এখনো আলোচনায় মোনেম মুন্নার সেই ২০ লাখ
আগে ফুটবলে ছিল লাখ লাখ দর্শক। এখন লাখ লাখ টাকা। কোটিও চলে এসেছে। মানে অর্ধকোটি। এখন অনেক ফুটবলারই মৌসুমে অর্ধকোটি টাকা পারিশ্রমিক পান। দিন দিন গ্যালারি শূণ্যের দিকে এগিয়ে গেলেও ফুটবলারদের পারিশ্রমিক দৌঁড়াচ্ছে কোটির দিকে।
সাড়া বছর মুখে মুখে থাকে একটাই হাহাকার-ফুটবলে দর্শক নেই। দলবদল আসলে মুখে মুখে টাকা আর টাকা। অমুক খেলোয়াড় এত টাকায় অমুক ক্লাবের সঙ্গে কথা পাকা করেছেন-এমনই থাকে আলোচনায়। এই ফুটবলে এত টাকা?-এমন প্রশ্ন তুলে মুখও ভেঙান অনেকে। কেউ কেউ ফোঁড়ন কাটেন-ফুটবলে লাথি দিতে পারলেই তো লাখ লাখ টাকা!
এই তো, গেলো মৌসুমে স্থানীয় ফুটবলারদের পারিশ্রমিক ৬০ লাখ টাকা ছুঁই ছুঁই করেছে। আবাহনী ছেড়ে তপু বর্মন ৫৮ লাখ টাকায় নতুন দল সাইফ স্পোর্টিং ক্লাবে নাম লিখিয়েছিলেন-এমনই ছিল আলোচনা। ৫০ লাখ থেকে ৫৫ লাখের মধ্যে পারিশ্রমিক ছিল আরো কয়েকজনের।
অনেকের ধারণা, এবার আরো বেড়ে যাবে ফুটবলারদের পারিশ্রমিক। খেলোয়াড়ের সঙ্কট আর বিত্তবান নতুন নতুন ক্লাব আসায় ফুটবলারদেরও যে পোয়াবারো। স্বাধীনতা কাপের মধ্যে দিয়ে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্দা নেমেছে ফুটবল মৌসুমের। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলো দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছে খেলোয়াড় সংগ্রহে। অনেকেই নতুন মৌসুমের জন্য দল চূড়ান্তও করে রেখেছেন।
এখন একটু ভালো মানের ফুটবলারদের পারিশ্রমিক ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকার মধ্যে। তারকা বনে গেলে তো কথাই নেই। এক লাফে আরো পাঁচ/সাত লাখ টাকা। কিন্তু এখন ফুটবলাররা এত টাকা পারিশ্রমিক পেলেও তা কয়জনে জানেন? কেইবা মনে রাখেন? যদি ১৭ বছর আগে প্রয়াত মোনেম মুন্নার কথা ওঠে তাহলে সবাই গড়গড় করে বলে দেবেন।
১৯৯১ সালে মোনেম মুন্না আবাহনী থেকে পেয়েছিলেন ২০ লাখ টাকা। ওই সময় এটা কেবল বাংলাদেশের কোনো ফুটবলারেরই রেকর্ড পারিশ্রমিক নয়, উপমহাদেশেও এটা ছিল একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী খবর।
মোনেম মুন্না মারা গেছেন ২০০৫ সালের আজকের দিনে। স্থানীয় ফুটবলারররা তার রেকর্ড ভেঙেছেন, সেটা জীবদ্দশাতেই দেখে গেছেন মোনেম মুন্না। তার মৃত্যুর পর বিগত বছরগুলোতেই ফুটবলাদের পারিশ্রমিক তরতর করে বেড়েছে। কিন্তু মোনেম মুন্নার সেই ২০ লাখ টাকা এখনো আলোচনার শীর্ষে।
প্রতি বছর ১২ ফেব্রুয়ারি আসলে মোনেম মুন্নাকে মানুষ মনে করেন। তার বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয় স্বজনরা এই দিনে মিলাদ মাহফিল, আলোচনা সভা, কাঙ্গালিভোজের আয়োজন করেন। মুন্না কেমন ফুটবলার ছিলেন, ব্যক্তি মুন্না কেমন ছিলেন-এসব আলোচনার মধ্যে ঠিকই জায়গা করে নেয় ওই ২০ লাখ টাকার গল্প।
