আলোচিত-সমালোচিত জিদানের হেডবাট
তার অসাধারণ নৈপুণ্যে আট বছর আগে বিশ্বকাপ জিতেছিল ফ্রান্স। ব্রাজিলের মত বিশ্বসেরা দলকে ফাইনালে একাই দিয়েছিলেন দুই গোল। তার কাছেই হারতে হয়েছিল রোনালদোদের।
দুই বছর পর ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপেও দুর্দান্ত পারফরম্যান্স প্রদর্শণ করে জিনেদিন জিদান। কোয়ার্টার ফাইনালে তার দারুণ এক ফ্রি-কিক থেকে করা গোলে সেমিফাইনালে ওঠে ফ্রান্স এবং শেষ পর্যন্ত ইউরো চ্যাম্পিয়নের মুকুট পরে নেয় তারা। আর জিদান নির্বাচিত হন উয়েফার টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কারের জন্য।
তবে ২০০২ জাপান-কোরিয়া বিশ্বকাপ হতাশাজনকভাবেই কেটেছে ফরাসীদের; কিন্তু জিনেদিন জিদান তো আর ফুরিয়ে যাওয়ার মত নন। মাঠে যতদিন থাকবেন, ততদিন আলোর বিচ্ছুরণ ঘটতেই থাকবে। পায়ের জাদু দেখাতেই থাকবেন।
সেই জাদু যেন জমা করে রেখেছিলেন ২০০৬, জার্মানি বিশ্বকাপের জন্য। এই বিশ্বকাপে বলতে গেলে একক নৈপুণ্যে জিদান ফ্রান্সকে তুলে আনেন ফাইনালে। কোয়ার্টার ফাইনালে একাই যেভাবে ব্রাজিলকে হারিয়েছিলেন, তাতে অনেকেই জিদানের ওই পারফরম্যান্সকে তার জীবনের সেরা বলে অভিহিত করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ৯ জুলাই বার্লিণের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের ফাইনালে ইতালির মুখোমুখি হয় জিদানের ফ্রান্স।
অল ইউরোপ ফাইনাল। ইউরোপিয়ানদের কাছে তাই এই ম্যাচের মাহাত্ম্য আরও অনেক বেশি। যে কারণে ৬৯ হাজার দর্শকের সমাগম ঘটে বিশ্বকাপের ফাইনাল দেখতে। গ্যালারিতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই।
এমন এই ফাইনালে শুরু থেকেই জিদানের ঝলক। ম্যাচের সপ্তম মিনিটেই পেনাল্টি থেকে গোল করে ফ্রান্সকে এগিয়ে দেন তিনি। তবে লিড বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেননি। ১৯ মিনিটে মার্কো মাতেরাজ্জির গোলে সমতায় ফেরে ইতালি।
উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচের ভালো বিজ্ঞাপন হয়ে এগিয়ে চলছিল লড়াই। নির্ধারিত সময় নিষ্পত্তি না হওয়ায় ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। সে সময়টাতেই ঘটলো আসল বিপত্তি। ১১০ মিনিটের খেলা চলছিল তখন। ইতালির মার্কো মাতেরাজ্জিকে হঠাৎ মাথা দিয়ে ঢুঁস মেরে বসেন জিদান। আচমকা এ ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে যায় পুরো গ্যালারি। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় পুরো বিশ্ব। জিদানের মত ফুটবলারের কাছ থেকে এমন আচরণ তো কেউ আর আশা করতে পারে না। যিনি কিনা একজন খেলোয়াড়ের চেয়েও একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মানুষও বটে।
হেড বাট তো হয়েই গেলো। রেফারি সঙ্গে সঙ্গে মার্চিং অর্ডারে লাল কার্ড দেখিয়ে দেন জিদানকে। অতৃপ্ত বাসনা নিয়েই শেষ মুহূর্তে মাঠথেকে বহিষ্কার হয়ে গেলেন ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলারটি। ১৯৯৮ সালের পর যখন আবারও ফ্রান্সকে বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন করবেন, তখনই এই ঘটনা মন ভেঙে দেয় ফরাসীদের। ফ্রান্সও পুরোপুরি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে।
শেষ পর্যন্ত খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে এবং সেখানে জিদানের অনুপস্থিতিই টের পাওয়া গেলো বেশি। ডেভিড ত্রেজেগের শট মিসের কারণে শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ জিতে নেয় ইতালি। জিদান হয়ে রইলেন ট্র্যাজেডির নায়ক হিসেবে। ক্যারিয়ারের শেষ লগ্নে এসে নিজের গায়ে কলঙ্কের তিলক লাগালেন তিনি। লাল কার্ড দেখে সেই যে মাঠ থেকে বেরিয়ে গেলেন, আর আন্তর্জাতিক ফুটবলে ফেরা হলো না তার। শো কেসে তুলে রাখলেন বুট জোড়া।
২০০৬ সালের সেই ঘটনার ১০ বছর পর, ২০১৬ সালে এসে এক সাক্ষাৎকারে ইতালি ফুটবলার মার্কো মাতেরাজ্জি, স্বীকার করে নেন, হেডবাটের আগে তিনি জিদানের মা এবং বোনকে নিয়ে বাজে কথা বলেছিলেন। ২০০৬ সালে সেই ঘটনার পর থেকেই মিডিয়ায় নানাভাবে এমন কথাই আসতে থাকে। বলা হয়, মাতেরাজ্জি জিদানকে মায়ের নামে কিংবা বোনের গালি দিয়েছিলেন। যে কারণে মেজাজ ঠিক রাখতে পারেননি জিদান। মাতেরাজ্জি ১০ বছর পর্যন্ত এই ঘটনা স্বীকার করেননি। এমনকি অস্বীকারও করেননি। ১০ বছর পর এসে তিনি স্বীকার করলেন বিষয়টা। তবে এটাও জানিয়েছেন, জিদানের কাছ থেকে এ ধরনের প্রতিক্রিয়া পাবেন, সেটাও কল্পনা করতে পারেননি।
আইএইচএস/আরআইপি