বিসিবির পরিচালক পর্ষদের বেশিরভাগই আওয়ামী ঘরানার
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই দেশের সর্বত্র পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। দেশের অন্য সব সেক্টরের মত ক্রীড়াঙ্গনেও পরিবর্তনের বাতাস দাবি উঠেছে। বিসিবি, বাফুফেসহ শীর্ষ ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোয় পরিবর্তন আনার দাবিতে সোচ্চার বিগত প্রায় ১৬ বছরের বেশি সময় আওয়ামী লীগ আমলে উপেক্ষিত, অবমূল্যায়িত ক্রীড়া সংগঠকরা। বলার অপেক্ষা রাখে না, আওয়ামী লীগের সর্বশেষ গত প্রায় দেড় যুগ দেশের সব ক্রীড়া ফেডারেশনের প্রধানসহ শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন আওয়ামীপন্থীরা।
এটুকু শুনে হয়তো মনে হতে পারে, গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই বোধ হয় এমন দলীয় মানুষজনদের ক্রীড়াঙ্গনে জড়ানো হয়েছে। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের ক্রীড়া সংস্কৃতিতে এমন চর্চা বেশ পুরোনো। বেশিরভাগ সময় যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তাদের আশপাশের মানুষজনই ক্রীড়াঙ্গনের হর্তাকর্তা হয়ে বসে পড়েন।
তবে ব্যতিক্রম ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত বিএনপি সরকারের আমলে। ওই সময় ক্রীড়ামন্ত্রী ছিলেন বিএনপির জাঁদরেল নেতা সাদেক হোসেন খোকা। ছাত্রজীবন শেষেই ঢাকার ক্লাব ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে জড়িত সাদেক হোসেন খোকা রাজধানীর প্রায় সব ক্লাব কর্তাকেই চিনতেন, জানতেন।
আর তাই তার আমলে বিসিবি, বাফুফে ও হকি ফেডারেশনে বিএনপির পাশাপাশি আওয়ামী ঘরানারও বেশ কয়েকজনকে ফেডারেশনে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন সাবের হোসেন চৌধুরী, আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি ও দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল। তারা সবাই ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত বিসিবির নির্বাহী কমিটিতে ছিলেন। যা পরবর্তীতে আর দেখা যায়নি। এবং সর্বশেষ আওয়ামী লীগ আমলে দলীয়করণ চরমে উঠে। গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগ, আবাহনী ও শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের বাইরে কাউকে ক্রিকেট বোর্ডে বড় পদে দেখা যায়নি।
প্রশ্ন উঠেছে, বিসিবি পরিচালক পর্ষদের কে কে সরাসরি আওয়ামী লিগের রাজনীতির সাথে জড়িত? বিসিবি পরিচালনা পর্ষদ ও বাফুফের বা কার্যনির্বাহী পরিষদের সবাই যে সরাসরি আওয়ামী লীগ ঘরানার, তা নয়। বিসিবির বর্তমান পরিচালক পর্ষদের বেশ কয়েকজন আছেন, যারা সরাসরি আওয়ামী লিগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আবার কেউ কেউ পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত। আবার কেউবা পারিবারিকভাবে শেখ হাসিনা পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ।
এর বাইরে শেখ হাসিনার ভাই শেখ কামালের হাতে গড়া আবাহনীতে খেলা ক্রিকেটার ও আবাহনীর ক্রিকেট সংগঠকরাও এ বোর্ডে অগ্রাধিকার পেয়েছেন। তবে বেশ কজন কট্টর আওয়ামীপন্থী ছিল নাজমুল হাসান পাপনের বোর্ডে। যারা সরাসরি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত। তবে কি বিসিবি পরিচালক পর্ষদে বিএনপিপন্থী একজন পরিচালকও নেই?
