মেসির যেখানে শেষ, এমবাপের সেখানে শুরু
‘তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা’- কাজান এরেনায় ফ্রান্সের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার ম্যাচ শেষে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের এই গানটি বাজিয়ে দিলো মন্দ হতো না। ফুটবল সাম্রাজ্য শাসন তো গত ১০টি বছর করলেন লিওনেল মেসি। জীবনের হয়তো শেষ বিশ্বকাপ খেলতে এসেছিলেন এবার রাশিয়ায়। কিন্তু তরুণ এক ফরাসি ফুটবলার, কাইলিয়াম এমবাপে যেভাবে মেসির হাত থেকে সাম্রাজ্যের মুকুটটা কেড়ে নিলেন, সেটাই বড় করুণ।
ফ্রান্স ফুটবল দলটি মোটেও আর্জেন্টিনার চেয়ে অভিজ্ঞ নয়। কিন্তু তুমুল প্রতিভার স্ফুরণ ঘটিয়েছেন কোচ দিদিয়ের দেশম। কয়েকজন অভিজ্ঞ ফুটবলারের সঙ্গে একঝাঁক তরুণ প্রতিভা। প্রতিটি জায়গায় সেরা কম্বিনেশন তৈরি করেছেন তিনি। ফরাসিদের এই কম্বিনেশন ভাঙা বড় কোনো অভিজ্ঞ এবং পেশাদার দলের পক্ষে অসম্ভব। যেটা পারেনি আর্জেন্টিনার মতো দলও।
ফ্রান্সের এই নতুন বিপ্লব, তার কেন্দ্র বিন্দু কিন্তু আন্তোনিও গ্রিজম্যান নন। মাত্র ১৯ বছর ৬ মাস বয়সী এক ফুটবলার, কাইলিয়ান এমবাপে। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই ফুটবল বিশ্বের নজর কেড়ে নেন এমবাপে। ফরাসি ক্লাব মোনাকোর হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ম্যানসিটির করেন অসাধারণ গোল। ওই মৌসুমে ৪৪ ম্যাচে করেন ২৬ গোল। সারা বিশ্বের নজর তো তার ওপর এমনিতেই পড়ার কথা।
রিয়াল মাদ্রিদ যে কারণে তাকে বিশ্বের অন্যতম দামি খেলোয়াড় হিসেবে দলভুক্ত করার জন্য উঠে-পড়ে লাগে। মাত্র ১৮ বছর বয়সে রিয়ালের মতো ক্লাবের প্রস্তাবকে পাশ কাটিয়ে এমবাপে বিশ্বের দ্বিতীয় দামি খেলোয়াড় হিসেবে লোনে চলে আসেন পিএসজিতে। ফরাসি সেরা ক্লাবে নাম লিখিয়ে কিন্তু নিষ্প্রভ থাকেননি। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ভালো করতে না পারলেও দলকে ফরাসি লিগ জিতিয়েছেন।
বিশ্বকাপে এসে দিদিয়ের দেশম ১০ নম্বর জার্সিটা তুলে দিলেন এমবাপের গায়ে। দলের সম্পূর্ণ পরিকল্পনা সাজিয়ে তুললেন তাকে ঘিরে। গ্রুপ পর্বের চেয়ে নিজেকে চেনানোর বড় জায়গা হচ্ছে নকআউট পর্ব। সেখানে শুরুতেই দেখা আর্জেন্টিনা-ফ্রান্সের। কিন্তু ম্যাচের আগে কারো ধারণা ছিল না, লড়াইটা হতে পারে ৩১ বছরের এক অভিজ্ঞ এবং বিশ্বসেরা ফুটবলার মেসির সঙ্গে।
কিন্তু মাঠের খেলায় সেই পার্থক্যটা গড়ে দিলেন এমবাপে। মেসির চেয়ে অন্তত ১১-১২ বছরের ছোট। কিন্তু মাঠের খেলায় মোটেও মনে হলো না, মেসির সঙ্গে এমবাপের কোনো পার্থক্য আছে। বরং, মনে হয়েছে মেসির চেয়ে অনেক পরিণত ফুটবলার ফরাসি এই তরুণ তুর্কি। ফ্রান্সের হয়ে প্রথম গোলটা দিয়েছিলেন গ্রিজম্যান, পেনাল্টি থেকে। কিন্তু গোল আদায় করার মূল কারিগর ছিলেন এমবাপে। তাকে আটকাতে গিয়েই ফাউল করে বসেন মার্কাস রোহো। এরপর করলেন আরও দুটি গোল। আর্জেন্টিনার ডিফেন্স শুধু তার পেছনে দৌড়েছে। তাকে ধরার কিংবা ছোঁয়ার সুযোগ হয়নি।
