আম্পায়ারের ওপর দোষ চাপাতে গিয়ে ঢেকে যাচ্ছে ক্রিকেটারদের ব্যর্থতা
তখন জয়ের গন্ধ নাকে এসে লাগছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের। টিম বাংলাদেশ তখন জয় থেকে ২৭ রান দূরে। বল বাকি ২৪টি। টাইগারদের হাতে ৬ উইকেট। ক্রিজে সেট ব্যাটার মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও তাওহিদ হৃদয়।
ঠিক এমন সময় প্রোটিয়া ফাস্ট বোলার কাগিসো রাবাদার ইন-সুইং ধরনের ডেলিভারি ফ্লিক শট খেলতে গিয়ে ব্যাটে আনতে পারলেন না রিয়াদ। বল তার ব্যাট ফাঁকি দিয়ে প্যাডে আঘাত হানলো। প্রোটিয়াদের আবেদনের মুখে আম্পায়ার লেগবিফোর উইকেটের সঙ্কেত দিলেন।
বল লেগস্ট্যাম্প মিস করতো, এই দাবিতে চট জলদি রিভিউয়ের আবেদন করলেন রিয়াদ। আবেদন গ্রাহ্য হলো। টিভি রিপ্লেতে পরিষ্কার দেখা গেল বল লেগস্ট্যাম্পের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিল। খুব স্বাভাবিকভাবেই থার্ড আম্পায়ারের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত পাল্টে নট আউট ঘোষণা দিলেন অস্ট্রেলিয়ান স্যাম নোগাসকি।
এটাই শেষ নয়। ঘটনা আরও আছে। আম্পায়ার প্রথমে আউট দেয়ায় নিয়ম অনুযায়ী বল ডেড হয়ে গিয়েছিল এবং সেই বল সীমানার ওপারে চলে গেলেও লেগবাই থেকে বাউন্ডারির ৪ রান পায়নি বাংলাদেশ। আম্পায়ার আউটের সঙ্কেত না দিলে বল সীমানার ওপারে যাওয়ার কারণে ৪ রান যোগ হতো বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে।
তাতে করে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ আর ৪ রানে হারতো না। কাকতালীয়ভাবে ওই ৪ রানের ব্যবধানে হারের কারণে অসি আম্পায়ার স্যাম নোগাসকির আউটের সিদ্ধান্তটি খুব বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের ভক্ত, সমর্থকরা আম্পায়ারের সমালোচনায় মুখর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আম্পায়ারের চৌদ্দ গোষ্টি উদ্ধার হচ্ছে।
বাংলাদেশ ভক্তদের সাথে টিভি ধারাভাষ্যকার ওয়াকার ইউনুস, হার্শা ভোগলেরা যোগ হওয়ায় ব্যাপারটা গুরুত্ব পাচ্ছে খুব বেশি এবং এ মুহূর্তে রিয়াদের প্যাডে লেগে বাউন্ডারি হলেও আম্পায়ারের আউটের ভুল সিদ্ধান্তে তা ‘ডেড বলে’ পরিণত হওয়ায় সব দায় এসে পড়েছে আম্পায়ারের ওপর। বলা হচ্ছে, এই আইনটি পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন।
এটা ঠিক যে, খালি চোখেই মনে হচ্ছিল বল লেগস্ট্যাম্পের বাইরে দিয়ে যাচ্ছিল, তবু আম্পায়ার আউট দিয়ে ফেলেছেন। আইসিসির প্লেয়িং কন্ডিশনে এমন অবস্থায় ব্যাটিংয়ে থাকা দলের স্কোরে কোন রান না যোগ হওয়ার নিয়মও বহাল। তাই আসলে কিছু করার নেই।
