ভিডিও EN
  1. Home/
  2. খেলাধুলা

এই মেসি অন্যগ্রহের

ইমাম হোসাইন সোহেল | প্রকাশিত: ০৬:০২ এএম, ১১ অক্টোবর ২০১৭

২০১০ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির কাছে হেরে বিদায়ের পর মেসির কান্নার দৃশ্য এখনও চোখে ভাসে। ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে সেই জার্মানির কাছে হেরেই যখন ট্রফিশূন্য থাকতে হলো মেসিকে, এবং এরপর তার সেই শূন্য দৃষ্টি এখনও ভুলতে পারেনি আর্জেন্টিনার সমর্থকরা। এরপর তো টানা দুটি কোপা আমেরিকার ফাইনাল। স্বপ্নভঙ্গের বেদনার উপাখ্যান রচিত হয়েছিল বার বার। মেসি নামক গ্রহের সেরা ফুটবলারকে শূন্য হাতে ফেরত পাঠিয়েছিল ফুটবল।

ক্ষোভে-দুঃখে আন্তর্জাতিক ফুটবলকেই বিদায় জানিয়ে ফেলেছিলেন মেসি। কিন্তু তার বিদায় কী এত সহজে মেনে নিতে পারেন ভক্তরা! আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত মেসিকে ফেরানোর আন্দোলনে সামিল হয়ে গিয়েছিলেন। বুয়েন্স আয়ার্সের রাজপথ থেকে শুরু করে সারা বিশ্বের কোটি কোটি ভক্তের হৃদয়ের গভীরে তৈরি হয়েছিল তুমুল আন্দোলন। সেই আন্দোলনে আন্দোলিত হলেন মেসিও। ফিরে এলেন আবার মর্ত্যের পৃথিবীতে।

কিন্তু ফুটবল যেন নির্দয় একটি গোলক। নিদারুণ এক রহস্যের জাল। সেই জাল ভেদ করা বুঝি মেসির মত জাদুকরের পক্ষেও সম্ভব নয়! না হয়, এমন হেঁয়ালি কেন হবে বার বার তার সঙ্গে! যে দেশটি শেষ বিশ্বকাপের ফাইনালিস্ট। টানা দুটি কোপা আমেরিকার ফাইনাল খেলেছে, তারাই কি না বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব থেকে বিদায় নেয়ার পথে!

টাটা মার্টিনো থেকে শুরু করে এডগার্ডো বাউজা। এরপর এলেন হোর্হে সাম্পাওলি। জাদুকরি কোচ হিসেবেই পরিচিতি সাম্পাওলির। বিশ্বকাপে তোলার জন্য তার ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিল আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশন।

কিন্তু সেই যেন নিয়তির হেঁয়ালিপনা! সাম্পাওলিও জেতাতে পারছিলেন না আর্জেন্টিনাকে। টানা তিনটি ম্যাচ শেষ হলো অমিমাংসিত। কোনো গোলই করতে পারেনি আর্জেন্টাইন ফুটবলাররা। মেসিও না।

একেবারে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে। কেউ কেউ বলছিলেন, আইসিইউতে চলে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। বেঁচে ছিল কোনোমতে লাইফ সাপোর্টে। সেখান থেকে চরম আত্মবিশ্বাস নিয়ে, একটি ঝাড়া দিয়ে শুধু জেগে ওঠার ডাকটা দিতে হবে কাউকে। সেই কাজটা কে করবেন? মেসি ছাড়া এই দলে আর কে আছে? কাজটা তো মেসিকেই করতে হবে। বাকি ১০জনের কাজ হবে, যে কোনোভাবেই হোক সেই ডাক দেয়ার শক্তিটা জোগান দেয়া।

সহজ কাজ নয় মোটেও। যে দেশে গিয়ে ২০০১ সালের পর আর জিততে পারেনি আর্জেন্টিনা। আরেকটু এগিয়ে গেলে, ১৯৬০ সালের পর ইকুয়েডরের মাঠে শুধুমাত্র ২০০১ সালেই একটি মাত্র ম্যাচ জিততে পেরেছিল লা আলবিসেলেস্তেরা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯ হাজার ফুট উুঁচুতে। ওই একটি ম্যাচছাড়া এত উচ্চতায় এর আগে কোনো ম্যাচই জিততে পারেনি আর্জেন্টাইনরা।

