১৯৬৬ : ইংলিশদের প্রথম এবং শেষ বিশ্বকাপ জয়
ইংলিশ ফুটবল দলের ম্যানেজার স্যার আলফ্রেড আর্নেস্ট (আলফ রামসি) সম্ভবত ভবিষ্যৎ জানতেন? ১৯৬০ সালে ফিফা কংগ্রেসে ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপের জন্য স্বাগতিক নির্ধারণ করা হয় ইংল্যান্ডকে। এরপর ১৯৬৩ সালে ইংল্যান্ড দলের ম্যানেজার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, পরের বিশ্বকাপে নিশ্চিত ইংল্যান্ড শিরোপা জয় করবে। শেষ পর্যন্ত জিওফ হাস্টের হ্যাটট্রিকে শিরোপা জয় করে ইংল্যান্ড। ১৯৬৬ বিশ্বকাপই ছিল সাদা-কালো টিভিতে দেখানো শেষ বিশ্বকাপ। এছাড়া সর্বশেষ ২৮ বছরে সেবারই সবচেয়ে বেশি দর্শক উপস্থিতি ঘটেছিল গ্যালারিতে। যে রেকর্ড পার হয়ে গিয়েছিল ১৯৯৪ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে।
টানা দুটি বিশ্বকাপজয়ী ফুটবলারদের প্রায় সবাই দলে। ফুটবলের ইতিহাসে সেরা দলটিই সেবার ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছিল ব্রাজিল। সেবারই প্রথম বিশ্বকাপে অংশ নেয় পর্তুগাল। ইউসেবিওর নেতৃত্বে হোসে তোরেস, মারিও কলুনাদের নিয়ে পর্তুগিজরা গঠন করেছিল তাদের নিজেদের ইতিহাসে সেরা দলটি। একই সময় ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের জার্মানি আর লেভ ইয়াসিনের রাশিয়াও বিশ্বকাপে পাঠিয়েছিল তাদের নিজেদের সেরা দলটি; কিন্তু সবাই এসে থমকে গেল ববি মুর, ববি চার্লটন আর জিওফ হাস্টদের সামনে।
১৯৬৬ সালের ৩০ জুলাই লন্ডনের বিখ্যাত ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে ৪-২ গোলে হারিয়ে জুলে রিমে ট্রফি (বিশ্বকাপ) জিতে নেয় ইংল্যান্ড। ফাইনালে অতিরিক্ত সময়ে ক্যারিশমা দেখালেন জিওফ হাস্ট। দুর্দান্ত এক হ্যাটট্রিকই করে বসেন তিনি। বিশ্বকাপের ফাইনালে হ্যাটট্রিক করার ঘটনা মাত্র ওই একটিই।
বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব থেকে কিছুটা বিতর্ক সৃষ্টি হয়। ফিফার নীতির প্রতিবাদে বিশ্বকাপ বয়কট করে আফ্রিকার ৩১টি দেশ। ফিফার নিয়মে আফ্রিকান নেশন্স কাপ বিজয়ী দলই শুধু খেলতে পারবে বিশ্বকাপে। শর্ত হলো প্লে-অফ ম্যাচ খেলতে হবে এশিয়ান কিংবা ওশেনিয়া অঞ্চলের বিজয়ীদের সঙ্গে।
আফ্রিকানরা দাবি করে, ‘শিরোপা জয়ই তো একটি দলের সামর্থ্য কী আছে, তা ভালোভাবে প্রমাণ করে। তারপরও কেন আমরা প্লে-অফ খেলবো!’ যে কারণে ওই বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব অনুষ্ঠিত হয়েছে কোনো আফ্রিকান দেশ ছাড়াই। তারপরও সর্বাধিক ৭০টি দেশ বাছাই পর্বে অংশ নেয়। ইউরোপের ১০টি, লাতিন আমেরিকার ৪টি, এশিয়ার একটি এবং ওশেনিয়া অঞ্চলের একটিসহ মোট ১৬টি দল নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বকাপের অষ্টম আসর।
সেবারই প্রথম এশিয়ান দল হিসেবে প্রথম রাউন্ড পার হয় উত্তর কোরিয়া। প্রথমবার অংশ নিয়েই বাজিমাত করে উত্তর কোরিয়ানরা। কোয়ার্টার ফাইনালে ৩-০ গোলে এগিয়ে থেকেও পর্তুগালের কাছে ৫-৩ গোলে হেরে বিদায় নেয় তারা। ওই ম্যাচে ইউসেবিও একাই করেন ৪ গোল। ওই বিশ্বকাপের পর উত্তর কোরিয়া পরের বিশ্বকাপ খেলে ২০১০ সালে।
১৯৬৬ বিশ্বকাপে মাঠের বাইরের নায়কে পরিণত হয় পিকলস নামের একটি কুকুর। বিশ্বকাপ শুরুর আগেই জুলে রিমে ট্রফিটি চুরি হয়ে যায় লন্ডনের একটি প্রদর্শনী থেকে। ট্রফির খোঁজে ইংলিশদের তখন ঘুম হারাম। শেষ পর্যন্ত ট্রফিটির খোঁজ এনে দেয় একটি কুকুর। পিকলস নামের ওই কুকুরটি লন্ডনের একটি পরিত্যক্ত এলাকায় পত্রিকা পেঁচানো অবস্থায় পড়ে থাকা ট্রফিটি উদ্ধার করে দেয়। ইতিহাসের অংশ হয়ে গেল ট্রফি উদ্ধার করা সেই কুকুরটিও। তবে তার আগে ইংলিশ কর্তৃপক্ষ বিশ্বকাপের জন্য একটি রেপ্লিকা ট্রফিও তৈরি করে নিয়েছিল। যেটি সংরক্ষিত রয়েছে ইংলিশ ন্যাশনাল ফুটবল মিউজিয়ামে।
