বিশ্বকাপে পেনাল্টি মিস করেছিলেন ম্যারাডোনা-জিকো-প্ল্যাতিনিও
প্রজন্ম প্রজন্মকে সমর্থন করে, টানে। এখনকার প্রজন্ম বিশেষ করে কিশোর, যুবা ও তরুণরা লিওনেল মেসি-ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো আর নেইমার ভক্ত। তাদের চোখে দেখা এই তিন তারকাই তারকাদের সেরা। তাই বিশ্বের সব দেশেরই বর্তমান প্রজন্মের ফার্স্ট চয়েজ মেসি, রোনালদো আর নেইমার। এই তিন জনের মধ্যে আবার মেসি-রোনালদোর জনপ্রিয়তা বেশি। তাদের ফ্যান-ফলোয়ারও সর্বাধিক। তাদের নিয়েই যত কথা। বিশ্বকাপের মূল ফোকাসটাও তাদের উপরই।
মেসি-রোনালদোর সাফল্য, ব্যর্থতা, সৃষ্টি ও সৃজনশীলতা এবং গোল করার দক্ষতা নিয়ে যত কথা হবে; আর কোন ফুটবলারকে নিয়ে অত কথা হবে না। হচ্ছেও না। এই এখন যেমন লিওনেল মেসি আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পেনাল্টি মিস নিয়ে যত কথা। যেহেতু তারাই সময়ের সেরা তারকা, বিশ্বের সবচেয়ে নামি দামি ফুটবলার, তাই তাদের ব্যর্থতা নিয়েও রাজ্যের কথা বার্তা।
অনেকের কাছেই এটা বিস্ময়। মেসির পর রোনালদোও পেনাল্টি মিস করেছেন! কারো কারো ঘোর কাটছে না কিছুতেই। কেউ কেউ বলছেন, এ কি স্বপ্ন, জাদু নাকি মায়া! ফুটবলে সেরাদের সেরা দুই তারকা একই আসরে পেনাল্টি মিস করতে পারেন! ভক্ত-অনুরাগিদের বড় অংশর যেন তা বিশ্বাস করতেই রাজ্যের দ্বিধা।
তবে যারা মেসি আর রোনালদোর পেনাল্টি মিস দেখে বিস্মিত, তাদের জন্য কয়েকটি বড় তথ্য উপাত্ত আছে। ইতিহাস ও পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, শুধু বর্তমান সময়ের দুই সুপারস্টার মেসি আর রোনালদোই নন, সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার এবং বিশ্বের এখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধেক ফুটবল অনুরাগির প্রাণের ফুটবলার স্বপ্নের তারকা ডিয়াগো ম্যারাডোনারও বিশ্বকাপে পেনাল্টি মিস করার রেকর্ড আছে।
আর্জেন্টিনা তথা বিশ্ব ফুটবলের রাজা ধীরাজ ম্যারাডোনা একা নন। সর্বকালের সেরা ফুটবলার ফুটবল সম্রাট ব্রাজিলের ‘কালো মানিক’ পেলের পর এখন পর্যন্ত যাকে ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় ফুটবলার ভাবা হয়, সেই ‘সাদা পেলে’ খ্যাত জিকোও ১৯৮৬ সালে ফ্রান্সের সাথে বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে পেনাল্টি মিস করে ইতিহাসে খলনায়ক বনে গেছেন।
এখানেই শেষ নয়। ফ্রান্সের ফুটবল ইতিহাসের সফলতম সেনাপতি জিনেদিন জিদানের পূর্বসূরী এবং ফরাসী ফুটবলকে জাগানোর অন্যতম পথিকৃত মিশেল প্ল্যাতিনি আর ইতালির ফুটবলের ‘সোনার ছেলে’ রবার্তো ব্যাজিওও কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবলে পেনাল্টি শ্যুট আউট থেকে গোল করতে পারেননি। না পারার অতীত আছে ইংলিশ ফুটবলের সব সময়ের অন্যতম সেরা ডেভিড ব্যাকহ্যামেরও। বিশ্বকাপে ইতালির বিপক্ষে পেনাল্টি মিস করে দর্শক-সমর্থকদের বিরাগভাজন হয়েছেন তিনি।