একদম যে নেই, তাও বলা যাবে না। ইতিহাস ঘেঁটে বলতে গেলে মাহবুব আনাম, ওবায়েদ নিজাম, খালেদ মাহমুদ সুজনকে বিএনপি ঘরানার মানুষই বলতে হবে। সাবেক ক্রিকেটার মাহবুব আনাম ৩ যুগের বেশি সময় ধরে মোহামেডানের অন্যতম শীর্ষ কর্তা হিসেবে আছেন। এবং আদর্শগত দিক থেকে একসময় তাকে বিএনপিপন্থী বলেই ভাবা হতো। তবে তিনি এর আগে সাবের হোসেন চৌধুরীর বোর্ডেও ছিলেন। মাতৃকুল ধরলে খালেদ মাহমুদ সুজন বিএনপি ঘরানার ছেলে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য প্রয়াত কামাল ইবনে ইউসুফ সুজনের মামা। একইভাবে ওবায়েদ নিজামও তাই।
বিএনপির সাবেক মন্ত্রী ইকবাল মাহমুদ টুকু ওবায়েদ নিজামের মামা। এছাড়া মাহবুব আনাম, সুজন আর ওবায়েদ নিজাম তিনজনই বেগম জিয়ার কনিষ্ঠ পুত্র আরাফাত রহমান কোকোর খুব কাছের মানুষ হিসেবে গণ্য হতেন। সে অর্থে আকরাম খান মোটামুটি নিরপেক্ষ। তবে দীর্ঘদিন আবাহনীতে খেলেছেন। আবাহনীর ক্রিকেট অধিনায়কও ছিলেন বেশ কয়েক বছর।
সে কারণে আ হ ম মোস্তফা কামাল, সাবের হোসেন চৌধুরী আর নাজমুল হাসান পাপনসহ আবাহনীর অনেক শীর্ষ কর্তারই প্রিয়ভাজন আকরাম। তাই আওয়ামী লীগের আমলের শেষ ৩ বোর্ডেই কোনো না কোনো পরিচয়ে আছেন আকরাম খান।
বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনসহ ৬-৭ জন পরিচালক সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। পাপন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সাংসদও। এছাড়া নাজমুল হাসান পাপন পারিবারিকভাবেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তার পিতা দেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান। একইভাবে পাপনের মা আইভি রহমানও ছিলেন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী।
বোর্ড পরিচালক শেখ সোহেল হলেন পদত্যাগী ও দেশ ছেড়ে যাওয়া শেখ হাসিনার আপন চাচাতো ভাই। শেখ হেলালের আপন ছোট ভাই।
বোর্ডের অন্যতম ডাকসাঁইটে পরিচালক আ জ ম নাসির চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা। আওয়ামী ব্যানারে চট্টগ্রামের সাবেক মেয়রও ছিলেন আ জ ম নাসির।
নাইমুর রহমান দুর্জয়ও পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। মানিকগঞ্জের দুইবারের সাংসদ দুর্জয়। তার পিতা মানিকগঞ্জের সাবেক সাংসদ। মা ও মানিকগঞ্জ মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ছিলেন। সিলেটের নাদেল চৌধুরীও সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। তিনিও সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক।
এর বাইরে বিসিবির অন্যতম সিনিয়র পরিচালক এনায়েত হোসেন সিরাজ আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা মোজাফফর হোসেন পল্টুর আপন ছোট ভাই। জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার সিরাজ ১৯৯১ সালে বিএনপি আমলে বিসিবির অন্যতম শীর্ষ কর্তা ছিলেন।
২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি বোর্ডের অন্যতম নীতি নির্ধারক হিসেবে কাজ করেছেন। এছাড়াও ১৯৯৯ সালে প্রথম বিশ্বকাপে বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রধান নির্বাচক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৪ সালে শ্রীলঙ্কার মাটিতে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল প্রথম বিদেশের মাটি থেকে ট্রফি জিতে আসে। এনায়েত হোসেন সিরাজ ছিলেন সে দলের ম্যানেজার।
তরুণ পরিচালক গাজী গোলাম মর্তুজা পাপ্পা হলেন আওয়ামী লীগ নেতা ও রূপগঞ্জের সাবেক সাংসদ গাজী গোলাম দস্তগীরের পুত্র, কাজী এনাম আওয়ামী সাংসদ কাজী নাবিলের ছোট ভাই, তানভীর আহমেদ টিটু নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের প্রেসিডেন্ট এবং নারায়ণগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক।
কিন্তু সব ছাপিয়ে তিনি নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের বড় নেতা শামীম ওসমানের শ্যালক হিসেবেই বেশি পরিচিত। বেক্সিমকোতে চাকুরীরত ডা. ইসমাইল হায়দার মল্লিক ছাত্র জীবনে ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং তার চাচা এল আই মল্লিক সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী।