হালের ফুটবলারদের অনেকেই এখন মোনেম মুন্নার সেই ২০ লাখের চেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পান। কেউ কেউ প্রায় ৩ গুণ। তাহলে এখনো কেনো আলোচনায় ১৯৯১ সালে আবাহনীর দেয়া ২০ লাখের গল্প? সাবেক তারকা ফুটবলার এবং বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সিনিয়র সহ সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদীর দৃষ্টিতে ২০ লাখ টাকার চেয়ে ফুটবলার মুন্নাই বড় ব্যাপার।
‘মুন্না একজন বড় মাপের ফুটবলার ছিলেন। ওই সময় মুন্না কোন ক্লাবে খেলবেন, কত টাকা পাবেন এটা নিয়ে মানুষের আগ্রহ ছিল। কারণ, মুন্না তো ছিলেন একটা ব্র্যান্ড। তা শুধু বাংলাদেশেরই নয়, এ অঞ্চলেরও। পারিশ্রমিককে তাই আমি বলবো সেকেন্ডারি। খেলোয়াড়টি মুন্না ছিলেন বলেই এত আলোচনা। বলতে দ্বিধা নেই, এখন যারা তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ পান, তাদের তো মাঠে জার্সি দেখে চিনতে হয়। মুন্না ক্লাবকে ভালোবাসতেন, ফুটবলকে ভালোবাসতেন। এখন অনেকেই ফুটবল খেলেন। তবে ফুটবলের প্রতি তাদের সেই ভালোবাসা নেই।’-বলছিলেন আবদুস সালাম মুর্শেদী।
মোনেম মুন্নার সেই পারিশ্রমিক এখনো আলোচনায় জায়গা করে নেয়া প্রসঙ্গে মোহামেডানের স্ট্রাইকার জাহিদ হাসান এমিলি বলেন, ‘ওই সময়ের ২০ লাখ টাকার তুলনায় এখনকার ৬০ লাখ টাকা কিছু না। এখন কোন ফুটবলার ৫০ লাখের বেশি পারিশ্রমিক পান, তা কেউ জানে না। কিন্তু মুন্না ভাইয়ের ২০ লাখ টাকা পাওয়ার খবর কেবল বাংলাদেশেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেও ছড়িয়ে গিয়েছিল। তখনকার দিনে এটা ছিল বিশাল এক ঘটনা।’
মোনেম মুন্না মাঠ দাপিয়ে ফুটবল খেলেছেন দুই বাংলায়ই। ১৯৮০-৮১ সালে পাইওনিয়ার লিগের পোস্ট অফিস দলের হয়ে ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল তার। এরপর ১৯৮২ সালে দ্বিতীয় বিভাগের দল শান্তিনগর, ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত খেলেছেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রে দ্বিতীয় ও প্রথম বিভাগে। ১৯৮৬ সালে গোপীবাগের দল ব্রাদার্স ইউনিয়নে। ১৯৮৭ থেকে ৯৭ পর্যন্ত খেলেন আবাহনীতে। মাঝে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত কলকাতার মাঠ কাঁপিয়েছেন ইস্ট বেঙ্গলের জার্সি গায়ে।
১৯৯৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মুন্না বিয়ে করেন ইয়াসমিন সুরভিকে। বিয়ের একযুগ পর ২০০৫ সালে সেই ১২ ফেব্রুয়ারিতেই তিনি চলে যান পৃথিবী ছেড়ে।
আরআই/এমএমআর/আরআইপি