তোমাকে মিস করি বাবা
প্রতি বিশ্বকাপেই মর্মান্তি কোন ঘটনা ঘটে। হয়তো কোন কিংবদন্তি ফুটবলার অবসরে যান। বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ে হয়তো কোন তারকা খেলোয়াড় ইনজুরিতে পড়েন কিংবা ভাগ্যের কারণে কোন জাতির স্বপ্নের সলিল সমাধি ঘটে। তবে এই মর্মান্তিক ঘটনার ধরণ একটু আলাদা। বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ে এরকম ঘটনা ঘটেনি। বিশ্বকাপ শুরুর অনেক আগেই এ মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে।
২০১৭ সালের ১৫ই এপ্রিল, এক আততায়ীর গুলিতে পানামার হয়ে ৮৫টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা আমিলসার হেনরিকজ নিহত হন। পানামার সর্বকালের সেরা একজন খেলোয়াড় হিসেবেও গণ্য করা হয় তাকে। সেই আমিলসারের পানামা ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এবারের বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েছে। সেদিনের সেই ঘটনাটি না ঘটলে হয়তো পানামার ফুটবল ইতিহাসের এ উজ্জ্বল নক্ষত্রও রাশিয়ায় নিজ দেশের হয়ে বিশ্বকাপ খেলতে নামতে পারতেন। তার পরিবারও হয়তো গর্বিত হতো তাকে খেলতে দেখতে, আরো অনেক কিছুই হয়তো হতো। তবে সব স্বপ্নকেই ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছে কয়েক মূহুর্তের একটি ঘটনা।
আমিলসারের স্বপ্ন, ক্যারিয়ার, বিভীষিকাময় মৃত্যু এবং মৃত্যুর পর তার পরিবারের বদলে যাওয়া জীবন নিয়েই মিররকে এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন আমিলসারের স্ত্রী গিক্সানি হেনরিকজ।
গিক্সানি বলেন, ‘তার আজীবনের স্বপ্ন ছিলো বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলা। আমি বিশ্বাস করতে পারি না সে সেখানে থাকবে না। সে বেঁচে থাকলে ইংল্যান্ডের সঙ্গে খেলতে পছন্দ করতো। আমি হয়তো সেখানে থাকতাম তার খেলা দেখতে এবং বাচ্চারাও হয়তো সেখানে যেতো ইংল্যান্ডের সাথে তাদের বাবাকে খেলতে দেখতে। আমার ছেলে এখনো মনে করে তার বাবা আবার ফিরে আসবে এবং খেলবে। আমি এখনো প্রতিদিনই তার কথা ভাবি।’
তারপর গিক্সানিকে ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করা হয় সেদিন, অর্থাৎ ১৫ই এপ্রিল ঠিক কি ঘটেছিলো।
গিক্সানি আবারো বলতে শুরু করেন, ‘তখন সময় বিকালের সাড়ে চারটা। আমিলসার বাইরে গেলো এবং আমি গুলির শব্দ শুনলাম। আমি তখনই খারাপ কিছু ভেবে ভয় পেলাম। এরপর আমি বাইরে গেলাম এবং যখন আমি তার দেহটি দেখলাম আমার শরীর অবশ হয়ে আসছিলো। আমি খুবই হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম। বাচ্চারা ঘরে ছিলো এবং সৌভাগ্যবশত তারা তাদের বাবার দেহ দেখেনি। আমি তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু আমি সেই অল্প কিছু সময়কে খুব স্পষ্টভাবে মনে করতে পারি।’
তিনি বলতে থাকেন, ‘আমার স্বামী তার এক বন্ধুর কাছ থেকে হুমকি পেয়েছিলো। সে বন্ধু তার কাছ থেকে টাকা চাচ্ছিলো। সে এটা নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় ছিলো এবং আমাকেও এটা বলেছিলো। তারপর সে থানায় গিয়ে পুলিশদেরও বিষয়টি জানায়। পুলিশ তাকে বলে চিন্তা না করতে এবং এর কিছুদিন পরেই সে মারা যায়। আমাকে বলা তার শেষ কথাগুলোর একটি হচ্ছে, বাচ্চাদের খেয়াল রেখো। তাদের জন্য শক্ত থেকো। সে জানতো কিছু একটা হতে যাচ্ছে।’
তারপর গিক্সানিকে জিজ্ঞেস করা হয় তার স্বামীর মৃত্যুর পর তারা পানামা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে কোন সাহায্য পেয়েছে কি না। গিক্সানি চিৎকার করে বলেন, ‘কিছুনা, কিছুনা।’
এছাড়াও গিক্সানি জানান তার স্বামীর হত্যার বিচার এখনো হয়নি এবং তিনি অর্থনৈতিকভাবে সমস্যায় আছেন।
‘আমি ক্ষুব্ধ যে ওই ঘটনার পরও পুলিশ কাউকে ধরেনি। আমিলসার এক বছরেরও বেশি সময় আগে খুন হয়েছে কিন্তু কাউকেই কোর্টে তোলা হয়নি। আমার সপ্তাহে পাঁচ দিন কাজে যেতে হয় পরিবারের জন্য টেবিলে খাবার আনতে। এই বাড়িতে বসবাস করার কারণে প্রতিদিন হাজারো স্মৃতি মনে পড়ে যায়। আমি ভীত এবং এ ঘটনা থেকে সামনে এগুতে চাই কিন্তু আমি পারি না। আমার প্রতিবেশী যারা আছেন তারা এখনো আমাকে নিয়ে ঈর্ষান্বিত কারণ আমি একজন বিখ্যাত ফুটবলারের স্ত্রী ছিলাম। এটা খুবই কঠিন। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বলার মতো কোন সাহায্যই পাইনি আমি।’
তারপর গিক্সানি তার বেডরুমে যান এবং তার বিয়ের অ্যালবামগুলো নিয়ে আসেন এবং সেগুলো দেখান আর সেই সাথে বলতে থাকেন, ‘এটার দিকে তাকান। আমার বিয়ের দিনটা ছিলো আমার জীবের শ্রেষ্ঠতম দিন। আর যেদিন আমার স্বামী মারা যান সেদিন ছিলো সবচেয়ে দুঃখের দিন।’
আরাবে ইউনিদোর প্রেসিডেন্ট পেদ্রো গর্দন আমিলসারকে ১৫ বছর ধরে চিনতেন। তিনি বলেন, ‘মিকির মৃত্যুটা একটা আসল ট্র্যাজেডি ছিলো। এটা অনেক বেদনাদায়ক ছিলো এবং সে আসলেই একজন ভালো মানুষ ছিলো। সে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠে নামতে পারতো নিঃসন্দেহেই। সে খুবই ভালো একজন খেলোয়াড় ছিলো।’
নিউ ইতালির এক গ্রামেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন আমিলসার হেনরিকজ। একটি কালো ও সোনালী রঙের ফুটবল তার কবরের ওপর প্রতীকি হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে। সেই সাথে রাখা আছে আমিলসারের বাচ্চাদের রেখে যাওয়া একটি নীল বেলুন; যেখানে লেখা রয়েছে, ‘তোমাকে মিস করি বাবা।’
ডিকেটি/আরআর/এমএস