১৬টি দলকে ভাগ করা হয় চার গ্রুপে। ইংল্যান্ড প্রথম ম্যাচে উরুগুয়ের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করলেও দ্বিতীয় ম্যাচ থেকে নিজেদের মেলে ধরতে শুরু করে। সবচেয়ে বেশি হতাশ করে ব্রাজিল। বুলগেরিয়ার বিপক্ষে ২-০ গোলে জয় পেলেও তাদের বিদায় নিতে হয় প্রথম রাউন্ড থেকেই। ইতালিও ১-০ গোলে উত্তর কোরিয়ার কাছে হেরে বিদায় নেয়।
১৯৬৬ বিশ্বকাপে সবচেয়ে চমক জাগানিয়া দল ছিল উত্তর কোরিয়া। বিশ্বকাপে প্রথম খেলতে এসেই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অঘটনগুলোর একটির জন্ম দেয় তারা। প্রথম ম্যাচে যদিও শক্তিশালী সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে ৩-০ গোলে হেরে যায়। দ্বিতীয় ম্যাচেই লাতিন আমেরিকান দেশ চিলির সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে চমক তৈরি করে তারা। সবচেয়ে বড় চমক তখনও ঝুলিতে পুরে রেখেছিল কোরিয়ানরা। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে তারা মুখোমুখি হয় ইতালির। চ্যাম্পিয়নশিপের দাবিদার ইতালি। কিন্তু ম্যাচের ৪২তম মিনিটে প্যাক ডু-ইকের গোলে ১-০ ব্যবধানে হেরে টুর্নামেন্ট থেকেই বিদায় নেয় ইতালি। উত্তর কোরিয়া উঠে যায় দ্বিতীয় রাউন্ডে।
দ্বিতীয় রাউন্ডেও চমক তৈরি করার শেষ মুহূর্তে চলে গিয়েছিল তারা। ২৫ মিনিটের মধ্যেই পর্তুগিজদের জালে তিনবার বল জড়িয়ে দেয় তারা। এরপরই যেন জ্বলে ওঠেন ‘কালো চিতা’ ইউসেবিও। শুধু হ্যাটট্রিকই নয়, চারটি গোল করলেন তিনি। পর্তুগাল ম্যাচ জয় করে নেয় ৫-৩ গোলে। সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের কাছেই পরাজয় মানতে হয় পর্তুগিজদের। সোভিয়েত ইউনিয়ন হেরে যায় পশ্চিম জার্মানির কাছে।
লন্ডনের বিখ্যাত ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামের ফাইনালে মুখোমুখি পশ্চিম জার্মানি আর স্বাগতিক ইংল্যান্ড। ৯৮ হাজার দর্শক উপস্থিত হয় ফাইনাল দেখতে। টান টান উত্তেজনা। এমন এক ম্যাচের শুরুতেই এগিয়ে যায় জার্মানি। হেলমুট হেলার ১২ মিনিটে গোল করে জার্মানিকে এগিয়ে দেন।
গোল খাওয়ার পরই আড়মোড়া ভেঙে প্রবল আক্রমণ শুরু করে ইংলিশরা। গোল হজমের মাত্র ৬ মিনিট পর স্বাগতিকদের সমতায় ফেরান জিওফ হাস্ট। ৭৮ মিনিটে মার্টিন পিটারস গোল করে ইংল্যান্ডকে ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে দিলেও ৮৯ মিনিটে উলফগ্যাঙ ওয়েবার গোল করে আবার সমতায় ফেরান জার্মানিকে।
নির্ধারিত সময় ৯০ মিনিটে দুই দলের দুটি করে গোলে খেলা ২-২ গোলে সমতা। নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পর খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। এরপর বাকি ইতিহাসটা শুধুই জিওফ হাস্টের। ১০১ আর ১২০ মিনিটে আরও দুটি গোল করলেন তিনি। আনন্দে ভাসালেন তিনি স্বাগতিক ইংলিশ সমর্থকদের। সে সঙ্গে বিশ্বকাপের ইতিহাসে ফাইনালে একমাত্র হ্যাটট্রিককারীও হয়ে রইলেন হাস্ট। পর্তুগালের ইউসেবিও সর্বোচ্চ ৯ গোল করে সেরা গোলদাতার পুরস্কার জেতেন। ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার নির্বাচিত হন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে।
আইএইচএস/জেআইএম