বাংলাদেশও বিশ্বকাপ খেলেছে!
কথাটা মিথ না সত্যি! নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তবে জর্জ বেস্টের যা চরিত্র, মানুষ হিসেবে তিনি যেমন ছিলেন, তাতে তার কথাকে ‘মিথ’ মনে করা কঠিন। রবং ওটাকে সত্যি ভাবার যথেষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়; কিন্তু সেই কথাটা কী?
হ্যাঁ, আইরিশ এই সাবেক ফুটবলারের বিখ্যাত এক উক্তি ছিল, ‘আমার গায়ের রঙটা কালো হলে আপনারা পেলের নাম শুনতেন না!’ গায়ের রং নিয়ে এই উক্তির পেছনেও ফুটবলীয় এক যুক্তি! জর্জ বেস্ট অসম্ভব জনপ্রিয় এক ফুটবলার ছিলেন। জন্ম আয়ারল্যান্ডে। খেলেছেন ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে।
ম্যানইউ তারকা হিসেবে তার ছিল আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা; কিন্তু একজন ফুটবলারের তারকা থেকে মহাতারকা হওয়ার সেরা মঞ্চ অবশ্যই বিশ্বকাপ। সেই বিশ্বকাপ মঞ্চেই পা রাখতে পারেননি জর্জ বেস্ট। তাই তারকা হয়েই থাকতে হলো তাকে। মহাতারকা হতে না পারার দুঃখ নিয়েই ফুটবলউত্তর জীবন কাটাতে হলো। হতাশাগ্রস্ত একজন মানুষ হিসেবেই পৃথিবী ছাড়তে হলো।
কিন্তু পেলের সাথে তার কী সম্পর্ক? আছে। একই সময় ফুটবলগ্রহের বাসিন্দা তারা। একজন ব্রাজিলের তিন তিনটা বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য। বিশ্বের সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের অন্যতম। কারো মতে তিনি-ই সেরা। ম্যারাডোনা নামের পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির এক আর্জেন্টাইন ফুটবলগ্রহে পা রাখার আগ পর্যন্ত পেলের শ্রেষ্ঠত্বকে কেউ চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারেননি। তবে যদি কেউ পারতেন তার নাম জর্জ বেস্ট। পারলেন না কেন?
তারও একটাই উত্তর। বেস্ট কখনো বিশ্বকাপ খেলেননি। কারণ, তার সময়ে আয়ারল্যান্ড বিশ্বকাপ খেলার যোগত্যা অর্জন করতে পারেনি। না পারার দায়টা কী শুধু-ই বেস্টের? তা হয়তো না। কারণ, একজন জর্জ বেস্টের কাঁধে চড়ে বিশ্বকাপ খেলা কঠিন ছিল আয়ারল্যান্ডের। তবে বেস্ট যে দুর্দান্ত ফুটবলার ছিলেন তা নিয়ে সংশয়ের কোন কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু পেলে আর বেস্ট ফুটবল গ্রহে একই সরণির বাসিন্দা কি-না তা নিয়ে বির্তক হতেই পারে। কারণ, যুক্তির বিপরীতে পাল্টা আরেকটা যুক্তি থাকা খুব স্বাভাবিক।
ইংলিশ ফুটবলে বেস্ট এক অমর কাব্যের কবি। যার ফুটবলে ছন্দ-গতিময়তা সবই ছিল। যা দেখতে পারেননি বিশ্বকাপ মঞ্চে ফুটবলানুরাগীরা। আর গায়ের রং নিয়ে যে উক্তি তিনি করেছিলেন, সেটা তার জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গে। রমণী মহলে বেস্ট সত্যিই ‘বেস্ট’ ছিলেন। তার সাদা গাড়িতে নাকি রমনীদের লিপস্টিকের ছোপ লেগে থাকত! অনেকে মনে করেন এটা মিথ! তবে রমনীকুলে বেস্ট আরাধ্য এক ফুটবলার ছিলেন, সেটাকে মিথ বলার কোন কারণ নেই।