ঐ যে প্রতিবেদনের শুরুতে বলা আছে, প্রজন্ম নিজ নিজ প্রজন্মকে টানে। বড় করে দেখে। এখনকার প্রজন্মর কাছে যেমন মেসি-রোনালদো অনেক বড়। সেরাদের সেরা। তাদের ফার্স্ট চয়েজ। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, বিশ্ব ফুটবলে মেসি আর রোনালদোই শেষ কথা নয়। হয়ত বর্তমান সময়ে যারা খেলছেন, তাদের মধ্যে স্কিল, টেকনিক ও দক্ষতা- মুন্সিয়ানায় সবার ওপরে। তাই বলে মেসি-রোনালদো নিশ্চয়ই বিশ্ব ফুটবল ইতিহাসের সব সময়ের সেরা তারকা বা সবচেয়ে মেধাবী ফুটবলার নন। আগে ও পরে ধরলে আরও বেশ কিছু নাম উঠে আসে। আসবেই।
কাকতালীয়ভাবে বিশ্বকাপে পেনাল্টি শ্যুট আউটে গোল করতে না পারাদের যে তালিকা ওপরে দেয়া হলো, সেখানে যাদের নাম আছে, তাদের মধ্যে ম্যারাডোনা অতি অবশ্যই ‘গ্রেটেস্ট অফ অল টাইম’। তাই বলে জিকো, সক্রেটিস, প্ল্যাতিনি, রবার্তো ব্যাজিও'ও কিন্তু কম নন। তাদের সময়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা, নামি ও দামি ফুটবলার ছিলেন।
এর মধ্যে ১৯৮৬‘ র বিশ্বকাপ শুরুর আগে ম্যারাডোনার পাশাপাশি সর্বাধিক উচ্চারিত নামই ছিলোর ব্রাজিলের তখনকার ১০ নম্বর জার্সিধারী জিকোর। একই আসরে ফ্রান্সের মূল চালিকাশক্তি মিশেল প্ল্যাতিনিও ছিলেন ৮০ ‘র দশকে বিশ্বসেরাদের একজন। আর রবার্তো ব্যাজিও এবং ডেভিড বেকহ্যামের পরিচয়ও সেভাবে দেয়ার কিছু নেই। রবার্তো ব্যাজিও ইতালিয়ান ফুটবল ইতিহাসের সময়ের অন্যতম সেরা ও মেধাবী ফরোয়ার্ড। ডেভিড বেকহ্যাম ইংলিশ ফুটবলের গত তিন যুগের অন্যতম সেরা ফুটবলার।
কিন্তু কঠিন সত্য হলো, তারাও পেনাল্টি মিস করেছেন। তাও বিশ্বকাপের মত বড় মঞ্চে। তবে পেনাল্টি মিস মানেই কিন্তু নায়ক থেকে খলনায়ক বনে যাওয়া নয়। এটা নির্ভর করে ম্যাচ সিনারিও মানে খেলার চালচিত্র ও ফলের ওপর।
৯০ মিনিটের খেলায় একটি পেনাল্টিই যে সব, তা নয়। কখনো কখনো ঐ পেনাল্টি গোলই ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারক। দেখা যায় , পেনাল্টি গোলেই জয় ধরা দেয়। আবার কোন সময় একটি পেনাল্টি মিস ম্যাচ হাতছাড়ার মূল কারন হয়ে দেখা দেয়। আর টাইব্রেকারে পেনাল্টি মিস করলে তো কথাই নেই। দল জিতলেও বিজয়ী দলের কেউ পেনাল্টি থেকে গোল করতে পারেননি,এমন ঘটনাও কিন্তু বিশ্বকাপ ইতিহাসে আছে।
কাজেই পরিবেশ-প্রেক্ষাপট আর দলের ভাগ্য নির্ধারনী পেনাল্টি মিসটাই বিশ্বকাপে বড় হয়ে দেখা দেয়। সেই হিসেবে গত তিন যুগের বেশি সময়ে বিশ্বকাপে পেনাল্টি থেকে গোল করতে না পারার অন্যতম শীর্ষ ঘটনা দুটি।
১. ১৯৮৬ সালে ফ্রান্সের বিপক্ষে ব্রাজিলের সেন্টার ফরোয়ার্ড জিকোর পেনাল্টি মিস আর
২. ১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপ ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে ইতালির স্ট্রাইকার রবার্তো বাজিওর পেনাল্টি বাইরে মারা।
এ দুটি ব্যর্থতাই বিশ্বকাপ ইতিহাসে বড় ব্যর্থতার নজির বলে গণ্য। কেন?
