টি-২০ বিশ্বকাপ: আমেরিকায় ক্রিকেট-নোঙর
১৯ বছর আগে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ ভূমিষ্ঠ হয়েছিল একেবারেই হালকা মেজাজে। যে নিউজিল্যান্ডারদের কাছে কালো রংয়ের জার্সি ছাড়া তখন অন্য রং প্রায় নিষিদ্ধ, তাদের গায়ে বেইজ-কালারের সাবেকি জার্সি। কেউ কেউ নামলেন নকল দাঁড়ি-গোঁফ আর পরচুলা লাগিয়ে। অকল্যান্ডের ইডেন পার্কে সেদিন যেন ছিল বসন্ত-উৎসব- রং দে বাসন্তী।
গ্লেন ম্যাকগ্রা ১৯৮১ সিরিজের ট্রেভর চ্যাপেলের মতো একটা আন্ডার আর্ম বল করলেন। আম্পায়ার বিলি বাউডেন ফুটবলের রেফারির মতো ফট করে হলুদ কার্ড দেখিয়ে সতর্ক করে দিলেন। ম্যাচে রিকি পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়ার কাছে স্টিভেন ফ্লেমিংয়ের নিউজিল্যান্ড হারলো ৪৪ রানে। তবে ফলাফল কে আর বড় করে দেখেছে সেদিন! রঙ্গ-রসিকতা, হাস্য-কৌতুকের মধ্যে হাইব্রিড ক্রিকেটের আনুষ্ঠানিক জন্মক্ষণ উদযাপনই ছিল মূল ভাবনা।
মাত্র গোটা বিশেক ম্যাচের পর দু’বছর না গড়াতেই ২০ ওভারের ক্রিকেটের বিশ্বকাপেরও উদ্বোধন দেখলো পৃথিবী। ২০০৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সেই বিশ্ব আসরের নামও ছিল অন্যরকম। ঠিক সরাসরি বিশ্বকাপ বলা হয়নি। নামটিকে একটু সযত্নে এড়িয়ে গিয়ে বলা হলো ওয়ার্ল্ড টি-২০।
সংক্ষিপ্ত ক্রিকেট ম্যাচে রোমাঞ্চ যোগ করতে গ্যালারিতে আমদানি হলো নাচ-গান। মানে ওটা ছিল টেস্ট কেস। আইসিসি বাড়তি একটি টুর্নামেন্ট করে তহবিল বাড়াতে চায়। কিন্তু মাঠে দর্শক আসবে কি না সেই সংশয় থেকে বাড়তি রং জোগানোর উদ্যোগ।
মনে পড়ে, ভারত প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলতেই চায়নি। অন্য ক্রিকেট সূচির ব্যস্ততার অজুহাতে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের তৎকালীন সচিব জয়ন্ত লেলে বারবার বলছিলেন, ভারতের পক্ষে এই টুর্নামেন্টে অংশ নেয়া সম্ভব নয়।
কিন্তু যে দেশের মানুষ ক্রিকেটে খায়, ক্রিকেটে ঘুমায় এবং ক্রিকেটেই নিঃশ্বাস ফেলে, সেই একশো বিশ কোটির দেশকে বাদ দিয়ে এই আয়োজন তো হবে ম্যাড়মেড়ে। অনেক সাধ্য-সাধনা করে ভারতকে রাজি করানো গেল অবশেষে। প্রস্তুতি তেমন নেই। টি-টোয়েন্টি ম্যাচ তেমন খেলা হয়নি। ভারত পাঠালো একটা আনকোরা দল। অধিনায়ক ততোধিক আনকোরা, লম্বা চুলের মহেন্দ্র সিং ধোনি। প্রত্যাশা না থাকলে যেমন হয় আরকি!
ধোনির এই দলটাই কি না সবাইকে চমকে দিয়ে উঠে গেল ফাইনালে। উল্টো দিক থেকে ফাইনালে এলো পাকিস্তান। একেবারে সোনায় সোহাগা। ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ফাইনাল যে মেঘ না চাইতে জলের মতো সাজিয়ে দেবেন ক্রিকেট বিধাতা, ভাবতে পারেনি আইসিসি।
আইসিসি যেমন উল্লসিত হলো প্রথম আয়োজনের সাফল্যে, তার চেয়ে ট্রফি জিতে বেশি উন্মাতাল হলো ভারত। আর তার ফলে জন্ম হলো আইসিএল, আইপিএল। বিসিসিআইয়ের বিরুদ্ধে গিয়ে আইসিএল এক আয়োজনেই মৃত। সেই জায়গায় ক্রিকেটের অনন্ত আকর্ষণ হয়ে জেগে উঠেছে আইপিএল।
ইন্ডিয়া পয়সা লিগ বলে আইপিএলকে আপনি যতই ঠাট্টা-মষ্করা করুন, এটির বিকল্প নাম এখন ইন্টারন্যাশনাল পয়সা লিগ। ক্রীড়া বিশ্বে আইপিএল যে কতটা অর্থকরী ফসল, তা দু’য়েকটি ছোট পরিসংখ্যানেই বুঝতে পারবেন।
আইপিএলের ব্র্যান্ড ভ্যালু এখন ১০.৭ বিলিয়ন ডলার। আমেরিকার ন্যাশনাল বাস্কেটবল অ্যাসোসিয়েশন অর্থাৎ এনবিএ ১০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি ব্র্যান্ড ভ্যালু নিয়ে পেছনে পড়ে গেছে। আইপিএলের প্রতি ম্যাচের মিডিয়া সত্ত্ব এখন যেখানে ১৬.৮ মিলিয়ন ডলার, সেখানে এনবিএতে তা মাত্র ১.১ মিলিয়ন ডলার।
আমেরিকায় ক্রিকেট নোঙর ফেলার একটা মওকা খুঁজছিল। আইপিএলের আকর্ষণ বেঁধে দিল সেতু। তাই প্রথমবারের মতো সেখানে আয়োজিত হচ্ছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। সবকিছুর পেছনে আসলে ওই পুঁজি, মুনাফা। ক্ষতি কি, আইসিসি যদি পৃথিবীর অর্থনৈতিক রাজধানী ও সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশটিতে পায়ের নিচে মাটি পেয়ে যায় সবদিক দিয়েই ভালো। ক্রিকেট বিস্তৃত হলো, ফুলে ফেঁপে উঠলো কোষাগার। একেবারে রাজযোটক যাকে বলা যায়।
