১৯৬২ : ভূমিকম্পও দমাতে পারেনি চিলিকে
১৯৫৪ ও ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপ ইউরোপে অনুষ্ঠিত হওয়ার পর আমেরিকার ফুটবল সংগঠকদের দাবি ছিল, পরের বিশ্বকাপ লাতিনেই আয়োজন করতে হবে। না হয় আমেরিকার (লাতিন এবং উত্তর) সব দেশ মিলে বিশ্বকাপ বয়টক করবে। শেষ পর্যন্ত ফিফা সিদ্ধান্ত নিল পরের বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে লাতিন আমেরিকায়। পশ্চিত জার্মানির সঙ্গে আর্জেন্টিনা আর চিলি ছিল আয়োজকের দাবিদার। পশ্চিম জার্মানি এমনিতেই বাদ, লাতিনে আয়োজন করা হবে বলে। শেষ পর্যন্ত ফিফার ভোটাভুটিতে চিলিই পেলো ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব।
মাত্র ২ বছর পর বিশ্বকাপের সপ্তম আসর বসতে যাচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলিতে। ৮টি স্টেডিয়ামসহ বিশ্বকাপের সব আয়োজন সম্পন্ন করে এনেছিল চিলিয়ানরা; কিন্তু ১৯৬০ সালের ২২ মে হঠাৎই শতাব্দীর ভয়াবহ ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হয়ে গেল চিলি। রাজধানী সান্তিয়াগো দে চিলি থেকে ৫৭০ কিলোমিটার দূরে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে উৎপত্তি হওয়া এই ভয়াবহ ভূমিকম্প চিলিতে আঘাত হানে রিখটার স্কেলে ৯.৫ মাত্রায়। ভূমিকম্পটি স্থায়ী ছিল অন্তত ১০ মিনিট।
ভূমিকম্প থেকে উৎসারিত সুনামি ছুঁয়ে যায় জাপান, হাওয়াই, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিলিপাইনসহ আরও অনেক দেশকে। চিলির উপকুলে ৮২ ফুট উঁচু ঢেউ এবং জলোচ্ছাস আঘাত হানে। ২ কোটিরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মৃত প্রায় ৭ হাজার, বর্তমান মূল্যে প্রায় সাড়ে তিন থেকে সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি আর্থিক ক্ষতি। চিলিকে নিয়ে গেল একেবারে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
১৯৬২ বিশ্বকাপ আয়োজকের অন্য দাবিদার আর্জেন্টিনা বলল, ‘যেহেতু ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত চিলি, তাই আমরাই বিশ্বকাপের আয়োজন করি!’ কিন্তু ভয়াবহ ভূমিকম্পের পরও মানসিক দিক থেকে যারা ভেঙে পড়েনি তাদের কি অন্য কোনো শক্তি দিয়ে ভাঙা যায়?
চিলি বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক কমিটির সভাপতি কার্লোস ডিটবর্ন জানিয়ে দেন, ‘সব কিছুই হারিয়েছি আমরা, আপন শক্তি দিয়েই আবার সব নতুন করে গড়ে নেব।’ এ কথাটাই শেষ পর্যন্ত হয়ে গেল বিশ্বকাপের আন-অফিসিয়াল স্লোগান। অদম্য চিলিয়ানরা ২ বছর পর ঠিকই আয়োজন করে ফেললো বিশ্বকাপের সপ্তম আসর। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য, যার অদম্য মনোবল আর মানসিক শক্তিতে ধ্বংসস্তুপ থেকে দাঁড়িয়ে বিশ্বকাপ আয়োজন করলো চিলি, সেই ডিটবর্ন টুর্নামেন্ট শুরুর মাত্র ১ মাস আগে মৃত্যু বরণ করলেন। দেখে যেতে পারলেন না এত বড় আয়োজনের সফল সমাপ্তি।
ডিটর্বনের মৃত্যুর কারণে আরিকা স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন করে দেয়া হয়। বিশ্বকাপের ঠিক আগমুহূর্তে এই স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয় এস্টাডিও কার্লোস ডিটবর্ন। ১৯৬২ চিলি বিশ্বকাপ পরিচিত হয়ে রেয়েছে নৃশংসতার এক বিশ্বকাপ হিসেবে। প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই খেলার চেয়ে তুমুল মারামারিই হয়েছে বেশি।
