শ্বাসরুদ্ধকর একটি ম্যাচ
আগেরদিন ক্রোয়েশিয়ার কাছে আর্জেন্টিনার পরাজয় অনেকটাই শঙ্কা জাগিয়ে দিয়েছিল। রাশিয়া বিশ্বকাপ যেভাবে একের পর এক অঘটনের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে, তাতে ব্রাজিলের কি অবস্থা হয় সে আশা-আশঙ্কার দোলাচলে দুলছিল সমর্থকরা। সাত সমূদ্র-তেরো নদীর এপারে সেই শঙ্কার ঢেউ বাংলাদেশেও কতটা আছড়ে পড়ছে, সেটা টিভির সামনে বসে থাকা দর্শক-সমর্থকদের অবস্থা দেখলেই বোঝা যাচ্ছিল।
প্রথম ম্যাচে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র, ব্রাজিলকে অনেকটাই খাদের কিনারে ঠেলে দিয়েছে। তারওপর, ছোটদলগুলো যেভাবে রক্ষণদুর্গ তৈরি করে বড় দলগুলোকে ঠেকিয়ে দেয়ার কৌশল নিয়েছে, তাতে শঙ্কাটা বেড়ে যাচ্ছিল আরও বেশি। কোস্টারিকা খুব ছোট কোনো দল নয়।
২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে তারা একসঙ্গে ইতালি এবং ইংল্যান্ডকে বিদায় করে দিয়েছিল। তাছাড়া এই দলটিতে রয়েছে, বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক কেইলর নাভাস। রিয়াল মাদ্রিদ যার গোলকিপিংয়ের ওপর ভর করে টানা তিনটি চ্যাম্পিয়ন লিগ জিতেছে।
জার্মানি হেরেছে, আর্জেন্টিনা হেরেছে, স্পেন ড্র করে পরের ম্যাচে এসে কোনোমতে ইরানের বিপক্ষে জয় পেয়েছে। ফ্রান্সও কোনোমতে দুই ম্যাচে পেয়েছে কষ্টার্জিত জয়। ফেবারিটদের মধ্যে ব্রাজিল কী করে সেটাই দেখার অপেক্ষায় ছিলো পুরো বিশ্ব। সারা বিশ্বের চোখই নিবদ্ধ ছিল সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেডিয়ামের দিকে।
শ্বাসরূদ্ধকর ম্যাচটিতে ব্রাজিল দিয়েছে ২টি গোল। একেবারে শেষ মুহূর্তে। ইনজুরি সময়ে হয়েছে গোল দুটি। একটি কৌতিনহো এবং অন্যটি নেইমারের। শ্বাসরূদ্ধকর, স্নায়ুক্ষয়ী উত্তেজনার এই ম্যাচটি শেষে ব্রাজিল সমর্থকদের মুখে শেষ হাসি। কিন্তু ২-০ গোলের ব্যবধানে জয় নিয়ে মাঠ থেকে বের হওয়ার আগে ব্রাজিল সমর্থকদের স্নায়ুর সর্বোচ্চ পরীক্ষা নিয়েছে কোস্টারিকা।
কোচ তিতের অধীনে এবারের বিশ্বকাপে অন্যতম ফেবারিট ব্রাজিল। বিশ্বকাপ শুরুর আগে থেকে তাদেরকেই বলা হচ্ছিল সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন। ২০১৪ বিশ্বকাপে দারুণ বিপর্যয়ের পর ব্রাজিল যেভাবে নিজেদের গুছিয়ে নিয়েছে, তাতে সারা বিশ্বই ব্রাজিলকে সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ঘোষণা না দিয়ে উপায় ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা, তিতের অধীনে ব্রাজিল তাদের খেলায় ঐতিহ্য ফিরিয়ে এনেছে। সাম্বার ছন্দে জোগো বোনিতোর যে সর্বোচ্চ পরিবেশনা, তার সবই উপস্থিত ছিল তিতের সেলেসাও শিবিরে।