আম্পায়ারের ভুলটা ‘মানবীয় ভুল’ ধরে নিয়ে ভাগ্যকে দোষারারোপ করা ছাড়া আসলে কিছু করার নেই বাংলাদেশের। আইসিসির নিয়ম অনুযায়ী এ অবস্থায় বাউন্ডারি বা ১, ২ কিংবা ৩ রান যোগ হবে না। মানে কোনো রানই হবে না। কারণ যা ঘটেছে, তা নিয়মের মধ্যেই ঘটেছে।
এমন নয় যে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোন সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের বিপক্ষে গেছে। তাই নিজেদের দূর্ভাগা ভাবা ছাড়া আর কিছুই করার নেই টাইগারদের।
কিন্তু বাংলাদেশের ভক্তদের একটা অংশ তা না করে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। তাতে করে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে ৪ রানে হারার সব দায়টা গিয়ে পড়ছে আম্পায়ারের ওপর। কিন্তু মাত্র ১১৪ রান করতে না পারা যে একটা ব্যর্থতা এবং তাওহিদ হৃদয় আর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ দু’দুজন সেট ব্যাটার যে সূবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করেছেন, শেষ ওভারে ১১ রান করতে গিয়ে ৩ জন আউট হয়ে তীরে গিয়ে তরি ডুবিয়েছেন।
একজোড়া ফুলটচ ডেলিভারি কাজে লাগাতে না পেরে উল্টো সীমানার কাছে ক্যাচ দিয়েছেন অভিজ্ঞ রিয়াদ আর তাসকিন; তা বেমালুম ভুলে গেছেন কেউ কেউ।
এটাই সমস্যা বাংলাদেশের ক্রিকেটের। ক্রিকেটকে ক্রিকেটীয় দৃষ্টিতে না দেখে আবেগতাড়িত হয়ে মাথা না খাটিয়ে মন ও হৃদয় দিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা বাংলাদেশিদের মজ্জাগত হয়ে গেছে।
আম্পায়ার রিয়াদকে আউট না দিলে নির্ঘাত চার রান মিলতো; কিন্তু যেহেতু তিনি আউট দিয়ে ফেলেছেন এবং আইসিসির নিয়ম অনুযায়ী, রিভিউতে আউট না হলেও সেই রান যোগ হবে না, এটাতো আর নতুন কিছু নয় যে- ১০ জুন সোমবার প্রথমবার তার প্রয়োগ ঘটেছে। আর বাংলাদেশই সে নিয়মের বলি হলো। এমন ঘটনা ভুরি ভুরি ঘটেছে। যেহেতু এটা আইসিসি প্লেয়িং কন্ডিশন অনুমোদিত, তাই আর এটা নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করে না। দূর্ভাগ্য বলেই পরিগণিত হয়।
আর কেউ কেউ এমন আইন পরিবর্তনের দাবিতেও সোচ্চার। তা করলেও মানা যেত; কিন্তু ঢালাওভাবে আম্পায়ারের ভুলেই বাংলাদেশ পারেনি; এমন দাবি তোলায় বিপত্তি ঘটেছে। তাতে করে বাংলাদেশের ব্যাটারদের ম্যাচ শেষ করতে না পারার ব্যর্থতাটা ঢাকা পড়ে গেছে।
বাংলাদেশ যে জায়গায় গিয়ে যেভাবে ম্যাচ হেরেছে, তা নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনাটাই কম হচ্ছে। সবার চোখ আম্পায়ারের দিকে। তাতে করে তরুণ তাওহিদ হৃদয় যে অনেক লড়াই-সংগ্রামের পরও ম্যাচ শেষ করে দল জিতিয়ে সাজঘরে ফিরতে পারেননি, সোমবারও পারলেন না।