যেখানে মেসি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন, সতীর্থদের বল আদান-প্রদান। নিজের কাছে কোনো বল পাচ্ছিলেন না, সেখানে কাইলিয়ান এমবাপে একের পর এক ত্রাস সৃষ্টি করছিলেন আর্জেন্টিনার রক্ষণভাগে। যেখানে মেসির মতো ফুটবলারের কাছ থেকে অতি মানবীয় পারফরম্যান্স আশা করেছিল সবাই, সেখানে এমবাপেই উল্টো এমন পারফরম্যান্স প্রদর্শণ করলেন, যেটা মানুষের চোখে লেগে থাকার মতো।
বিশ্বকাপ সব সময় তারকার জন্ম দেয়। অন্ধকার থেকে কাউকে তুলে আনে পাদপ্রদীপের আলোয়। আবার কারো কাছ থেকে কেড়ে নেয় সব আলো। বানিয়ে দেয় ভিলেন। ব্যর্থতার গ্লানিতে দেয় ভরিয়ে। সারা বিশ্বের সমস্ত ফুটবলপ্রেমীর মনযোগ কেড়ে নিয়ে বিশ্বকাপে খেলতে এসে অনেকাংশে ঘৃণা কুড়িয়েই বিদায় নেয়। ঘৃণা না হোক, মানুষের সহানুভূতি সঙ্গী করে বিদায় নেয়।
কাইলিয়ান এমবাপে আর লিওনেল মেসির ঠিক এই অবস্থাই হলো। ক্যারিয়ার শুরু হলো মাত্র এমবাপের। তারকা খ্যাতি পেতে শুরু করেছেন, সদ্য সমাপ্ত মৌসুমের শুরু থেকে। আর লিওনেল মেসি পৃথিবীর নয়, ভিনগ্রহের কোনো ফুটবলারের খ্যাতি পাওয়া। ৫বার টানা বিশ্বসেরা কিংবা ব্যালন ডি’অর জেতা।
নিজের ক্লাব বার্সেলোনার হয়ে একের পর এক ট্রফি জয়ের পর তার কাছ থেকে বিশ্বকাপে নিজের দেশের হয়ে অসাধারণ পারফরম্যান্সই প্রত্যাশা করেছিল সবাই। কিন্তু মেসি মাঠের মধ্যে মূর্তির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলেন। যে ক’বার বল পেয়েছেন, একবারও ভাঙতে পারেননি প্রতিপক্ষের ডিফেন্স। গোল লক্ষ্যে একটি দৃষ্টি নন্দন শটও নিতে পারেননি।
অথচ, ক্যারিয়ারের শুরুতে আলোটা নিজের ওপর কীভাবে টেনে নিলেন এমবাপে! বড় ম্যাচের বড় তারকা তিনি, সেটা প্রমাণ করলেন মেসিদের ব্যর্থতার দিনে। আর্জেন্টিনার মতো দলের বিপক্ষে জোড়া গোল এবং অন্য গোলে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার কৃতিত্ব অবশ্যই মেসির চেয়ে অনেক বড়। এমবাপের এই সাফল্যই হয়তো ফ্রান্সকে ১৯৯৮ সালের পর আবারও সাফল্যের ভেলায় ভাসিয়ে দিতে পারে।
ফ্রান্সের কাছে হেরে বিদায় আর্জেন্টিনার। সে সঙ্গে মেসি যুগেরও হয়তো শেষ। মেসি হয়তো বলে রেখেছেন, বিশ্বকাপ না জিতে তিনি অবসর নেবেন না। কিন্তু ২০২২ বিশ্বকাপে তার বয়স থাকবে ৩৫। এখনকার ফর্ম এবং স্ট্যামিনা ঠিক থাকবে কি-না সন্দেহ। আর্জেন্টিনা দলটির অবস্থাও বা কি দাঁড়ায়, সেটা বলা মুস্কিল। এমন পরিস্থিতিতে, অধিকাংশ ফুটবলবোদ্ধার মতো, মেসি নিজের শেষ বিশ্বকাপ খেলে ফেলেছেন। ক্যারিয়ারে চারটা বিশ্বকাপ খেলেও সাফল্যের খাতা শূন্য। অন্যদিকে, মেসির শেষ বিশ্বকাপের ম্যাচেই ক্যারিয়ারের উজ্জ্বল সম্ভাবনা শুরু হলো কাইলিয়ান এমবাপের। হয়তো বা আগামী দিনে মেসির জায়গাটা দখলে চলে আসবে ফরাসি এই তারকার কাছেই।
আইএইচএস/এমএস