পেলেকে নিয়ে আর একটা কথা চালু আছে ফুটবল মহলে। ‘পেলে এক ডজ দ্বিতীয় বার দিতেন না!’ কিন্তু সেটা কী সম্ভব? ফুটবলে কতরকম ডজই বা আছে। ডানে-বাঁয়ে যে কোন একদিকে আপনাকে ডজ দিতেই হবে; কিন্তু ‘পেলে ফুটবল শিল্পে’ অবশ্যই অন্য কোন মাত্রা ছিল। তা না হলে ফুটবল বিশ্ব এমন হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়ে কেন পেলে নামটা শুনলেই! তিনি গ্রেট। তিনি ফুটবল সম্রাট। আর বেস্ট অবশ্যই সেই সময়ের রোমান্টিক এক প্রিন্স। যিনি কি-না নিজের রাজত্বে বিস্তার করতে পারেননি। আসলে ফুটবল বিশ্বে নিজের নামটা স্থায়ীভাবে রাখতে হলে বিশ্বকাপ খেলার কোন বিকল্প নেই।
বিশ্বের ছোট ছোট কত দেশকে মানুষ চিনেছে শুধু মাত্র তাদের ফুটবলের কারণে। ত্রিশ লাখ-বিশ লাখ বা তারচেয়েও কম মানুষের বহুদেশ ফুটবলপ্রেমিদের কাছে পরিচিতি পেয়েছে শুধুই ফুটবল নামক একটা বিশ্বজনীন খেলার সৌজন্যে।
বাঙালির আক্ষেপ হতে পারে এখানেই। ষোল কোটি মানুষের দেশ। যে দেশ অনেক ব্যাপারে এখন বিশ্ববাসীর কাছে মডেল। নিম্ম আয়ের এক দেশ এখন পা রেখেছে উন্নয়নশীল দেশের রাস্তায়। যে দেশটা সমুদ্র জয় করছে। মহাকাশে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। বাংলাদেশ নাম বুকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ঘুরছে তার আপন কক্ষপথে।
অথচ ফুটবল গ্রহে সেই দেশটাকে দূরবীন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না! ফিফা রাকিং-এ বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত নিম্নগামী। এক সময় যে দেশটা রাংকিং-এ ১১২তে ছিল। সেই বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৯৭! অথচ এই বাংলাদেশকে ২০২২-এর বিশ্বকাপ খেলোনোর স্বপ্ন ফেরি করা হয়েছিল!
তবে স্বপ্নের ফেরিওয়ালাদের হাত ধরে নয়, বাংলাদেশ তার বিশ্বকাপ যাত্রাপথ খুঁজেছিল ’৮৬-র বিশ্বকাপের আগে। যে বিশ্বকাপ বিখ্যাত হয়ে আছে ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ হিসেবে, সেই বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জনের লড়াইয়ে নামার ছাড়পত্র পেয়েছিল বাংলাদেশ। সেটা ১৯৮৫-তে। ওটাই বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ। হোক না সেটা বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব। তবুতো নামের সাথে বিশ্বকাপ শব্দটা ছিল।
বাছাই পর্বের বাধা পেরুতে পারেনি বাংলাদেশ; কিন্তু দারুণ ফুটবল খেলেছিল সেই দলটা। কলকাতার যুব ভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ ছিল। আশিস ভদ্রের অধিনায়কত্বে বাংলাদেশ প্রথম বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব খেলেছিল।
আশিস ছিলেন মূলতঃ মিডফিল্ডার; কিন্তু অধিনায়ক আশিস বাংলাদেশ দলের দশ নম্বর জার্সি পরেই খেলেছিলেন। নিজেকে প্রমাণও করেছিলেন। ভারতের মাটিতে ভারতের বিপক্ষে প্রথমে গোল করে এগিয়েও যায় বাংলাদেশ। গোলদাতা বাংলাদেশ দলের সেই অধিনায়ক নিজেই।
এখনকার মতো ফিফা সে সময় অ্যাসিস্টের স্বীকৃতি দেয়নি। দিলে ওই গোলের স্কোর শিটে অ্যাসিস্টের ঘরে লেখা থাকতো আরেক শিল্পী ফুটবলারের নাম। বাদল রায়। হ্যাঁ, বাংলাদেশ দলের হয়ে বিশ নম্বর জার্সি পরেই মাঠে নেমেছিলেন সেই সময়ে মোহামেডানের মহাতারকা বাদল রায়। ভারতের বিপক্ষে সেই গোলটা ছিল মোহামেডান, আবাহনীর অসাধারণ এক যুগলবন্দী!
