মরণকামড় দিতে প্রস্তুত জার্মান যোদ্ধারা
সামনে দক্ষিণ কোরিয়া। মোটামুটি গ্রুপের দুটি কঠিন ম্যাচ পার করে এসেছে বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানি। বিদায় নিতে নিতে শেষ পর্যন্ত বেঁচে রয়েছে তাদের আশা। বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার জন্য, সেই বেঁচে থাকা আশা নিয়েই আজ দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে মরণ কামড় দিতে প্রস্তুত জার্মান যোদ্ধারা। কাজান এরেনায় তায়েজুক যোদ্ধাদের (দক্ষিণ কোলিয়ান) মুখোমুখি হচ্ছে জার্মান যোদ্ধারা।
যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জোয়াকিম লো। তিনি ছক কষছেন। আক্রমণের নানা গলি-ঘুপচি বের করছেন। কৌশল নির্ধারণ করছেন। কে আক্রমণে গেলে কে রক্ষণ সামলাবে। কখন অলআউট ফুটবল খেলবে, কখন নেমে আসতে হবে, আবার একটা পরিখা তৈরি করে কখন প্রতিপক্ষকে আক্রমণের সুযোগ তৈরি করে দিয়ে সেই পরিখায় তাদের আটকে রেখে উল্টো আক্রমণে উঠে ফল আদায় করে নেবে- সব কৌশলই দক্ষ সেনাপতির মত এঁকে যাচ্ছেন লো। সেই ২০০৬ সাল থেকে। বিশ্বযুদ্ধে তার আঁকা যুদ্ধ ছকেই তো, বিশ্বজয় করেছে জার্মানরা।
এবার হয়তো মাঠের সৈনিকে অনেক পরিবর্তন এসেছে; কিন্তু মাথা তো একটাই। লো। তার মাথা থেকে বের হচ্ছে নিত্য-নতুন সব কৌশল, পরিকল্পনা। যার ওপর ভর করে একেবারে খাদের কিনারা থেকে উঠে এসেছে জার্মানি। মেক্সিকোর কাছে ১-০ গোলে হারের পর, সুইডেনের বিপক্ষে ছিল বাঁচা-মরার লড়াই। সেই লড়াইয়ে বিদায়ের শঙ্কা জেগে উঠেছিল ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের। সুইডিশরা তাদের রক্ষণ দেয়াল ভেদ করে চূর্ণ করে দিয়েছিল। গোল করে জার্মানদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
মার্কো রেউসের গোলে সমতায় ফেরার পরও শঙ্কা কাটছিল না। নির্ধারিত ৯০ মিনিট শেষ। অতিরিক্ত ৫ মিনিটের খেলাও প্রায় শেষ হতে যাচ্ছিল। ম্যাচের তখন মাত্র ৩০ সেকেন্ড বাকি। তখনই সুইডেনের ডি বক্সের বাম পাশে ফ্রি কিক পায় জার্মানি। শেষ সুযোগ। এটা মিস হলেই জার্মানির বিশ্বকাপ মিস। শট নিতে আসেন টনি ক্রুস। রিয়াল মাদ্রিদে এমন অনেক শটই নেন তিনি। কিন্তু সুইডেনের বিপক্ষে এই শট নেয়ার আগে দেখলেন সামনে মানবপ্রাচীর। একে ভেদ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
কৌশলের আশ্রয় নিলেন ক্রুস। কৌশলের অংশ হিসেবে সামনে দাঁড় করালেন রেউসকে। শট নিতে গিয়ে সেই কৌশলের আশ্রয় নিয়েই রেউসকে আলতো টোকায় বল দিলেন ক্রুস। রেউস সেটি থামিয়ে দিলেন। এবার আসল শটটি নিলেন ক্রুস। বোকা বনে গেলো সুইডেনের পার্ক করা বাস ডিফেন্স। মানবপ্রাচীর তৈরি করেও আটকানো গেল না।
পুরো ৯৫ মিনিটে যাদের আটকে রাখা গেলো, তারা কি-না শেষ মুহূর্তের এক কৌশলের কাছেই পরাজিত! গোলের পরপরই শেষ বাঁশি বাজালেন রেফারি। জার্মানি জিতে গেলো ২-১ গোলে। জিতে গেলো নয়, বেঁচে থাকলো জার্মানদের স্বপ্ন, বেঁচে থাকলো বিশ্বকাপে নিজেদের সবচেয়ে বড় লজ্জায় পড়া থেকে। ১৯৩৮ সালের পর থেকে যে আর কখনও গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়েনি জার্মানি!
