বিশ্বকাপ মাতাবেন মিশরের নতুন রাজা!
কেউ বলছেন নতুন ফারাও, কেউ বলছেন নতুন রাজা। প্রাচীন সভ্যতা, ইতিহাস -ঐতিহ্যের ধারক দেশটিতে মোহামেদ সালাহকে কতজনের সঙ্গেই না তুলনা চলছে। সিএনএন তাকে ইতিমধ্যেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছে ‘দ্য নিউ কিং ইন লিভারপুল’ নামে। মিশরে এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হওয়া মানুষটির নাম মোহামেদ সালাহ।
কতটা জনপ্রিয় তার মাত্র দুটি উদাহরণ। প্রথমটি দেখা গিয়েছিল কিছুদিন আগে মিশরের জাতীয় নির্বাচনে। দেশটির নির্বাচনে প্রায় ১০ লাখ ভোটার প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি এবং দ্বিতীয় হওয়া মুসা মোস্তফা মুসাকে ভোট দেননি। ভোটাররা দুই প্রার্থীকে ক্রস চিহ্ন দিয়ে ব্যালট পেপারের নিচে লিখে দিয়েছে সালাহর নাম। মুসা মোস্তফার চেয়েও বেশি ভোট পড়েছে সালাহর নামে। তারা চান মোহামেদ সালাহ তাদের দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করুক।
দ্বিতীয় প্রমাণ, মিশরের জনপ্রিয়তা মিশর ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে খোদ সৌদি আরবেও। মক্কার মেয়র মোহামেদ সালাহকে পবিত্র নগরীতে একখণ্ড জমি দান করতে চান। সৌদি সরকারের নীতির কারণে সেটা সম্ভব না হলে, অন্তত সালাহর নামে একটি মসজিদ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। অথচ, রাশিয়ায় এই সালাহর প্রতিপক্ষ হিসেবে খেলতে নামবে সৌদি আরব।
লিভারপুল তাদের স্কোয়াডের সেরা খেলোয়াড় ফিলিপ কৌতিনহোকে ছেড়ে দিয়েছে। বার্সেলোনার অব্যাহত চাপের সামনে মাথা তাদের নতই করতে হয়েছিল। দলটির শক্তির জায়গা অনেক বেশি কমে যাওয়ার কথা; কিন্তু তা না, কৌতিনহো ক্লাব ছেড়ে দেয়ার পর দেখা গেলো লিভারপুল আরও বেশি শক্তিশালী, আরও বেশি দুরন্ত।
সেই লিভারপুলকে মোহামেদ সালাহ বলতে গেলে একক নৈপুণ্যে তুলে এনেছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে। ১৩ বছর পর চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে উঠে এলো অল রেডরা। ফাইনালেও রিয়াল মাদ্রিদের মত ক্লাবকে হারিয়ে লিভারপুলকে সালাহ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ট্রফি উপহার দিতে পারেন কি না সেটাই এখন দেখার বিষয়। যদিও তার সতীর্থ, বেলজিয়ান ফুটবলার লভরেন ডেজান জানিয়ে দিয়েছেন, তার দলের স্ট্রাইকার মোহামেদ সালাহ হচ্ছেন বিশ্বসেরা। এই বিশ্বসেরার হাত ধরেই হয়তো ইউরোপ সেরার ট্রফি ঘরে তুলে নেবে লিভারপুল।
রাশিয়া বিশ্বকাপে সবার নজর যার ওপর বেশি থাকবে, তিনি নিঃসন্দেহে মোহামেদ সালাহ। হয়তো তার দল মিশর বলে তারা খুব বেশি দুরে যেতে পারবেন না। দ্বিতীয় রাউন্ড, কিংবা কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত মিশরকে টেনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতাও রয়েছে মোহামেদ সালাহর। দলীয় পারফরম্যান্স যাই হোক, রাশিয়া বিশ্বকাপ যে মাতিয়ে তুলবেন সালাহ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
খুবই সাদামাট জীবনের অধিকারী মোহামেদ সালাহ এবং খুবই ধর্মভীরু। লিভারপুলের হয়ে গোল করলেই সঙ্গে সঙ্গে সিজদায় লুটিয়ে পড়েন তিনি। আগে সমর্থকরা তার নাম দিয়েছিল ‘দ্য ফারাও’। সর্বশেষ লিভারপুল সমর্থকরা তার নাম দিয়ে দিল, ‘দ্য কিং’।