এই শতাব্দীতে এসে বাংলাদেশ ফুটবলে আবাহনী-মোহামেডানের প্রতিদ্বন্দ্বিতাই খুঁজে পাওয়া যায় না। আবাহনী-মোহামেডান লড়াইয়ের উত্তাপ এক সময় দেশজ ফুটবলে ব্রাজিল-আর্জেন্টনা ফুটবলীয় উত্তাপের মতোই মনে হত। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা আগের মতোই আছে। বরং স্যাটেলাইট টেলিভিশনের সৌজন্যে সেটা এখন শুধু বিশ্বকাপের সময় নয়, কোপা আমেরিকাতেও টের পাওয়া যায়।
যদিও বিশ্বকাপ সব সময়ই বিশ্বকাপ। প্রতি চার বছর পরপর ফুটবলের নয়া বিপ্লবের ঢেউ লাগে বিশ্বজুড়ে। সেই ঢেউ আচড়ে পড়ে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচেও। বিশ্বকাপ শেষ। আবার বাংলাদেশ দেখে ফুটবলীয় এক মরুভূমি। যেখানে শুধুই ব্যর্থতার হাহাকার। সম্ভাবণার সবুজ কোন আভা দেখা যায় না।
বিশ্বকাপ এখন আর বাংলাদেশ ফুটবলের জন্য কোন উর্বর পলি রেখে যায় না। অথবা বাঙালি খুঁজে পায় না। অথচ বাংলাদেশের এক সময়ের তারকা ফুটবলারদের মুখে শুধু হাহাকার; ‘হা হা, আমাদের সময়ে অন্তত ফুটবলের এই দীনতা ছিল না। গ্যালারিতে দর্শক খরা ছিল না।’
শুধু ফুটবলারদের কথা বলছি কেন; সমর্থকরাও খুঁজে বেড়ান বাংলাদেশ ফুটবলের সোনালি সময়। কেউ কেউ আবার একটু ব্যঙ্গ করে বলেন, যে দেশের ফুটবলে কোন রুপালি আভাই দেখা যায় না, তাদের আবার সোনালি সময়! এটা শুধু মতিঝিলের ঝিলপাড়েই আছে! সোনালি-রুপালির কথা না হয় বাদ দিলাম।
একটা সময় তো ছিল, বাংলাদেশ ফুটবল ঘিরে গোটা দেশ উন্মাতাল হয়ে যেতো। ফুটবল তারকাদের বাজার দরও ছিল আজকের ক্রিকেটারদের মতো। ছিল তারকা ইমেজ। মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিগুলোও তাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বেসেডর বানিয়েছে দেশ সেরা ফুটবলারদের। বাংলাদেশ বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলেনি; কিন্তু বিশ্বকাপ খেলে আসা ফুটবলারদের খেল-প্র্যাকটিস দেখেছে তারা কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে!
সেই দিনগুলো এখন সত্যিই স্বপ্নের দিন। বাঙালির বিশ্বকপা স্বপ্ন ফিকে হতে হতে এখন শুধু বিবর্ণ নয়, প্রায় নিখোঁজ। যে ফুটবলারদের পেছনে এক সময় সমর্থকরা ফুলের মালা নিয়ে পাগলের মতো মিছিলে হেঁটেছেন, এখন ফুটবলারদের দিকে ফিরে তাকানোর সময়ও নেই সমর্থকদের! ইন্টারনেট-ফেসবুক-টুইটারের এই প্রজন্মও ফুটবল পাগল। তাদের কাছে ফুটবল মানে রাত জেগে লা-লিগা, প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ দেখা! মেসি-রোনালদো-নেইমার-মোহামেদ সালাহ!
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের ফুটবলীয় চিন্তা আর আবেগের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় বিভিন্ন স্ট্যাটাসে। পেলে-ম্যারাডোনাও তাদের কাছে অতীত। সেই অতীত নিয়ে খুব বেশি সময় নষ্ট করতে চায় না থাম কালচারের এই জেনারেশন। পেলে-ম্যারাডোনার সাফল্য তাদের কাছে এখন রীতিমতো মিথ! সেই মিথ নিয়ে খুব একটা আগ্রহ নেই।
আর বাংলাদেশ বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব খেলেছে? এই তথ্য শুনলে রীতিমতো হেসে উঠতে পারে গোটা একটা প্রজন্ম। আর যারা খেলেছিলেন, তারা অনেকেই এখন নিভৃতচারী। বরং যারা বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব খেলেননি। এশিয়াড খেলেননি। এশিয়া কাপ ফুটবল খেলেননি তারা জর্জ বেস্টের মতো বলে বেড়াতে পারেন; আমরা সময়ের চেয়ে এগিয়ে থেকে ফুটবল খেলেছি! যে কারণে আমাদের সময় মাঠভর্তি দর্শক থাকতো। হয়তো তাই। কিন্তু একটা কথা তো সত্যি; বিশ্বকাপে যারা খেলেননি, তারা অনেক বড় ফুটবলার হলেও জর্জ বেস্টদের সরণির বাসিন্দা। পেলে-ম্যারাডোনা-মেসি-রোনালদো-নেইমারদের অভিজাত সরণির বাসিন্দা হওয়ার ছাড়পত্র তারা পাবেন না।
বাংলাদেশেও তাই। যারা বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে খেলতে পারেননি। এবং এখনো পারছেন না; তারা বড় তারকা হলেও অভিজাতদের সরণি থেকে একটু দূরেই থাকবেন। ক্লাব ফুটবল আর বিশ্বকাপ ফুটবলের মাঝে পার্থক্য কিন্তু মতিঝিল আর ধানমন্ডি নয়। তারচেয়েও অনেক অনেক দূর। বাংলাদেশে সেই দূরবর্তী সীমান্তের বাসিন্দা তারা, যারা দেশের হয়ে বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব খেলতে পেরেছিলেন। এবং আগামীতে যারা খেলবেন। হোক না সেটা বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব! তবু তো বিশ্বকাপ!
লেখক: সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট।
আইএইচএস/এমএস