জন্মভূমি ফ্রান্সের বিপক্ষে আর্জেন্টিনাকে জেতাতে পারবেন হিগুয়াইন?
নিজ দেশের হয়ে বিশ্বকাপ খেলা যে কোনো ফুটবলারের জন্যেই স্বপ্নের মত। মূলত জাতীয় দলের হয়ে খেলার পরেই আসে বিশ্বকাপে খেলার প্রশ্ন। কিন্তু শত কাঠখড় পেরিয়ে অনেকেরই সম্ভব হয় না বিশ্ব ফুটবলের মঞ্চকে মাতানোর। সেদিক দিয়ে গঞ্জালো হিগুয়াইন একটু বেশি ভাগ্যবান বটে। গায়ে চাপিয়েছেন ঐতিহ্যবাহী আর্জেন্টিনার আকাশী-নীল জার্সি। খেলেছেন তিনটি বিশ্বকাপও। কিন্তু এবার নিজেকেই নিজে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হচ্ছে তাকে। কেননা, নিজ জন্মভূমির বিপক্ষেই বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলতে নামছেন তিনি।
স্পেনের বর্তমান বিশ্বকাপ স্কোয়াডের ডিয়েগো কস্তার কথা আমরা সবাই জানি। ব্রাজিলের ডাক উপেক্ষা করে যোগ দেন স্পেন দলে। বছর বিশেক আগের ফ্রান্সের একমাত্র বিশ্বকাপ জয়ী দলের নায়ক জিনেদিন জিদানের কথাই ধরা যাক না। বাবা-মা আলজেরিয়ার হলেও ফ্রান্সের হয়ে খেলে জিতেছেন বিশ্বকাপ। যদিও জিদানের সৌভাগ্য হয়নি আলজেরিয়ার বিপক্ষে কোনো প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলার। তখন জিদান কী করতেন মাঠে সেটা অবশ্য অজানাই রয়ে গেছে বিশ্ব মানুষের। কিন্তু হিগুয়াইনের সামনে এবার সে রকমই অবস্থা। নিজ জন্মভূমি ফ্রান্সের বিপক্ষে আসলেই মন রাঙিয়ে খেলতে পারবেন হিগুয়াইন? কীভাবে গায়ে চাপালেন আর্জেন্টিনার জার্সি?
একটু অতীতে ফিরে তাকাই। ১৯৮৭ সালের ফ্রান্সের ব্রেস্ট শহরে জন্ম গঞ্জালো হিগুয়াইনের। তার বাবা জর্জ হিগুয়াইনও ছিলেন আর্জেন্টিনার তখনকার সময়ের ভালো মানের একজন সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার। ১৯৮১-৮৭ সাল পর্যন্ত আর্জেন্টিনার ঐতিহ্যবাহী ক্লাব রিভার প্লেট ও বোকা জুনিয়র্সের পাশাপাশি সান লরেঞ্জোতে খেলে কাটিয়েছেন। ১৯৮৭ সালে চলে যান ফ্রান্সের স্টেড ব্রেস্টোইসে। সেখানেই ১৯৮৭ সালের ১০ ডিসেম্বর জন্ম নেন গঞ্জালো হিগুয়াইন।
হিগুয়াইনের মা ন্যান্সি জাকারিয়াস আঁকাআঁকিতে বেশ পটু। জীবনের অবসর সময়ের অনেকটা এগুলো করেই পার করেছেন তিনি। তার এমন শিল্পী মনোভাব পরিবারে অনেক শান্তি বয়ে আনতো। তিনি নিজেই তার সন্তান হিগুয়াইনের অনেক ছবি এঁকেছেন। চার ভাইয়ের ভেতর গঞ্জালো হিগুয়াইন ছিলেন তৃতীয়।