২০১৫ সালে আইসিসির হেড অব গ্লোবাল ডেভলপমেন্ট টিম অ্যান্ডারসন আইসিসিকে এই বুদ্ধিটাই দিয়েছিলেন। ভবিষ্যতে কোনো টুর্নামেন্ট আমেরিকায় আয়োজন না করলেই নয়। নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষার পর ২০২০ সালে আমেরিকা পাশের ক্রিকেট চর্চিত দ্বীপপুঞ্জ ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে যৌথভাবে ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর কোনো একটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আয়োজনে আগ্রহ দেখায়। শুভস্য শীঘ্রম বলে ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপই তাদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে আইসিসি। টাকা, ক্রিকেটের বিস্তার- সব মিলিয়ে পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া যে আইসিসি আর আমেরিকার খুব দরকার।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো বেসবল, বাস্কেটবলের দেশে ক্রিকেটের বিশ্বকাপ দেখে যারা অবাক হচ্ছেন, তাদের এই ইতিহাসটা স্মরণ করিয়ে দেয়া যেতে পারে। বিশ্বের প্রথম অফিসিয়াল ক্রিকেট ম্যাচটি কিন্তু হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রেই। ভেন্যু সেই ‘বিগ অ্যাপল’ বলে পরিচিত নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটন। ১৮৪৪ সালের সেই ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা। ১৮৬০ দশকে গৃহযুদ্ধের আগ পযর্ন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যমই ছিল ক্রিকেট।
তারপর সেখানে কিভাবে যেন শিকড় গাড়লো বেসবল, বাস্কেটবল, আমেরিকান ফুটবল। আসলে জীবনযুদ্ধে রুজিরোজগারের পেছনে ছুটতে গিয়ে তখন মানুষের হয়তো মনে হয়েছিল ক্রিকেটটা বড্ড লম্বা। এত সময় কোথায় ওটা দেখার? সময় কম, রোমাঞ্চ ও উত্তেজনা আছে, আবার টাকা আসবে- এমন কোনো সংক্ষিপ্ত খেলার দিকেই ছোটে আমেরিকানদের মন। টি-২০ ক্রিকেট এই মানসিকতার সঙ্গে যায়। একদা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত দেশগুলো যেমন ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকার অভিবাসীরা খেলাটিকে এগিয়ে নিতে বড় ভূমিকা রাখবে, এটা ভেবেই নেয়া যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ ক্রিকেট ভেন্যুর সঙ্গে বেসবলের সম্পর্ক আছে। ডালাসের প্রেইরি ভিউ ক্রিকেট স্টেডিয়াম যেমন প্রকৃতপক্ষে বেসবলের মাঠ। বেসবল খেলাটির সঙ্গে ক্রিকেটেরও কিছু মিল আছে। বেসবলে ব্যাট দিয়ে বল হিট করাটাই দর্শন। ওখানেও রান করতে হয়। বেসবলের হোমরান (এইচআর) যেন ক্রিকেটের ছক্কা। বেসবলেও ক্রিকেটের মতো বোলার (পিচার) ব্যাটাররাই খেলে। এই খেলাতেও একইসঙ্গে মাঠের বিচারক থাকেন দুই আম্পায়ার।
সুতরাং বেসবলের দেশে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের বিশ্বকাপটা বেশ জমবে ভালো। নয়টি সহযোগী সদস্যসহ বেশির ভাগ দলের কাছেই এটা উপভোগ্য হওয়ার কথা।
শুধু বাংলাদেশের অনুভূতিটাই কেমন আলুনি যেন। এমনিতেই এ দেশের ক্রিকেটারদের কাছে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট এখনো এক জটিল ধাঁধা। তারওপর গায়ে টেস্ট খেলুড়ে দেশের তকমা লাগিয়ে প্রস্তুতি সিরিজে সহযোগী সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে লজ্জার হার মানতে হয়েছে। বিশ্বকাপ-যাত্রাটাই কেমন বিস্বাদ ঠেকছে। ক্রিকেটারদের মুন্ডুপাত চলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অধিনায়ক-ক্রিকেটার ও বোর্ড সভাপতিকে নিয়ে চলছে হাসাহাসি।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটটা বাংলাদেশের কাছে আর আনন্দের নয়। এ অতি জটিল সমীকরণে জীবন-মরণের মতো সিরিয়াস বিষয়। জন্মক্ষণ আর বর্তমান বাস্তবতায় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটই পৃথিবীর কাছে এখন দাঁড়িয়ে আছে মেরুব্যবধানে। এটাই হয়তো ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ-ভাষা, এতেই হয়তো নিহিত ক্রিকেটের অস্তিত্ব।
আইএইচএস/