করপোরেট ঝলমলে ক্রিকেটে এন্ডোর্সমেন্ট লড়াই
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটকে নানাজনে নানা নামে ডাকেন। ডাকার ক্ষেত্রে মতভিন্নতা থাকলেও একটা জায়গায় কিন্তু সবাই একমত। মুচমুচে স্বাদ আর স্বল্প দৈর্ঘ্যের এই আয়োজন আসলে যত না ক্রিকেটীয় আবহে তার চেয়েও বেশি ক্রিকেট পরিমন্ডলে ব্যবসায়িক সমারোহ। যার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটাই রঙিন করপোরেট আলোয় ঝলসানো।
পরিস্থিতিটা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, ২০ ওভার সীমার মধ্যে যত বেশি চার-ছক্কার হৈ হৈ, তত বেশি করপোরেট মনযোগ। তত বেশি আয়ের ঝনঝনানি।
সাত-সমুদ্র আর তেরো নদীর ওপারে যে আয়োজন বসেছে, সেখানে যত না ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা, তারচেয়ে ঢের উৎসব আয়োজন স্পন্সরের চাপে। এখানে শান্ত-সাকিব-মাহমুদুল্লাহরা যত ভালো করবেন, তত বেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের আলো ছড়িয়ে পড়বে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। আর যদি পারফরম্যান্স হয় সাদামাটা, তাহলে করপোরেটে বাজার দর পড়বে ক্রিকেটের আর ওই পণ্যেরও।
শুধু বাংলাদেশে কেনো– উপমহাদেশে তো এভাবেই ক্রিকেটকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে আছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। শচিন টেন্ডুলকার যে শেষ দিকে নিজেকে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন, সেও কিন্তু এই এন্ডোর্সমেন্টের টানেই। ২০০৭ সালের পর ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফরম্যাট বদলে যাওয়ার ক্ষেত্রেও ছিল সেবার বাংলাদেশের কাছে হেরে ভারতের বিদায়ের এক ট্রাজেডি।
টেস্ট বাদ দিয়ে শুধু রঙিন পোশাকে খেলতে চাওয়া ক্রিকেটার আমাদেরও আছেন কয়েকজন। প্রথম দিকে নানান ছুতায়-নাতায় লংগার ভার্সন ক্রিকেটকে এড়িয়ে চলেছেন এরা। পরে তো কোনো রাখঢাক না রেখেই বলে দিয়েছেন টেস্ট খেলতে চান না– এরও কারণ ওই এন্ডোর্সমেন্ট।
এভাবেই ক্রিকেটকে ছাপিয়ে তারকা ক্রিকেটার আর দল চলে এসেছে মুখ্য চরিত্রে। স্পন্সর আর করেপোরেটের চাপে ক্রিকেট পেছনে পড়তে শুরু করেছে শূন্য দশকে এসে। তবে তার আগে আশির দশকে উইলসকে দিয়ে স্পন্সরশিপে আমাদের হাতেখড়ি।
প্রথম প্রথম উইলস টুর্নামেন্টে স্পন্সর করতো। তারপর টুর্নামেন্টে হয়তো কোনো কোনো দলকেও স্পন্সর করত তারা– এভাবেই চলেছে শুরুর দিকটায়। ১৯৮৮ সালে দ্বিতীয় এশিয়া কাপে বাংলাদেশ দলের জার্সিতে উইলসের লোগো ওঠে। তখনো স্পন্সরশিপটা আলো ঝলমলে ছিল না।
এর আগে পরে বাংলাদেশ আইসিসি বা এসিসি টুর্নামেন্ট জিতেছে; কিন্তু একবারও স্পন্সর পায়নি। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সেই রোশনাইয়ের মধ্যেও খেলোয়াড়দের সাদা জার্সি সফেদই থেকেছে। এমনকি বাংলাদেশের আজকের ক্রিকেট যে ১৯৯৭ সালের আইসিসি টুর্নামেন্ট জয়ের ওপর দাঁড়িয়ে, সে আয়োজনেও কোনো স্পন্সর ছিল না আকরাম খানদের।
বলতে গেলে ডেলিগেশনের প্রধান সাবের হোসেন চৌধুরী চেয়ে-চিন্তে টাকা জোগাড় করে দল নিয়ে গিয়েছিলেন মালয়েশিয়ায়। টাকার এমনই সংকট ছিল যে, দলের সঙ্গে সহকারী কোচ যে তিনজন ছিলেন তাদেরকেও সেবার মালয়েশিয়ায় নেওয়া সম্ভব হয়নি।
১৯৮৬ সালের প্রথম এশিয়া কাপ বা ১৯৯৬ সালে এসিসি ট্রফির সময়ে তো দলের সঙ্গে কোচও নেওয়া যায়নি খরচ বাঁচানোর চিন্তায়। অবশ্য সেবার আইসিসি ট্রফি জেতার পর দলের কয়েকজন ক্রিকেটার যৎসামান্য এন্ডোর্সমেন্ট পেয়েছিলেন। সেটা আবার বেশি দিন টেকেওনি। সাদাকালো যুগের সেই ক্রিকেট আজ আলো ঝলমলে রঙিন উৎসবে মাতোয়ারা। চারিদিকে বর্ণিল আলোর স্ফুরণ, যার পুরোভাগে রয়েছে স্পন্সরশিপ আর এন্ডোর্সমেন্ট।
বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপের আগে আগে সাদাকালো সময় পেরিয়ে জার্সি হয়ে ওঠে রঙিন। সেখানে স্পন্সর হিসেবে উঠে আসে মেরিল। বিশ্বকাপের আগে জিম্বাবুয়ে এবং কেনিয়াকে নিয়ে ঢাকায় বসে ত্রিদেশীয় ট্রফির। সেবার মেরিল ছিল ক্রিকেটারদের জার্সিতে; কিন্তু তখনো কোনো নির্দিষ্ট খেলোয়াড়ের কোনো এন্ডোর্সমেন্ট ছিল না।
টেস্ট খেলার সুযোগ যখন আসে তখনো কিন্তু দলের স্পন্সর ছিল না। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপের আগেভাগে এক কোটি ৮০ লাখ টাকায় দুই বছরের জন্যে স্পন্সর হয় কোকাকোলা; কিন্তু বিশ্বকাপ ভরাডুবির পর কোকাকোলা সরে যায়।
অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রথম টেস্টের আগ দিয়ে ক্রিকেট বোর্ড পেয়ে যায় গ্রামীণফোনকে। প্রথম বছর ৫০ লাখ টাকা দেবে প্রতিষ্ঠানটি– এমনই ছিল চুক্তি। আর দ্বিতীয় বছর আরো ১০ শতাংশ বাড়বে অংক। তখনকার আয়ে খেলোয়াড়দের কোনো অংশ ছিল না।
দুই বছর পরেই গ্রামীণফোনের সঙ্গে সাড়ে তিন কোটি টাকায় দুই বছরের চুক্তি হয়। এই টাকার ১৫ শতাংশ যায় খেলোয়াড়দের পকেটে। সেবার সেই চুক্তির সঙ্গে খেলোয়াড় কর্মকর্তাদের জন্যে ৪৫টি মোবাইল ফোনও নেয় বিসিবি। তখনো আসলে এত অল্পেই খুশি ছিল সবাই। আর ক্রিকেটের ওপরেও স্পন্সরশিপ তখনো চড়ে বসতে পারেনি।
তারপর থেকে প্রতিবার দুই বছরের জন্যে চুক্তি হয়েছে আর টাকার অংক বেড়েছে। তবে এক্ষেত্রে বিসিবির আয়ে প্রথমবারের মতো ধাক্কা দেয় সাহারা গ্রুপ। গ্রামীনফোনকে এক ধাক্কায় বের করে সাহারা চার বছরের জন্যে নিয়ে নেয় ক্রিকেট দলের স্পন্সরশিপ। ৯৪ লাখ ডলারের চুক্তি ছিল এটি। তবে চুক্তির মেয়াদ পূরণ না করেই আবার মাঝ পথে তারা ফিরেও যায়। ফলে আবার গ্রামীণফোন হয়ে ওঠে ক্রিকেটের রক্ষার জায়গা।
মাঝে রবি একবার জাতীয় দলের জার্সিতে ওঠে; কিন্তু নানান জটিলতায় তারা আবার ফিরেও গেছে। সেবার গ্রামীণফোনকে হঠিয়ে রবি জয়ী হলেও শেষ চমকটা দেখায় গ্রামীণফোন। জাতীয় দল না পেয়ে জাতীয় দলের প্রায় সব তারকা খেলোয়াড়ের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে চুক্তি করে তারা। তাতে বিপাকে পড়ে যায় রবি। ফলে তারা সরেও যায়।
পরে তো দারাজ, ইভ্যালি ঘুরে আবার রবি এসেছে জার্সিতে। তবে মাঝে কয়েকবার টুর্নামেন্টের বাইলজ সংক্রান্ত জটিলতায় বড় টুর্নামেন্টগুলোয় মোবাইল অপারেটরদের নাম থাকেনি। তখন লাইফবয়, বেক্সিমকোসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান জার্সিতে ছিল।
দলের স্পন্সরশিপের বাইরে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা এখন ব্যক্তিগত এন্ডোর্সমেন্টেও কম যান না। এখানে একক আধিপত্য সাকিব আল হাসানের। বলার অপেক্ষা রাখে না– বছরের পর বছর আইপিএলে খেলা, জাতীয় দলের হয়ে তার সেরা পারফম্যান্স আর বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার হওয়াও তাকে দারুণ ব্র্যান্ডিং দিয়েছে। ফলে আর কেউই এখানে তার সঙ্গে পেরে ওঠেননি।
একটু পিছিয়ে থাকলেও তামিম আছেন শক্ত অবস্থানে। মুশফিক এবং মাহমুদুল্লাহকেও দেখা যায় বেশ কিছু ব্র্যান্ডের সঙ্গে। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত এবং অলরাউন্ডার মেহেদী হাসান মিরাজেরও কিছু এন্ডোর্সমেন্ট দেখা যাচ্ছে। মাশরাফিও তার শেষ সময়ে এসে ব্যক্তিগত এন্ডোর্সমেন্টের বাজারে ভালো সদাই করে গেছেন।
প্রতিটি এন্ডোর্সমেন্টেই তো বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি ঘণ্টা মেপে ব্র্যান্ডের প্রচারের জন্য কাজ করতে হয়। মাঠের ক্রিকেটে ভালো করার পাশাপাশি এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এগিয়ে থাকাও ক্রিকেটারদের জন্যে এখন আরেকটা বড় প্রতিযোগিতা।
ক্রিকেটারাও ভালো করেই জানেন, মাঠে ভালো করলে মাঠের বাইরের লড়াইটা তার জন্যে সহজ হবে। এন্ডোর্সমেন্টের বাজারে ভালো দাম পাবেন তিনি। ফলে আমেরিকায় ভালো করেও বাংলাদেশে অ্যাকাউন্ট সমৃদ্ধ করার এই আয়োজনে দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কে কে সুবিধা করতে পারেন!
লেখক: বিশ্লেষক, যোগাযোগ কর্মী
আইএইচএস/এমএমআর