মেসি-রোনালদোও মানুষ, অতিমানব নন
‘বিশ্বকাপ’- চার বছর পর পর আসা ফুটবলের স্বপ্নের আসর। শত কোটি ফুটবল ভক্তের প্রাণের আসর। বেশির ভাগ ফুটবলপ্রেমীর কাছেই বিশ্বকাপ ‘মধুর হাঁড়ি।’ যার মধুর রস পান করেন ফুটবল অনুরাগিরা। অন্যরকম আস্বাদন পান।
শুধু দর্শক, ভক্ত, সমর্থক আর অনুরাগিদের কথা বলা কেন, বিশ্বকাপ তো ফুটবলারদেরও সেরা মঞ্চ। বিশ্বকাপ জেতার, মহানায়ক হবার আর ইতিহাসের পাতায় নিজের দেশ ও নিজের নামকে সোনালি হরফে লিখে রাখারও শ্রেষ্ঠ ক্ষেত্র।
বিশ্বকাপ তাই অনেকে দেশের, দলের ও ফুটবলারের স্বপ্নপূরনের আসর। আশা-আকাঙ্খা মেটানোর মঞ্চ। বিশ্বকাপ যুগের, কালের তথা সময়ের সেরা দল নির্ধারণেরও আসর। সেরা ফুটবলার নির্বাচনের সর্বোত্তম ক্ষেত্র।
একইভাবে বিশ্বকাপ বড় নির্দয়। নির্মম। স্বপ্ন পূরনের পাশাপাশি স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা, যন্ত্রণা, হতাশায় ‘নীল’ হবারও ক্ষেত্র এই বিশ্বকাপ। কেউ এ আসর খেলে খেলেই নায়ক থেকে মহানায়ক। আর কেউবা ‘হিরো’ থেকে ‘ভিলেন’ বনে গেছেন এই বিশ্বকাপ থেকেই।
তবে পরিবেশ-পরিস্থিতি ভেদে এই খলনায়ক হবার গল্প, কাহিনী ভিন্ন। সাধারণ হিসেবে কারো ব্যক্তিগত ব্যর্থতায় কোন দল বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়লে কিংবা সাফল্যের খুব কাছে গিয়ে তা ধরতে না পারলে, তাকে বড় ব্যর্থ পারফরমার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
ইতিহাস জানাচ্ছে, শুধু পেনাল্টি মিস করেই বেশ কজন বিশ্ব তারকা শেষ পর্যন্ত ডুবে গেছেন। তাদের তারকা খ্যাতি কমেছে। ফিকে ও ম্লান হয়ে গেছে।
মোদ্দা কথা, ফুটবলে পেনাল্টি থেকে গোল করতে না পারা একটা অনেক বড় ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত হয়। বিশেষ করে ঐ পেনাল্টি মিসের মাশুল যদি হয় পরাজয়, তাহলে তো কথাই নেই!