এর বাইরে আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববিও পারিবারিকভাবে আওয়ামী ঘরানার মানুষ। তবে বেশ কিছু দিন আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সে অর্থে তেমন সম্পৃক্ত নন ববি। তার প্রয়াত পিতা মহিউদ্দীন আহমেদ ছিলেন ৬০, ৭০ ও ৮০-এর দশকে আওয়ামী লীগ এবং বাকশালের অন্যতম শীর্ষ কর্তা।
অ্যাডভোকেট আনোয়ারুল ইসলাম রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ কর্তা। রংপুর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এছাড়া আহমেদ নাজিব, মঞ্জুর কাদেরও পারিবারিকভাবে শেখ হাসিনার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
বাকি পরিচালকদের মধ্যে মাহবুব আনাম, জালাল ইউনুস, আকরাম খান, খালেদ মাহমুদ সুজন, ফাহিম সিনহা, ওবায়েদ নিজাম, ইফতেখার রহমান মিঠু , মঞ্জুর আলম, সাইফুল আলম স্বপন, সালাউদ্দীন ঠিক আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত নন। মাহবুব আনাম, আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি আর জালাল ইউনুস দুজন দেশের দুই শীর্ষ ক্লাব মোহামেডান আর আবাহনীর অন্যতম শীর্ষ ক্রিকেট কর্তা।
তিনজনই আশির দশকের একদম শুরু থেকে দেশের দুই জনপ্রিয় দল আবাহনী আর মোহামেডানের ক্রিকেট কমিটির অন্যতম হর্তাকর্তা। গত ৩ যুগের বেশি সময় ধরে তারা মোহামেডান ও আবাহনীর ক্রিকেট কর্তা হিসেবেই জড়িয়ে আছেন। সেই পরিচয়েই তারা বোর্ডে এসেছেন। এবং মাহবুব আনাম ও জালাল ইউনুস এর আগে বিএনপি আর আওয়ামী লীগের সময়ও বোর্ডে ছিলেন।
একইভাবে আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি ১৯৯১ সালে বিএনপি আমলে কর্নেল (অব) মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বিসিবির নির্বাহী কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মাঝে ২০০৭ সালে লে. জেনারেল সিনা ইবনে জামালীর নেতৃত্বে অন্তবর্তীকালীন বিসিবি কমিটিতেও ছিলেন ববি, মাহবুব ও জালাল।
এছাড়া জাতীয় দলের দুই সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান ও খালেদ মাহমুদ সুজন এসেছেন ক্রিকেটার কোটায়। তবে দুজনই খেলোয়াড়ি জীবনের বড় সময় শেখ হাসিনার ছোট ভাই শেখ কামালের প্রতিষ্ঠিত আবাহনী ক্লাবেই বেশি সময় কাটিয়েছেন। বোঝাই যায়, শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগ সরকারের সুদৃষ্টি ছিল তাদের ওপর।
আত্মীয়তার সূত্রে তিনি বিএনপির সাবেক বিদ্যুৎ মন্ত্রী ইকবাল মাহমুদ টুকুর ভাগ্নে, তাই রাজনৈতিক ঘরানায় ওবায়েদ নিজাম বিএনপিপন্থী। কিন্তু সালমান এফ রহমানের ছেলে শায়ন এফ রহমানের বন্ধু ও ক্লাব ক্রিকেট সংগঠক পরিচয়ে বোর্ডে এসেছেন ওবায়েদ নিজাম।
একই কথা প্রযোজ্য সাবেক ক্রিকেটার ও ক্লাব সংগঠক ইফতেখার রহমান মিঠুর ক্ষেত্রেও। অন্যদিকে ফাহিম সিনহা বিবেচনায় এসেছেন বিসিবির সাবেক অন্যতম শীর্ষ কর্তা এবং আবাহনীর সাবেক অন্তঃপ্রাণ ক্রীড়া সংগঠক ও পরিচালক আফজালুর রহমান সিনহা কায়সারের ছেলে হিসেবে। এছাড়া অপর পরিচালক আলমগীর খান আলো বেঁচে নেই। তিনিও আওয়ামী লীগের সাথে জড়িত ছিলেন।
ওপরে যে ২৪ পরিচালকের পরিচয় দেওয়া হলো, তাদের একটা বড় অংশই এখন লোকচক্ষুর বাইরে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২৪ পরিচালকের অনেকেই নাকি দেশের বাইরে চলে গেছেন। এ মুহূর্তে ৭ পরিচালক জালাল ইউনুস, আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি, মাহবুব আনাম, আকরাম খান, ইফতেখার রহমান মিঠু, খালেদ মাহমুদ সুজন ও কাজী নাবিলই শুধু দেশে আছেন। এবং তারা সবাই গত পরশু রোববার সকালে ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের সাথে সাক্ষাত করতে মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলেন।
অনেকের ধারণা, বিসিবি পরিচালক পর্ষদের যারা লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছেন, তাদের একটা অংশ হয়তো শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে পারেন। বলে রাখা ভালো বাফুফের সিনিয়র সহসভাপতি সালাম মুর্শেদী এরই মধ্যে পদত্যাগ করেছেন। এখন ক্রিকেট বোর্ডের কেউ তার পথে হাঁটবেন কিনা, শেষ পর্যন্ত আদৌ কোনো পরিচালক পদত্যাগ করেন কিনা, সেটাই দেখার।
এআরবি/এমএমআর/জিকেএস