ইকুয়েডরকে হারাতে হবে। সঙ্গে অনেক হিসাব-নিকাশও মিলতে হবে। তবেই মিলবে রাশিয়া বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার টিকিট। এত উুঁচুতে পারবে আর্জেন্টিনা? এটাই ছিল বড় প্রশ্ন। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মত অবস্থা লিওনেল মেসিদের। কোনোভাবেই ফিরে আসা যাবে না। একেবারে শেষ সুযোগ। বিশ্বকাপের ফাইনালও বুঝি এর চেয়ে সহজ! ফাইনালই তো। এ ছাড়া একে আর কোনোভাবেই যে ভাবতে রাজি ছিলেন না আর্জেন্টিনা কোচ সাম্পাওলি!

সারা বিশ্ব তাকিয়েছিল কিউটোর দিকে। ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনো জানিয়েছিলেন, তিনি চান মেসি খেলুক রাশিয়ায়। এখনও যে মেসির বিশ্বকাপ জয়ের সামর্থ্য আছে! তাহলে তো সর্বকালের সেরা ফুটবলার হতে মেসির অন্য কিছুর প্রয়োজনই হবে না! ব্রাজিলের নেইমার বলেছেন, ‘যে করেই হোক মেসিকে নিয়েই রাশিয়ায় বিশ্বকাপ খেলতে চাই।’ সে জন্য অবশ্য নেইমারদের প্রয়োজন ছিল চিলিকে হারানো। সে কাজটি তারা যথাযথভাবেই সম্পাদন করেছে।

নিজেদের কাজটিও তো করতে হবে! কিন্তু সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়ে যে ৪০ সেকেন্ডেই গোল হজম করে বসলো আর্জেন্টিনা! উচ্চতা রোগ কী তবে ভালোভাবেই ঝেঁকে বসেছে আর্জেন্টাইনদের ওপর?

তবুও শেষ পর্যন্ত ভরসা, আর্জেন্টিনা দলটিতে একজন জাদুকর আছেন না! জাদুকররা নিজের আসল জাদুমন্ত্রটা বের করে আনেন একেবারে শেষ মুহূর্তে। এখানে তো আর জাদুর কোনো শো নয়, চলছিল জীবন-মরণ খেলা। জিতলে বেঁচে থাকবে, হারলে বিদায়। মৃত্যু অনিবার্য।

হ্যাঁ, মৃত্যুই তো। আর্জেন্টিনা হারলে যে কত পাগল সমর্থক হার্ট অ্যাটাক করে মারা যেতো, তার কোনো ইয়ত্তা থাকতো না। আর্জেন্টিনা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তো আগাম সতর্কতাই জারি করেছিল। তাদের ধারনা, নিজেদের মাঠে পেরুর বিপক্ষেও যেভাবে জিততে পারেনি মেসিরা, ইকুয়েডরের মাঠে যদি জিততে না পারে, তাহলে তো কিছু কিছু সমর্থক হার্ট অ্যাটাক করতেই পারে। সে কারণে সতর্কতা, ‘ডোন্ট ডাই ফর আর্জেন্টিনা ফুটবল।’

জাদুকর তার শেষ মন্ত্রটা ঝেড়ে দিলেন। যার ফলে দুর্দান্ত এক হ্যাটট্রিক। ম্যাচের ১২ মিনিটে বাঁ-পায়ের টোকায় সমতায়। ২০ মিনিটে বাম পায়ের দুর্দান্ত শটে লিড এবং ৬২ মিনিটে বাম পায়ের দারুণ এক লবে জয় নিশ্চিত। সবই যেন বাম পায়ের খেল।

মেসির ক্যারিয়ারে ৪৪তম হ্যাটট্রিকের সঙ্গে নিশ্চিত হলো বিশ্বকাপে খেলাও। আগের ৪৩টি হ্যাটট্রিক অবশ্যই স্মরণীয়; কিন্তু ৪৪তম হ্যাটট্রিকটার কথা কী তিনি সত্যি সত্যি কখনও ভুলতে পারবেন! জীবন বাঁচানোর সত্যিকার দাওয়াই হয়েই যে হাজির হলো, তার এই হ্যাটট্রিক!