হারের পুরো দায় তখন ঐ পেনাল্টি মিস করা ফুটবলারের ওপরই বর্তায়। তিনি যত বড় তারকাই হোন না কেন , অতিবড় ভক্ত ও সমর্থক তখন বলতে থাকেন, অমুকের পেনাল্টি মিসই ডুবিয়েছে। না হয়, আমরাই জিততাম।
কাকাতালীয়ভাবে সময়ের দুই শীর্ষ তারকা লিওনেল মেসি আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোও এরই মধ্যে পেনাল্টি মিস করেছেন।
অবাক হবার মতই ঘটনা। মেসি আর রোনালদো দুজনার পেনাল্টি মিসের ম্যাচ দুটি অতি কাকতালীয়ভাবে ১-১ গোলে ড্র থেকে গেছে। ১৬ জুন আর্জেন্টিনা আর আইসল্যান্ড ম্যাচ সমতায় থাকা অবস্থায় মেসির দুর্বল পেনাল্টি আইসল্যান্ড গোলকিপার ডান দিকে ঝাঁপিয়ে রুখে দেন। ঐ ম্যাচ ১-১ গোলে অমীমাংসিত থেকে যায়। একইভাবে গতকাল মানে ২৫ জুন ইরানের বিপক্ষে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো পেনাল্টি থেকে গোল করতে না পারা ম্যাচটিও ১-১ গোলে ড্র অবস্থায় শেষ হয়েছে।
রোনালদোর দল পর্তুগাল তখন ১-০ গোলে এগিয়ে। ৫৪ মিনিটে রিয়াল তারকাকে বক্সের ভিতরে ফাউল করে মাটিতে ফেলে দেন ইরান ডিফেন্ডাররা। তাতেই পাওয়া পোনাল্টি কিকটি নেন রোনালদো। তিনি ডান পায়ে দ্বিতীয় পোস্ট দিয়ে বাঁকানো শটে ইরানি গোলকিপারকে পরাস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আলী রেজা বেইরানভান্দ আগে থেকেই ঐ দিকে পজিশন নিয়ে ছিলেন। নিজের বাঁ দিকে ঝাপিয়ে তা প্রতিহত করেন তিনি। পরে ইরান অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয় মিনিটে গোল শোধ করলে ম্যাচ ১-১ অমীমাংসিত থেকে যায়।
বিশ্বসেরার সেরার দৌঁড়ে ব্রাজিলের নেইমারও আছেন। তারপরও সুনাম, সুখ্যাতি এবং ব্যক্তিগত মুন্সিয়ানা, দক্ষতা এবং ফুটবলের নানা শৈল্পিক, নান্দনিক এবং সৃজন ও সৃষ্টিশীলতায় লিওনেল মেসি আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোই সবার সেরা। এই দুজনার মধ্যে কে শ্রেয়? সবার সেরা? তা নিয়ে আছে রাজ্যের বিতর্ক।
মেসি প্রথম দিন আইসল্যান্ডের বিপক্ষে পেনাল্টি মিস করায় তাই আর্জেন্টিনার সমর্থক ও মেসি ভক্তরা হতাশায় পুড়ে দগ্ধ হয়েছিলেন। তাদের মন দুঃখ-যন্ত্রনায় ‘নীল’ হয়ে গিয়েছিল।
বিপরীতে রোনালদো ভক্তরা বিষয়টি খুব উপভোগ করেছিলেন। মেসি বিশ্বকাপে পেনাল্টি মিস করেছেন। তার মিসের খেসারত হিসেবে আর্জেন্টিনা জিততে পারেনি। ড্র করে মাঠ ছেড়েছে, মেসি বিরোধি তথা রোনালদো সমর্থকদের এটা ছিল রীতিমত উৎসবে মেতে ওঠার উপলক্ষ্য। এক আনন্দ-উল্লাস করার অনুকূল ক্ষেত্র। নানা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ আর কৌতুক হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কতই না ব্যঙ্গোক্তি হয়েছে! নানারকম হাস্যকর কার্টুন আঁকা হয়েছে। কিন্তু কাল গভীর রাতে ইরানের বিপক্ষে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো পেনাল্টি থেকে গোল করতে না পারায় হিসেব বরাবর হয়ে গেছে। মেসি আইসল্যান্ডের বিরুদ্ধে গোল করতে না পারায় যারা বিদ্রুপের হাসি হেসেছিলেন, তারাও গেছেন চুপসে। তাদের সবার মুখে তালা । ভিতরে ক্ষেদোক্তি- একি হলো! আরে এ লজ্জা রাখি কোথায়, আমাদের প্রিয় রোনালদোও দেখি পেনাল্টি থেকে গোল করতে পারলেন না!