১৯৮৬ সালের ২১ জুন মেক্সিকোর জালিসকো স্টেডিয়ামে ব্রাজিল-ফ্রান্স কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ ১-১ গোলে সমতা থাকা অবস্থায় পেনাল্টি মিস করেন জিকো। ঐ গোল হয়ে গেলে ব্রাজিল ২-১ ‘এ এগিয়ে যেতে পারতো। তখন খেলার ফল ভিন্ন হতে পারতো।
অথচ ঐ ম্যাচ পরে ১-১ ‘এ অমীমাংসিত থাকে। নির্ধারিত ৯০ আর অতিরিক্ত ৩০ মিনিটেও ১-১ সমতা থাকায় ফল নিষ্পত্তির জন্য গড়ায় টাইব্রেকারে। ট্রাইব্রেকারই জিকোর ভুলটাকে দুঃস্মৃতি বানিয়ে দেয় সারাজীবনের জন্য। ফরাসিরা জিতে যায় ৪-৩ গোলে।
অথচ নির্ধারিত সময়ের ৯০ মিনিটেই এগিয়ে যেতে পারতো ব্রাজিল। কিন্তু ব্রাজিলের স্বপ্ন ভেঙ্গে দেন ফরাসি গোলকিপার জোয়েল ব্যাটস । পেনাল্টি পাবার মিনিট পাঁচেক আগে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে নামা জিকোর ডান পায়ের নিচু শট বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে আটকে দেন ফরাসি গোলকিপার। কাকতালীয়ভাবে ঐ ম্যাচের টাইব্রেকারে ফ্রান্স অধিনায়ক মিশেল প্ল্যাতিনিই একমাত্র ফরাসি ফুটবলার, যিনি পাঁচ পেনাল্টি শ্যুট আউট থেকে গোল করতে ব্যর্থ হন।
টাইব্রেকারে ব্রাজিলের বিপক্ষে প্লাতিনির ডান পায়ের উঁচু ড্রাইভ প্রথম পোষ্ট আর ক্রস পিচের জয়েন্টের অন্তত দুই তিন ফুট ঠিক ওপর দিয়ে বাইরে চলে যায়। কিন্তু তার দলের বাকি সবাই পেনাল্টি শ্যুট আউটে গোল করায় ফরাসিরা বিজয় আনন্দে মেতে ওঠে। প্ল্যাতিনির পেনাল্টি মিসের কোন নেতিবাচক প্রভাবই পড়েনি।
কিন্তু একটা দারুণ তথ্য আছে। তা হলো, যে জিকো বদলি খেলোয়ড় হিসেবে মাঠে নেমে কয়েক মিনিটের মধ্যে পেনাল্টি মিস করে পরবর্তীতে খলনায়ক বনে যান, সেই জিকো কিন্তু টাইব্রেকারে ঠিক গোল করেছিলেন। টাইব্রেকারে ব্রাজিলের পাঁচ পেনাল্টি শ্যুট আউটের দ্বিতীয় শ্যুটার ছিলেন জিকো। এবার তিনি ঠিকই গোল করেন। জিকোর সাথে উইং ব্যাক এ্যালেমাও আর ডিফেন্ডার ব্র্যাঙ্কোও গোল করেন। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। তার সঙ্গী আরেক নামি তারকা ও ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসের সব সময়ের অন্যতম সৃজনশীল ও সৃষ্টিশীল মিড ফিল্ডার সক্রেটিস টাইব্রেকারে গোল করতে ব্যর্থ হন।
এমনিতেই দু থেকে তিন পা দৌঁড়ে প্রথম বা দূরের পোস্টের কোন ঘেষে প্লেসিংয়ে গোল করায় যার ছিল বিশেষ সুখ্যাতি, সেই সক্রেটিস ফরাসি গোলকিপারের ডান দিকে প্লেস করেও ব্যর্থ হন। গোলকিপার ডানে ঝাঁপিয়ে পড়ে তা রুখে দেন। সক্রেটিসের সাথে গোল করতে পারেননি আরেক ব্রাজিলিয়ান জুলিও সিজারও। অথচ ব্রাজিল যে ম্যাচ জিতে সেরা আটে জায়গা করে নিয়েছিল, সেই কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিতের ম্যাচ অর্থাৎ সেরা ১৬ দলের লড়াইয়ে পোল্যান্ডকে ৪- ০ গোলে হারানোর ম্যাচে প্রথম গোলটি করেছিলেন সক্রেটিস। এবং সেটা পেনাল্টি থেকেই। তারপরও যেহেতু ব্রাজিল ম্যাচ হারে, তাই টাইব্রেকারে জিকো গোল করেও ইতিহাসে ‘ভিলেন’ হিসেবে নাম লিখিয়ে ফেলেন। হায়রে কপাল!