আগেরদিনই কোচ সাম্পাওলি শিষ্যদের উদ্দেশ্যে বলে দিয়েছিলেন, ‘সবাইকে মেসি হতে হবে। না হয়, আসল কাজটাই সিদ্ধ হবে না।’ তার আগে মেসিকে কোচ বলেছিলেন, ‘ইকুয়েডরের বিপক্ষে বার্সার মেসিকে ছাই।’

কোচের কথায় বাকিরা মেসি হতে পেরেছে কি না সেটা গবেষণার দাবি রাখে। কিন্তু মেসি যে সত্যি ‘মেসি’ হয়ে উঠেছিলেন এই ম্যাচে! বার্সার হয়ে অনেক ম্যাচেই তিনি অবতীর্ণ হন ত্রাতার ভুমিকায় তার পায়ের জাদুকরি গোলে পরাস্ত হয় প্রতিপক্ষ দলগুলো।

কিন্তু জাতীয় দলে এমন পারফরম্যান্স বুঝি দেখানোর বাকি ছিল! নিজেকে প্রমাণ করারও বাকি ছিল। সেই বাকি কাজটাই করে দেখালেন তিনি। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর আহত বাঘের গর্জন ছেড়ে স্বরূপে আবির্ভূত হলেন। এ ধরনের ম্যাচে তো এমন মেসিকেই চেয়েছিলেন ভক্তরা! ইকুয়েডরের বিপক্ষে পুরো মাঠে খেললেন তিনি। বাকিরা ছিলেন শুধু দর্শক।

কিভাবে ড্রিবলিং, ডজ আর অসাধারণ স্কিল দিয়ে প্রতিপক্ষকে পুরোপুরি পরাস্ত করে দেয়া যায়, সেটা দেখিয়ে দিলেন তিনি। শেষ গোলটিতে বল নিয়ন্ত্রণে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত যেন আশপাশে দেখেছিলেন। এরপর চিতার মত্র ক্ষিপ্র গতির এক দৌড়। তার এই দৌড়ের কাছে যেন উসাইন বোল্টও পেছনে পড়ে যাবেন। দু’তিনজন ডিফেন্ডারকে পেছনে ফেলে বাম পায়ের ট্রেডমার্ক কিক। বল জড়িয়ে গেলো ইকুয়েডরের জালে। জাদুকর মেসি দেখিয়ে দিলেন, তিনি সত্যি সত্যি এই গ্রহের নন। ভিনগ্রহের কেউ একজন।

ম্যাচ শেষ হওয়ার কয়েক সেকেন্ড আগেই ডাগআউটে সারি বেধে দাঁড়িয়ে গেলেন আর্জেন্টিনার ব্যাক বেঞ্চের ফুটবলার এবং কোচিং স্টাফরা। যোগ্য সেনাপতির মত দৌড়ে দৌড়ে শেষ নির্দেশনা দিচ্ছিলেন হোর্হে সাম্পাওলি। রেফারির শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসের ঢেউ। সেই ডেউয়ের ধাক্কা এসে লাগলো বাংলাদেশের কোটি মানুষের হৃদয়েও। দৌড়ে মাঠে চলে এলেন সাম্পাওলি। জড়িয়ে ধরলেন জাদুকর মেসিকে। তুলে নিলেন বুকের মধ্যে। এ যেন পরম সান্নিধ্যে প্রিয় শিষ্যের হারিয়ে যাওয়া।

ম্যাচের পর সাম্পাওলির উচ্চকিত কণ্ঠ, ‘মেসি দেখিয়ে দিয়েছে, কেন সে বিশ্বসেরা। বিশ্বের সেরা ফুটবলারটি হচ্ছেন মেসি। সৌভাগ্যক্রমে সে আর্জেন্টিনার। বিশ্বকাপ কোনোভাবেই মেসিকে ছাড়া অনুষ্ঠিত হতে পারে না। এটাও তার মাথায় ছিল। একের পর এক চাপের কারণে এখন আমরা অনেক শক্তিশালী। বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে এখন আমরা আরও দুর্দান্ত। বিশ্বকাপেও দেখা যাবে এই আর্জেন্টিনাকে।’

আইএইচএস/আইআই

আরও পড়ুন