এই কিংয়ের হাত ধরেই ১৯৯০ সালের পর বিশ্বকাপে আবার দেখা যাবে মিশরীয়দের। নিজেদের ফুটবল ইতিহাসে মাত্র ২বারই বিশ্বকাপ খেলেছে মিশর। ১৯৩৪ সালের পর ১৯৯০ সালে। এরপর মাঝে ২৮ বছরের বিরতি দিয়ে মিশরকে বিশ্বকাপে তুলে আনলেন মোহামেদ সালাহ।
মিশর অনুর্ধ্ব-২০ দলের হয়ে শুরু করেন আন্তর্জাতিক ফুটবল। খেলেন ২০১১ ফিফা অনুর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপে। এরপর ২০১২ অলিম্পিক গেমসেও ছিলেন। ২০১২ সালেই আফ্রিকার সেরা উদীয়মান পুরস্কার জেতেন। ২০১৭ সালে আফ্রিকান কাপ অব নেশন্সের ফাইনালে তোলেন মিশরকে। বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে অসাধারণ পারফরম্যান্সের কারণে আফ্রিকার ফুটবলার অব দ্য ইয়ার এবেং বিবিসি আফ্রিকান ফুটবলার অব দ্য ইয়ারের পুরস্কার জেতেন তিনি।
মিশরের উত্তরাঞ্চলীয় শহর গারবিয়ার নাগরিগ এলাকায় জন্ম সালাহর। আল মোকাওলুনের হয়ে যুব ফুটবলে ক্লাব ক্যারিয়ার শুরু। ২০১০ সালে বদলি ফুটবলার হিসেবে সিনিয়র লিগে অভিষেক। এরপর ২০১১-১২ মৌসুমে আল মোকাওলুনের হয়ে নিয়মিতই খেলতে শুরু করেন। পরের বছরই পাড়ি জমান ইউরোপে। নাম লেখান সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত ক্লাব এফসি বাসেলে। অভিষেক মৌসুমেই ক্লাবকে উপহার দেন শিরোপা। জয় করেন এসএএফপি গোল্ডেন প্লেয়ার অ্যাওয়ার্ড।
বাসেলের হয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স নজর কাড়ে চেলসি কর্মকর্তাদের। এফসি বাসেল থেকে সালাহকে কিনে নেয় প্রিমিয়ার লিগের জায়ান্টরা। কিন্তু স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে গিয়ে সালাহকে বসে থাকতে হয় সাইড লাইনে। দুই মৌসুমে খেলেন মাত্র ১৬ ম্যাচ। গোল করেন ৬টি। উপেক্ষার শিকার সালাহ লোনে খেলতে যান ইতালিতে। ২০১৫ সালে প্রথমে যোগ দেন ফিওরেন্তিনায়। এরপর চলে যান এএস রোমায়। শেসে রোমাই সালাহকে কিনে নেয় ১৫ মিলিয়ন ইউরোয়।
এএস রোমার হয়ে দেখাতে শুরু করেন দুর্দান্ত পারফরম্যান্স। টানা গোলের রেকর্ডে রোমা ক্লাব ইতিহাসে সর্বোচ্চ পয়েন্ট নিয়ে ২০১৬-১৭ মৌসুমে হয় সিরি-এ তে রানারআপ হলো। রোমার পারফরম্যান্স সালাহর দিকে আবারও টেনে নেয় ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগকে। এবার তাকে ৩৬.৯ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে কিনে নেয় লিভারপুল। লিভারপুলের ইতিহাসে পরিণত হন সবচেয়ে দামি ফুটবলারে।
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে নিজের দ্বিতীয় স্পেলে সালাহ নিজেকে উইঙ্গার থেকে পরিণত করেন জেনুইন ফরোয়ার্ডে। অভিষেক মৌসুমেই ক্লাবের হয়ে গোলের রেকর্ড ভাঙেন তিনি। প্রিমিয়ার লিগের প্লেয়ার অব দ্য মান্থ পুরস্কার জেতেন তিনবার। চলতি মৌসুমেও গোলের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন সালাহ। শেষ পর্যন্ত তার নামের পাশে যোগ হয় ৩২ গোল। মেসির সঙ্গে তুমুল লড়াইয়ে ছিলেন ইউরোপিয়ান গোল্ডেন সু জয়ের। কিন্তু ২ গোলে পিছিয়ে পড়েন তিনি। তবে, নিজের দলকে তো তুলে দিয়েছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে!
আইএইচএস/জেআইএম