এছাড়া গত দুই যুগের মধ্যে বিশ্বকাপ ফুটবল ইতিহাসে আরেক স্মরণীয় পেনাল্টি মিস হচ্ছে রবার্তো ব্যাজিওর। ইতালির সোনার ছেলে ও আজ্জুরিদের সব সময়ের অন্যতম কুশলী, মেধাবী ও নামি তারকা রবার্তো ব্যাজিও ১৯৯৪ সালের ১৭ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার রোজবোল স্টেডিয়ামে ৯৪ হাজার ১২৪ জন দর্শকের উপস্থিতিতে বিশ্বকাপ ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে টাইব্রকারে দলের পঞ্চম তথা শেষ শটে গোল করতে ব্যর্থ হন।
আর তারই সাথে সাথে ইতালির পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যায়। ঐ পেনাল্টি শ্যুট আউটের স্কোর লাইন ছিল ব্রাজিল ৩, ইতালি ২। রবার্তো ব্যাজিওর শট লক্ষ্য ভেদ না করে বাইরে চলে গেলে স্কোরলাইন অপরিবর্তিত থাকে। শেষ পর্যন্ত ঐ টাইব্রেকারের শ্যুট আউটে ৩- ২ গোলে জিতেই আবার বিশ্বসেরা হয় পেলের দেশ।
রবার্তো ব্যাজিওর শট প্রথম পোস্ট ও ক্রস পিচের সংযোগস্থলের ওপর দিয়ে বাইরে চলে গেলে উল্লাসিত হয়ে ওঠে ব্রাজিল শিবির। এরই সাথে দুই যুগ পর আবার বিশ্বকাপের হারানো শিরোপা পুনরুদ্ধার করে ব্রাজিলিয়ানরা। আর ঠিক ১৬ বছর আগে (১৯৮২ সালে) এই ব্রাজিলকে কোয়ার্টার ফাইনালে হারিয়ে দেয়া ইতালি ব্যাজিওর পেনাল্টি মিসে দুঃখ- যন্ত্রণায় কাতর হয়ে ওঠে।
ফুটবলের মহানায়ক, মহারাজা ডিয়াগো ম্যারাডোনাও পেনাল্টি মিস করেছেন। সেটা ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে যুগোশ্লোভেকিয়ার সাথে। ৩০ জুন ফ্লোরেন্সের কমনওয়েলথ স্টেডিয়ামে পেনাল্টি শ্যুট আউটে নিষ্পত্তি হওয়া কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে যদিও আর্জেন্টিনা বিজয়ী হয় ৩-২ গোলে।
আর্জেন্টাইনরা জিতে সেমিতে চলে যাওয়ায় ম্যারাডোনার পেনাল্টি থেকে গোল করতে না পারার ঘটনাটি সেভাবে আলোচিত হয়নি। আলোড়ন তোলেনি। কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য হলো, ম্যারাডোনাও পেনাল্টি মিস করেছেন। তার জাদুর পা থেকে কত অনিন্দ্য সুন্দর গোল বেড়িয়ে এসেছে, অথচ ঐ ম্যাচে পেনাল্টি শ্যুট আউটে গোল করতে পারেননি ম্যারাডোনা। তার নেয়া দলের তৃতীয় শটটি ডান দিকে ঝাঁপিয়ে রুখে দেন যুগোশ্লাভ গোলকিপার তোমিশ্লাভ আইভোকিচ।
আর্জেন্টিনা জিতে যাওয়ায় ম্যারাডোনার পেনাল্টি মিসের কথা অনেকেরই মনে নেই। বলার অপেক্ষা রাখে না, ঐ ম্যাচে আর্জেন্টিনা হারলে ফুটবলের মহানায়কের গায়েও কালো দাগ লেগে যেত। কে জানে, তিনিও হয়ত খলনায়ক বনে যেতেন!
এআরবি/এমএমআর/জেআইএম