এ কারণে, ১৫ জুলাই লুঝনিকি স্টেডিয়ামে হলুদের ঝড় উঠলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কিন্তু সেই ব্রাজিলই গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে এসে হোঁচট খেলো। সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র। দ্বিতীয় ম্যাচে কোস্টারিকার বিপক্ষে অনেকেই হয়তো ভেবেছিলেন নেইমাররা অনায়াস জয় তুলে নেবে। কিন্তু ৫-৩-২ ফরমেশনে দল সাজিয়ে কোস্টারিকা কোচ অস্কার রামিরেজ যেভাবে একাদশ সাজালেন, তাতে শুরুতেই মনে হচ্ছিল, নেইমারদের জন্য গোল বের করার কাজটা বেশ কঠিনই হবে।
কিন্তু ৫-৩-২ ফরমেশনের ছিঁটেফোটাও মাঠে দেখা গেলো না। কোস্টারিকা খেলেছে ৯-১ কিংবা কখনও ১০-০ ফরমেশনে। ডিফেন্সে চীনের প্রাচীরের মত এতটা শক্ত-কঠিন দেয়াল তৈরি করেছিল যে, ব্রাজিলের শক্তিশালী আক্রমণভাগও সেই দেয়ালে ছিড় ধরাতে পারছিল না।
সামান্য পরিসংখ্যানই বলে দেবে, কোস্টারিকা কতটা রক্ষণাত্মক খেলেছে। বল পজেশনে ব্রাজিলের ভাগে ৭৮ ভাগ। আর কোস্টারিকার ভাগে মাত্র ২২ ভাগ। গোলপোস্ট লক্ষ্যে ব্রাজিল শট নিয়েছে ২০টি। অন টার্গেট ১০টি। সে হিসেবে কোস্টারিকা শট নিয়েছে মাত্র ৩টি। অন টার্গেটে কোনো শটই নেই। ব্রাজিল পাস দিয়েছে ৭০৫টি এবং কোস্টারিকা পাস দিয়েছে মাত্র ২৭৮টি।
এই পরিসংখ্যানই বলে দেয় ম্যাচটি কতটা এক তরফা ছিল। কিন্তু ব্রাজিলের এক তরফা ম্যাচের আক্রমণের সয়লাব গিয়ে থেমে যাচ্ছিল কোস্টারিকার ডিফেন্সে এসে। ডিফেন্স ভেদ করে যে কয়টা শট পোস্টে গিয়েছিল, সেখানে ছিলেন কেইলর নাভাস। তিনি তো একাই একশো। কোনো শট যেন তাকে ফাঁকি দিয়ে যেতে পারে না। এমনটাই পণ করে মাঠে নেমেছিলেন তিনি।
প্রথমার্ধ শেষ হলো গোলশূন্য। অসাধারণ ফুটবল খেলেও কোনো গোল আদায় করতে পারলো না ব্রাজিল। হেসুস একটি শট জালে জড়িয়েওছিলেন। কিন্তু অফসাইডের কারণে সেটা বাতিল। প্রথমার্ধে কাউন্টার অ্যাটাকে কয়েকটা আক্রমণ কোস্টারিকা করতে পারলেও, দ্বিতীয়ার্ধে তার ছিঁটেফোটাও ছিল না। একের পর এক ব্রাজিলের আক্রমণ ঠেকাতেই ব্যাস্ত ছিল পুরো কোস্টারিকা দল। গোলরক্ষকসহ পুরো দলের ১১ জনই দাঁড়িয়েছিল ডি বক্সের মধ্যে। ‘বাস পার্ক’ ডিফেন্সের সবচেয়ে বড় উদাহরণ দেখালো কোস্টারিকা।