ব্রেস্ট শহরে জন্ম নিলেও এখানে ছিলেন মাত্র ১০ মাস। এই সময়টায় তার পক্ষে সম্ভব হয়নি ফ্রেঞ্চ ভাষা শেখার। কিন্তু ফ্রান্সে জন্ম হওয়ায় তার সেখানের নাগরিকত্বও ছিল। আর্জেন্টিনায় চলে আসায় এখানেই বড় হতে থাকেন। পেয়ে যান আর্জেন্টিনার নাগরিকত্ব সার্টিফিকেটও। তারপরই আসে তার জীবনের অন্যতম কঠিন সময়।
২০০৬ সালের নভেম্বর মাসের ১০ তারিখ হঠাৎ করেই তখনকার ফ্রান্স কোচ রেমন্ড ডোমেনেখ প্রীতি ম্যাচে গ্রীসের মুখোমুখি হওয়ার জন্য হিগুয়াইনকে ২৪ সদস্যের ফ্রান্স দলে ডাকেন। তখনও হিগুয়াইন রিভার প্লেট ক্লাবের হয়ে বিশ্ব মাতাচ্ছিলেন। ফ্রান্সও তখন চাচ্ছিল ১৮ বছর বয়সী হিগুয়াইনকে দ্রুতই তাদের জার্সি চাপাতে। কিন্তু ডোমেনেখকে অবাক করে দেন ‘এল পিপিতা’।
ফ্রান্সের জাতীয় দলের হয়ে খেলার ডাককে ফিরিয়ে দেন তিনি। এটাতে বেশ হতবম্ব হয়ে পড়েন ডোমেনেখ। তখন এক প্রতিক্রিয়ান ডোমেনেখ বলেছিলেন, ‘আমি অনেক অবাক হয়েছি তার সিদ্ধান্তে। যদিও এটার ব্যাপারে আমার তেমন কোন প্রতিক্রিয়া নেই। তবে তার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাই। প্রত্যেক ভিনদেশী ফ্রেঞ্চ খেলোয়াড়ই যোগ্যতা রাখে দেশের হয়ে খেলার সে অন্য দেশের হোক বা না হোক।’
হিগুয়াইনের বাবা রেডিও দেল প্লাতাতে পরিষ্কার করেন, ‘আর্জেন্টিনার জার্সি অন্য সবকিছুর থেকে বিশেষ কিছু তার জন্য। গঞ্জালো চাচ্ছে না এখান থেকে অন্য কোথাও যেতে। তার অন্য অনেক চিন্তাভাবনা রয়েছে। এখানকার ঘরবাড়ি তার অনেক পরিচিত।’
ফ্রান্সের ডাক তো ফিরিয়ে দিলেন এবার আকাশী-সাদা জার্সি গায়ে চাপানোর সময়। ২০০৮ সালে প্রথমবারের মত আর্জেন্টিনার অলিম্পিক স্কোয়াডে ডাক পান এই ফুটবলার। ফুটবল বিশ্বকাপে মাত্র তিনজন রয়েছেন যারা ভিন্ন দেশে জন্ম নিয়েও আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে মাঠে নেমেছেন। পেদ্রো আরিকো সুয়ারেজ ও কন্সট্যান্টিনো উরবিয়েতা সোসার পর এসেছেন হিগুয়াইন।
সব অতীতকে পেছনে ফেলে এবার প্রথমবারের মত নিজ জন্মভূমির বিপক্ষে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে জাতীয় দলের হয়ে খেলতে নামবেন হিগুয়াইন। টুর্নামেন্টে এখন পর্যন্ত আশানরূপ পারফরম্যান্স দেখাতে না পারলেও এই জুভেন্টাস তারকার উপর ভরসা রাখছেন কোচ। গত বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে বেলজিয়ামকে হারানোর ম্যাচে একমাত্র গোলটি যে এসেছিল তার পা থেকেই। কিন্তু এবার সমীকরণ ভিন্ন, নিজ জন্মভূমির বিপক্ষে হিগুয়াইন কী পারবেন জ্বলে উঠতে? এমন প্রশ্ন আজ হাজারো আর্জেন্টাইন ভক্তদের মাঝে।
আরআর/জেএইচ