আসলে ভক্ত-সমর্থকরা ও অনুরাগিরা অন্ধ ভালবাসায় আচ্ছন্ন। আবেগ-উচ্চাসে তারা ভুলেই যান, আমার স্বপ্নে খেলোয়াড়টিও একজন মানুষ। মেধা, মনন, প্রজ্ঞা, প্রতিভা, দক্ষতা ও মুন্সিয়ানায় তিনি হয়ত বিশ্বসেরা। তবে অতি মানব নন। তারও সীমাবদ্ধতা আছে। তিনিও ভুল করতে পারেন। তারও ভুল হতে পারে। তার সব দিন সমান কাটবে না। ভালোর বিপরীতে খারাপ সময়ও আসতে পারে। এই বোধ জাগ্রত থাকলে মেসির পেনাল্টি মিস নিয়ে ফেসবুকে সমালোচনার ঝড় বইতো না। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ আর ব্যঙ্গাত্মক কার্টুনে সয়লাব হতো না।
রোনালদোর পেনাল্টি মিস নিয়েও শুরু হয়ে রাজ্যের গেছে টিকা টিপ্পনি। কিন্তু কেউ মাথায় আনছেন না, মেসি আর রোনালদো যত বড় মাপের ফুটবলার হোন না কেন; তাদেরও ভুল হতে পারে। তাদের নেয়া পেনাল্টিও মিস হতে পারে। মেসি-রোনালদোর পেনাল্টি মিস হবে না, এমন কথা কোথাও লিখা নেই। এমন নিশ্চয়তাও নেই। তারা নিজেরাও শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারবেন না। কোনদিনও বলতে পারবেন না, আমার এই পেনাল্টি শটে গোল হবেই।
মেসি-রোনালদোরও ভুল হতে পারে। হয়। তাদের সামর্থ্যও অসীম নয়। তাদেরও সীমাবদ্ধতা আছে। আর ভুলে গেলে চলবে না, প্রতিপক্ষ গোলকিপারও মানুষ। তারও খারাপ দিন, ভালো দিন থাকে। তিনিও প্রাণপন চেষ্টা করেন পেনাল্টি রুখতে। সবার জানা, বিশ্ব আসর মানে বিশ্বকাপে মেসি-রোনালদোর মত সেরাদের সেরা তারকার পেনাল্টি আটকে দেয়া মানেই হিরো বনে যাওয়া। বিশ্বব্যাপি খ্যাতি ছড়িয়ে পড়া।
সাধারণত পেনাল্টি শ্যুট আউটে বেশির ভাগ গোলকিপার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিপক্ষ শ্যুটারের পায়ের দিকে না তাকিয়ে একটা দিক বেছে নেন। তিনি ধরেই রাখেন আর মনে পুষে ফেলেন, শট যেদিকেই যাক বা পেনাল্টি শ্যূটার যেদিকেই শট নেন না কেন, আমি আমার ইচ্ছেমত ডানে না হয় বাঁয়ে, এদিক না হয় ওদিকে ঝাঁপিয়ে পড়বো। আর ঐ ঝাঁপিয়ে পড়ার সাথে পেনাল্টি শ্যুটারের শট একই দিকে আসলেই তা সেভ হয়ে যায়।
বেশির ভাগ গোলকিপার এভাবে দিক বেছে নিয়েই পেনাল্টি রুখে দিয়ে হিরো বনে গেছেন। আইসল্যান্ড গোলকিপার হ্যাসেন হল্ডরসন আর ইরানের আলী রেজা বেইরানভান্দও ঠিক একইভাবে দিক নির্বাচন করে রেখেছিলেন। বল যেদিকেই আসুক, আমি দিকে ডাইভ দিব। কাকতালীয়ভাবে শট দুটি তাদের ডাইভ দেয়া জায়গায় বা নাগালে চলে আসায় তা প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে।
সব কথার শেষ কথা, তারকারাও মানুষ। মেসি-রোনালদো অতি মানব নন। তারাও মিস করতে পারেন। তাদের শট মানেই শতভাগ গোল নয়। কোন না কোন গোলকিপার যে কোন দিন তা আটকেও দিতে পারেন।
এই বিশ্বকাপেই যার প্রমাণ মিললো। কি বলেন? ঠিক না!
এআরবি/এমএমআর/জেআইএম