নেইমার, হেসুস, কৌতিনহো, ডগলাস কস্তা, ফিরমিনো, মার্সেলোদের মুহূর্মুহু আক্রমণের সবগুলোই এসে থেমে যাচ্ছিল কোস্টারিকার পার্ক করা বাসের সামনে। ফাঁকি দিয়ে যে বলগুলো বের হচ্ছিল, সেগুলো থমকে যাচ্ছিল নাভাসের সামনে এসে। ৫০ মিনিটের পর, ৬০ মিনিট এরপর ৭০ মিনিটও পার হয়ে গেলো। দেখতে দেখতে ৮০, ৮৫ মিনিট। কিন্তু কোনো গোলের দেখা মিলছিল না। কী অস্বাভাবিক, এক শ্বাসরূদ্ধকর অবস্থা! ব্রাজিল সমর্থকদের শরীরের কাঁপুনি পর্যন্ত তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
৯০ মিনিটেরও খেলা শেষ। এরই মধ্যে আহত হওয়া, পড়ে যাওয়ার অভিনয় শুরু করে দেয় কোস্টারিকার খেলোয়াড়রা। অভিনয় নেইমারও করেছিল। পেনাল্টি আদায় করে নেয়ার জন্য সেই অভিনয়ে প্রাভাবিত হয়েছিলেন রেফারিও। শেষে কোস্টারিকান খেলোয়াড়দের প্রতিবাদের মুখে ভিএআর নিয়ে নেইমারের অভিনয় ধরা পড়ে এবং রেফারি নিজেই সেই পেনাল্টির বাঁশি প্রত্যাহার করে নেন।
কিন্তু শেষ মুহূর্তে কোস্টারিকানরা একের পর এক অভিনয় শুরু করলো টাইম নষ্ট করার জন্য। এমনকি গোলরক্ষক কেইলর নাভাস পর্যন্ত পড়ে থাকার ভান করলেন। খেলোয়াড় পরিবর্তন করতে গেলে তিন-চার মিনিট সময় নিচ্ছিল তারা। থ্রো বল করতে গেলে সময় নষ্ট করছিল। যে কারণে রেফারিকে হলুদ কার্ড পর্যন্ত বের করতে হয়।
এত সময় নষ্ট। যে কারণে, ইনজুরি টাইম দেয়া হলো ৬ মিনিটের। ব্রাজিলিয়ান সমর্থকদের আশা তখনও শেষ হয়নি। শঙ্কার দোলাচলে দুলতে দুলতে এগুচ্ছিল সময়। এত আক্রমণের পরও গোল হচ্ছে না, তাতে এক প্রকার হতাশাই ঘিরে ধরেছে গ্যালারিতে উপস্থিত সমর্থকদের। পাশাপাশি যারা টিভির সামনে ছিল তাদেরও।
এমন সময়ই বদ্ধ তালা খুললেন কৌতিনহো। মার্সেলোর ক্রস থেকে ওয়ান টাচে ফিরমিনো বল দেন হেসুসকে। তিনিও বিলম্ব করলেন না, ওয়ান টাচে বল পাস করেন কৌতিনহোকে। আরেকটা টাচ। বল কেইলর নাভাসের দুই পায়ের ফাঁক গলে জড়িয়ে গেলো সোজা জালে।
বাঁধভাঙা উল্লাসে ফেটে পড়লো গোটা গ্যালারি। উল্লাসের ঢেউ এতটাই ছিল যে ব্রাজিলের বাস্তববাদী কোচ তিতেও সেই ঢেউয়ে ভেসে গেলেন। উল্লাসের তোড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন মাঠে। ব্রাজিল ফুটবলাররাও যোগ দিলেন সেই ঢেউয়ে ভেসে যাওয়ার তালে।
শেষে আরও একটি গোল দিলেন নেইমার। ডান পাশ থেকে ডগলাস কস্তা বল পাস দেন পোস্টের সামনে। নাভাসকে ফাঁকি দিয়ে বল চলে যায় নেইমারের কাছে। আলতো ছোঁয়ায় দ্বিতীয়বারের মত কোস্টারিকার জালে বল জড়িয়ে দেন নেইমার।
চরম উত্তেজনা, রোমাঞ্চ আর শ্বাসরূদ্ধকর একটি ম্যাচ শেষে অবশেষে ২-০ গোলের জয় নিয়েই মাঠ ছাড়লো ব্রাজিল। সে সঙ্গে দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠার পথ অনেকটাই পরিস্কার করে নিলো তারা।
আইএইচএস/পিআর