গ্রুপ পর্বে ইতালি-চিলি ম্যাচটি তো হয়ে রইল ‘ব্যাটল অব সান্তিয়াগো’ নামে। সেই ম্যাচে স্বাগতিক চিলি আর ইতালির ফুটবলাররা মাঠে খেলার পরিবর্তে মারামারিতেই ব্যস্ত ছিলেন বেশি। ইংলিশ রেফারি কেন অ্যাস্টন দুজন ইতালিয়ান ফুটবলারকে লাল কার্ড দেখিযে মাঠ থেকে বের করে দেন। চিলিয়ান সমর্থকরা তো পুরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ইতালি ফুটবলারদের ওপর। যে কারণে, ম্যাচ শেষে পুলিশি নিরাপত্তা বেস্টনির মধ্য দিয়ে মাঠ ছাড়তে হয় চিলিকে। শেষ পর্যন্ত ২-০ ব্যবধানে ম্যাচটি জিতে নেয় স্বাগতিক চিলি। এই চিলিই শেষ পর্যন্ত যুগোস্লাভিয়াকে হারিয়ে হয়েছিল টুর্নামেন্টের তৃতীয় সেরা দল।
ইউরোপ থেকে বিশ্বকাপ জেতার পর নিজ মহাদেশ লাতিন আমেরিকা থেকেও বিশ্বকাপ জিতে নিল ব্রাজিল। ১৯৩৪, ৩৮ সালে ইতালির টানা দুবার বিশ্বকাপ জয়ের পর টানা দু’বার বিশ্বকাপের শিরোপা জয়ের কৃতিত্ব দেখাল ব্রাজিল; কিন্তু এই বিশ্বকাপে ব্রাজিলিয়ান পেলে তার কৃতিত্ব পুরোপুরি দেখাতে পারলেন না। গ্রুপ পর্বে চেকোস্লোভাকিয়ার ফুটবলাররা তাকে এমন মারা মেরেছিল যে পুরো টুর্নামেন্ট থেকেই বাইরে চলে যেতে হয়েছিল তাকে।
১৯৫৮ সালে যে দলটি নিয়ে শিরোপা জিতেছিল ব্রাজিল, ৪ বছর পর সেই একই দল রাখা হলো। ১৭ বছরের তরুণ পেলে এই বিশ্বকাপে ২১ বছরের যুবক। ২৫ বছরের গ্যারিঞ্চাও একই উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে এসেছেন তখন। ১৯৫৮ সালের শিরোপা পেলের আর ১৯৬২’র শিরোপা হয়ে রইল গ্যারিঞ্চার বিশ্বকাপ হিসেবে।
পেলে ছিলেন না। কিন্তু এই দলটিতে তো ছিলেন ‘লিটল বার্ড’গ্যারিঞ্চা আর ‘সাদা পেলে’ আমারিল্ডোর। এ দু’জনের অসাধারণ ফুটবল নৈপুণ্যে শিরোপা দ্বিতীয়বারের মতো গেল ব্রাজিলের ঘরে। গ্যারিঞ্চা বলতে গেলে একাই বিশ্বকাপ জেতান ব্রাজিলকে।
গ্রুপ পর্বে প্রথম ম্যাচে মেক্সিকোর বিপক্ষে একটি গোলও করেছিলেন পেলে; কিন্তু পরের ম্যাচে চেকেস্লোভাকিয়ানদের হার্ড ট্যাকল পেলেকে পুরো টুর্নামেন্ট থেকেই দূরে ঠেলে দেয়। তার পরিবর্তে নিয়মিত খেলেন আমারিল্ডো। ফাইনালে আমারিল্ডো, ভাভা, জিতোদের গোলেই চেকোস্লোভাকিয়াকে ৩-১ গোলে হারিয়ে শিরোপা জিতে নেয় ব্রাজিল। গ্রুপ পর্বে চেকোস্লোভাকিয়ার সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করেছিল সেলেসাওরা।
১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপের নিয়মগুলোই বহাল রাখা হয় ১৯৬২ বিশ্বকাপে। ব্রাজিল, ইতালি, ইংল্যান্ড, উরুগুয়েকে শীর্ষ চার দেশ ধরে ১৬টি দলকে ভাগ করা হয় চার গ্রুপে। চার গ্রুপ থেকে শীর্ষ ৮টি দল নিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল। এরপর সেমিফাইনাল, ফাইনাল।
১৯৬২ বিশ্বকাপ থেকেই অংশগ্রহণকারী দলগুলো রক্ষণভাগকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে খেলতে থাকে। এ কারণে এই বিশ্বকাপেই প্রথম গোল গড়ের সংখ্যা নেমে আসে ৩-এর নিচে। ৩২ ম্যাচে মোট ৮৯ গোল (২.৭৮ গড়ে)। একটি মাত্র হ্যাটট্রিক করেন গ্রুপ পর্বে হাঙ্গেরির স্ট্রাইকার আলবার্ট, বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডকে ৩-১ আর সেমিফাইনালে স্বাগতিক চিলিকে ৪-২ গোলে পরাজিত করে ফাইনালে ওঠে ব্রাজিল।
এককভাবে সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন না এই বিশ্বকাপে। ব্রাজিলের গ্যারিঞ্চা, ভাভা, চিলির লিওনেল সানচেজ, হাঙ্গেরির ফ্লোরিয়ান আলবার্ট, রাশিয়ার ভ্যালেন্টিন ইভানভ এবং রাজান জেরকোভিক ৪টি করে গোল করে শীর্ষে থাকে। তবে হাঙ্গেরির ফ্লোরিয়ান আলবার্টকেই ঘোষণা করা হয় টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে।
আইএইচএস/পিআর