আগেও তিনি দলকে অনেকদুর এগিয়ে দিয়ে একটা পর্যায়ে আউট হয়ে ফিরে এসেছেন, তার মানে তিনি সংকটে, বিপদে সাহসী যোদ্ধা হয়ে লড়াই করে অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারলেও ম্যাচ জেতাতে পারেন না, সে সত্যের দেখা মিললো আবারও। এটা যে তার ঘাটতি, সীমাবদ্ধতা- তা নিয়ে কথা হচ্ছে খুব কম। অভিজ্ঞ রিয়াদ দক্ষিণ আফ্রিকার বাঁ-হাতি স্পিনার কেশভ মহারাজের ফুলটচ ডেলিভারি পেয়েও ছক্কা হাঁকাতে না পেরে সীমানার এক দুই গজ সামনে ক্যাচ দিলেন, তার মানের ব্যাটাররা ওই বলে অবলীলায় ছক্কা হাঁকাতেন, ওই বল গ্যালারিতে গিয়ে আছড়ে পড়ার কথা, রিয়াদ তা পারেননি।
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের সে ঘাটতির প্রসঙ্গ উচ্চারিত হচ্ছে না একদমই। বিগ হিট নিতে পারেন, হাত খুলে খেলার সামর্থ্য আছে- এ বিবেচনায় বিশ্বকাপ দলে জায়গা পাওয়া জাকের আলী অনিকও জায়গামত হাত খুলে খেলতে পারলেন না, রিশাদ হোসেন বল হাতে উৎরে গেলেও ব্যাট হাতে প্রয়োজনের সময় কিছু করে দেখাতে পারলেন না- এ সত্য গুলো কিন্তু বেরিয়ে এসেছে।
কিন্তু ঢালাও আম্পায়ারের ওপর দায় চাপানোয় সেগুলো নিয়ে কথা-বার্তা কম। তাতে করে টিম ম্যানেজমেন্ট, থিংক ট্যাংক আর ক্রিকেটারদের নিজেদের ঘাটতি, কমতি ও সীমাবদ্ধতা গুলো ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। যাবেও।
ওপেনিং ভাল হচ্ছে না। সৌম্য, লিটন আর শান্তর টপ অর্ডার বারবার ব্যর্থ। তাদের ব্যাটে রান নেই। ইনিংস শুরু হতেই দল বিপদে পড়ছে। ব্যাটিং মেরুদন্ড ভাঙ্গছে। বেশিরভাগ ভক্ত ও সমর্থকের ধারণা, এটাই বুঝি ব্যাটিং ডিপার্টমেন্টের সমস্যা; কিন্তু মিডল অর্ডারে তাওহিদ হৃদয় ও রিয়াদ ছাড়া যে আর কেউ নেই, বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিবও এখন আর আগের মত শক্তহাতে হাল ধরতে পারেন না- এই কঠিন সত্যগুলো হয়ত অনেকের কাছেই অজানা ছিল। কিন্তু গত ১০ জুন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের নাসাউ স্টেডিয়ামে সে কঠিন সত্যগুলো বেরিয়ে এসেছে।
আরও দেখা গেল যে, সাইফউদ্দীনের পরিবর্তে দলে জায়গা পাওয়া তানজিম সাকিবও পারেন। এ তরুণ পেসারেরও সামর্থ্য আছে দ্রুত গতির ইনকাটারে, দূরন্ত, দুর্বার ডি কক, রিজা হেনড্রিক্স, কিংবা ট্রিস্টান স্টাবসদের মত উইলোবাজদের উইকেট উপড়ে ফেলার।
আসলে আবেগ দিয়ে নয়, ক্রিকেটকে ক্রিকেটীয় দৃষ্টিতে দেখাই যুক্তিযুক্ত। আবেগ, ব্যক্তিগত পছন্দর উর্ধ্বে উঠে ক্রিকেটীয় যুক্তিতে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ খুব জরুরি। বাস্তবতা মেনে কঠিন সত্যগুলো থেকে ইতিবাচক শিক্ষা নেয়ার যে এখনই সময়!
তবেই সামনে আগানোর দরজা খুলবে। ওপরে ওঠার সিঁড়ির দেখা মিলবে। না হয় এই তিমিরেই পড়ে থাকতে হবে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে।
এআরবি/আইএইচএস