমি আগে কোথায় ছিলে চাঁন?’ আসার উদ্দেশ্য বললাম। অল্পতেই বুঝে গেলেন আমরা লেভ ইয়াসিনকে খুঁজছি। বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে কোথায় গিয়ে ইতিহাসের সর্বসেরা গোলরক্ষককে পাবো। যাওয়ার আগে তার আবদার মোবাইলে সেলফিবন্দি হতে হবে। কয়েকবার ক্লিক ক্লিক। একটু দূরে সিকিউরিটি বক্সে বসা সহকর্মীকে ডেকে আনলেন একই উদ্দেশ্যে। তাকে দিয়েও তোলালেন কয়েকটি ছবি। একটু সময় ব্যয় হলেও অখুশি হলাম না। তার কল্যাণে যে ইয়াসিনকে দেখার একটা সূত্র পেলাম।
বিশাল এলাকা নিয়ে স্টেডিয়াম। অর্ধেক স্টেডিয়ামের সামনে দিকে ব্যস্ত সড়ক। উল্টো দিকটায় পার্ক। গাছগাছালিতে ভরা। পাখির কিচিরমিচির ডাক আর ফুরুৎ ফুরুৎ উড়ে যাওয়ার শব্দ। বেশ ভালোই লাগছিল। মানুষকে যেন বেশি ঘুরতে না হয় সেজন্য পার্কের মাঝ দিয়ে পথ বানিয়ে দেয়া হয়েছে দুই পাশে লোহার জাল দিয়ে। চক্কর দিতে দিতে তখন প্রায় চলে এসেছি স্টেডিয়ামের সেই প্রান্তে, যেখান হাঁটার শুরু।
হঠাৎই চোখের সামনে লেভ ইয়াসিন। চিলের মতো ছোঁ মেরে বল ধরে স্থির হয়ে আছেন। ঘণ্টা দুয়েকের মিশনের পর কয়েক গজের মধ্যে মিললো ইয়াসিনকে। স্টেডিয়ামের সংস্কার কাজ চলায় ইয়াসিনের দিকে এখনো নজর দেয়া হয়নি কর্তৃপক্ষের। পুরো শরীরে জমেছে সংস্কারের ধুলোবালি। ঝোপঝাড়ের এক কোনায় গোলপোস্ট। সেখানেই ডান দিকে ঝাপিয়ে বল ধরে আছেন যুগের পর যুগ ধরে।
মোবাইলটা হাতে নিয়েই ইয়াসিনের মূর্তির পেছন থেকে ছবি তুলে নিলাম। সেলফিও হয়ে গেলো কিংবদন্তি এ গোলরক্ষকের সঙ্গে। কিন্তু কাছে যাই কী করে? পুরো জায়গাটাইতো বেড়ায় ঘেড়া। নিরাপত্তায় নিয়োজিত এক বুড়োকে বোঝালাম। ইয়াসিনের পেছন থেকে তোলা ছবি দেখিয়ে বোঝাতে চাইলাম ওর সামনে একটু যেতে চাই। না করে দিলেন। কী আর করার। টিনের বেড়া যে ভিতের ওপর লাগানো সেখানে উঠে দূর থেকে কয়েকটি ছবি নিলাম বাতাসে দেহ ভাসিয়ে ডান হাতে বল ধরে স্থির হয়ে থাকা লেভ ইয়াসিনের।
২৮ বছর আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন লেভ। কিন্তু বল ছাড়েনি তার মূর্তি। ডায়নামো মস্কোর হোম ভেন্যুতে একজন ফুটবল যোদ্ধার প্রতিকৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রাশিয়ার সবচেয়ে বড় পুরস্কার ‘অর্ডার অব লেলিন’ উপাধিতে ভূষিত হওয়া লেভ ইয়াসিন। তার এ মূর্তিটি রাশিয়ানদের প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেয় গোলপোস্টের এক ফুটবলযোদ্ধাকে।
আরআই/জেডএ