ফিফায় বাংলাদেশের কিরণ
এগিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের নারীরা। দেশের গণ্ডি পেড়িয়ে এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের নারীদের গৌরবময় পথচলা। তারই ধারাবাহিকতায় ক্রীড়াঙ্গনে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন মাহফুজা আক্তার কিরণ। বাংলাদেশের প্রথম কোনো সংগঠক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফার সদস্য। যে পদটি যে কোনো সংগঠকের জন্য স্বপ্নের মত।
কিরণের এ সাফল্য এসেছে ভোটের লড়াইয়ে জিতে। ২০১৭ সালের ৮ মে মাহফুজা আক্তার কিরণ হারিয়েছেন এশিয়ার ফুটবলের পরাশক্তি, বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রায় নিয়মিত খেলা অস্ট্রেলিয়ার ময়াডোডকে। ভোটের পার্থক্য ২৭-১৭। ফিফার মেম্বার্স অ্যাসোসিয়েশন কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়ে মাহফুজা আক্তার কিরণ যেমন সংগঠক হিসেবে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায় তেমনি বাংলাদেশের নারী ফুটবলকেও বিশ্ব দরবারে পরিচিত করেছেন নতুন করে।
ফিফা কাউন্সিলে যে ৬টি কনফেডারেশনের মহিলা প্রতিনিধি আছেন তাদের ৫ জনই মনোনীত। একমাত্র মাহফুজা আক্তার কিরণ সেখানে নির্বাচিত সদস্য। বাংলাদেশের কোনো ক্রীড়া সংগঠক বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থার সদস্য নির্বাচিত হবেন তা ছিল কল্পনার বাইরে। মাহফুজা আক্তার কিরণ সব কল্পনা ছাড়িয়ে জায়গা করে নিয়েছেন বিশ্বের খেলাধুলার সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী সংস্থাটির নির্বাহী কমিটিতে। এটা বাংলাদেশেন নারী সমাজের বিশাল বিজয়, অসাধারণ এক অর্জন।
ফুটবলে বাংলাদেশের নারীরা যে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে তারও একটি স্বীকৃতি ২৭ টি দেশ কিরণকে সমর্থন দেয়া। এটা কেবল মাহফুজা আক্তার কিরণের ব্যক্তিগত বিজয়ই নয়, এটা দেশের নারীদেরও বিরাট এক বিজয়। বাংলাদেশের নারীরা যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সংগঠনেও নেতৃত্ব দিতে পারেন তা দেখিয়েছেন মাহফুজা আক্তার কিরণ।
ফিফার সদস্য হওয়া ছাড়াও মাহফুজা আক্তার কিরণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানাভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ফিফার ম্যাচ কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছেন অনূর্ধ্ব-২০ মহিলা বিশ্বকাপ ও যুব মহিলা বিশ্বকাপে। ফিফার প্লেয়ার্স স্ট্যাটাস কমিটিরও ডেপুটি চেয়ারম্যান তিনি। এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের (এএফসি) কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য কিরণ সংস্থাটির মহিলা কমিটিরও সদস্য। তিনি ফিফা অনূর্ধ্ব-২০ মহিলা বিশ্বকাপের সাংগঠনিক কমিটির সদস্য, দক্ষিণ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের (সাফ) মহিলা কমিটির ডেপুটি চেয়ারম্যান এবং অলিম্পিক কাউন্সিল অব এশিয়ার (ওসিএ) অ্যাথলেটিক কমিটির সদস্য হিসেবেও কাজ করেছেন।
সংগঠক হিসেবে একের পর সাফল্য মাহফুজা আক্তার কিরণকে তুলেছে বিশ্বমঞ্চে। তিনি বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদিকা ছিলেন। একই সময় তিনি নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের (বিওএ)। ২০১০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান (এসএ) গেমসে মাহফুজা আক্তার কিরণ ছিলেন বাংলাদেশ কন্টিনজেন্টের জেনারেল ম্যানেজার। ওই গেমসে বাংলাদেশ রেকর্ড ১৮ স্বর্ণ, ২৪ রৌপ্য ও ৫৫ ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছিল।
দক্ষিণ এশিয়া ছাড়িয়ে নারী ফুটবলে বাংলাদেশ এখন এশিয়াতেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে মেয়েদের আন্তর্জাতিক বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতাগুলোতে। গত বছর সেপ্টেম্বরে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবলে দুর্দান্ত খেলেছে অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও উত্তর কোরিয়ার মতো দেশের সঙ্গে। কোন ম্যাচ জিততে না পারলেও প্রশংসা কুড়িয়েই ঘরে ফিরেছেন বাংলাদেশের মেয়েরা। ডিসেম্বরে ঢাকায় বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৫ নারী ফুটবল দল দক্ষিণ এশিয়ার সেরা হয়েছে ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে। দেশের নারী ফুটবলের সব অগ্রযাত্রার নেতৃত্বে দেশের সবচেয়ে বড় এ ক্রীড়া সংগঠকের। নারীদের ফুটবলের এই যে এগিয়ে যাওয়া তার পেছনের কারিগর মাহফুজা আক্তার কিরণ।
২০০৮ সাল থেকে বাফুফের সঙ্গে সম্পৃক্ত তিনি। এক সময় বাফুফের মহিলা উইংয়ের ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন তিনি মহিলা উইংয়ের চেয়ারম্যান। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত বাফুফের নির্বাচনে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেন প্রথম নারী হিসেবে কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়ে। কিরণ শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের আজীবন সদস্য। শিক্ষা জীবনে ছাত্রলিগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন মাহফুজা আক্তার কিরণ।
মেয়েদের ফুটবলে গত ১০ বছরে সাফল্যগুলো এসেছে কিরণের নেতৃত্বে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ২০১০ ঢাকা এসএ গেমসে ব্রোঞ্জ পদক এবং ২০১৫ সালে নেপালে এবং ২০১৬ সালে তাজিকিস্তানে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ সাউথ অ্যান্ড সেন্ট্রাল রিজিওনাল চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জয়, ২০১৬ সালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ নারী চ্যাম্পিয়শিপের ঢাকা পর্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন। এটি দেশের যে কোনো পর্যায়ের ফুটবলে প্রথম দল হিসেবে এশিয়ার সেরা আটে খেলা।
১৯৯৬ সালে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সদস্য হওয়ার মধ্যে দিয়ে সংগঠক হিসেবে অভিষেক হয় তার। খেলাধুলার প্রতি কিরণের ভালোবাসা দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের সাবেক জিএস আওয়ামী লিগ নেত্রী শামসুন্নাহার চাঁপা তাকে নিয়ে আসেন মহিলা ক্রীড়া সংস্থার অ্যাডহক কমিটিতে। সাংগঠনিক দক্ষতা দিয়ে সদস্য থেকে যুগ্ম সম্পাদক এবং সাধারণ সম্পাদিকার দায়িত্ব পালন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জন-প্রশাসন বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাস করা কিরণ।
খেলাটাকে ভালোবেসেছিলেন সেই স্কুল জীবন থেকেই। স্কুল থেকে কলেজ, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়-সম্পৃক্ত থেকেছেন খেলার সঙ্গে। খেলাধুলাটা সেভাবে না করলেও খেলাধুলা আয়োজনের সম্পৃক্ততা ও খেলার প্রতি ভালোবাসা মাহফুজা আক্তার কিরণকে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়। ধানমন্ডির মহিলা ক্রীড়া সংস্থার কার্যালয় থেকে কিরণ জুরিখে ফিফার দফতরে।
আরআই/এমআর/আরআইপি