টনি ক্রুসের ওই এক গোলই পাল্টে দিয়েছে পুরো সোশ্যাল নেটওয়ার্কের চেহারা। কয়েক মিনিটে হাজার হাজার বার শেয়ার করা হয়ে গেলো ক্রুসের ওই গোলের ভিডিও ক্লিপ। আবার ওই এক গোলই পাল্টে দিল পুরো একটা দলের মানসিকতা। টনি ক্রুসের ম্যাচ জেতানো ওই একটি গোল শুধু জার্মানিকে বিশ্বকাপে টিকিয়েই রাখেনি, যেন জাগিয়ে তুলেছে পুরো একটা জাতিকেই।
ছিটকে যাওয়ার শঙ্কা যদিও পুরোপুরি কাটেনি। গ্রুপে শেষ দুই ম্যাচের ফলের নানা রকম সমীকরণ পাল্টে দিতে পারে অনেক হিসাব-নিকাশ। তবুও জার্মানি যেটুকু বিশ্বকাপে টিকে আছে, তা ওই ‘ক্রুস মিসাইলে’র ধাক্কার জোরেই।
ক্রুস যে বুট পরে বাঁক খাওয়ানো শট নিয়েছিলেন, সেটিও এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনার বিষয়। এডিডাস এখন সেই বুট বিক্রিই বন্ধ করে দিয়েছে। ২০১৩-১৪ মৌসুমে এডিপিওর ইলেভেন প্রো নামে এই বুট বাজারে এনেছিল এডিডাস। পাঁচ বছর একটা বুটের জন্য অনেকটা সময়। দু’বছর আগেই এই বুট তৈরি বন্ধ করে দিয়েছে ক্রীড়া সামগ্রি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানটি। ক্রুস এই সাদা বুট ছাড়া খেলেন না। তাই গত দু’বছর রীতিমতো স্পেশ্যাল অর্ডার দিয়ে এই ভিন্টেজ বুট বানিয়ে আনেন ক্রুস। সুইডেন ম্যাচের পর সেই এডিপিওর বুট যেন আরও তরতাজা।
ক্রুসের গোল যদি জোয়াকিম লো-র জন্য চরম তৃপ্তির হয়, তা হলে টেনশেনের জায়গা তাদের ডিপ ডিফেন্স। গতবারের চ্যাম্পিয়ন এবং রানার্স আপদের একটা ব্যাপারে মিল বেশ দারুণ। আর্জেন্টিনার মতো জার্মানিরও সেন্ট্রাল ডিফেন্সে কোন জুটি খেলবে তা কেউ জানে না। প্রথম দুই ম্যাচে দুই আলাদা জুটি খেলেছে জার্মানির হয়ে। আজ গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে নতুন জুটি দেখা যাবে। কারণ হচ্ছে, লালকার্ড।
এর জন্য অবশ্য দায়ী জেরোম বোয়ার্টে। সুইডেনের বিপক্ষে ম্যাচে লাল কার্ড দেখে এক ম্যাচ নিষিদ্ধ। ম্যাটস হামেলস সুস্থ না হয়ে উঠলে বেশ চাপেই পড়তে হতো জোয়াকিম লো’কে। রোববার থেকে পুরো দমে প্র্যাক্টিস শুরু করেছেন হামেলস। তার সঙ্গী কে হবেন, এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য সহজে মিলছে না। সুইডেন ম্যাচে আন্তোনিও রুডিগার খেলেছেন; কিন্তু কোরিয়ার বিরুদ্ধে রুডিগার নাও খেলতে পারেন।
জার্মান পত্রিকাগুলোতে একজনের নাম পাওয়া যাচ্ছে- নিকলাস শুলে। ২২ বছরের এই ডিফেন্ডার দারুণ প্রতিভাবান। তবে বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলেছিলেন। এখনও অভিজ্ঞতা খুব বেশি নয়। তবুও রুডিগার সুইডেন ম্যাচে আহামরি কিছু খেলতে পারেননি। তাই শুলের নাম উঠে আসছে হামেলসের সঙ্গী হিসেবে।
তবে ক্রুসের সেই গোলের এমন মহিমা যে ডিফেন্ডার হামেলসও তেতে উঠেছেন। ক্রুসের গোল প্রসঙ্গে হামেলসের মন্তব্য, ‘এই রকম একটা গোল একটা টুর্নামেন্টে বিরাট এক মুহূর্ত তৈরি করে। এর থেকে অনেকটা আত্মবিশ্বাস পাওয়া যায়। তবে আমরা যদি বুধবার কোরিয়াকে হারাতে না পারি তা হলে সব অর্থহীন হয়ে যাবে।’
সুইডেন ম্যাচের আর এক স্কোরার মার্কো রেউস আবার গলা মিলিয়েছেন ক্রুসের বক্তব্যের সঙ্গে। তাকে বলতে শোনা গেছে, ‘জার্মানিতে অনেকে এমন আছেন, যারা মুখিয়ে ছিলেন আমাদের বিদায় দেখতে; কিন্তু আমার মনে হয়, আমরা দরুণ টিম স্পিরিট দেখিয়েছি।’ রেউসের মন্তব্য, ‘প্রথম ম্যাচের হারটা আমাদের খুব কষ্ট করে গিলতে হয়েছিল; কিন্তু এখন আমাদের কাছে সব অতীত। আমরা এখন কোরিয়া ম্যাচ জিতে নক আউটে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে।’
মেসুত ওজিলের সমালোচনার জবাবও দিয়েছেন রেউস। তার কথায়, ‘মেসুত বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার। আমাদের জন্য দারুণ গুরুত্বপূর্ণ। আমি নিশ্চিত ওকে আবার এই বিশ্বকাপে স্বমহিমায় দেখব।’
ওজিলের এই ম্যাচে সুযোগ পাওয়া নিশ্চিত নয়। থমাস মুলার এখনও সেই ফর্মে নেই। সবার নজর তাই ঘুরে ফিরে ক্রুসের দিকেই। যিনি হুঙ্কার দিয়েই রেখেছেন, ‘দম না থাকলে এভাবে ফিরে আসা যায় না।’
আইএইচএস/আরআইপি