ভিডিও EN
  1. Home/
  2. খেলাধুলা

সংশয়ের বিশ্বকাপ সম্ভাবনার বিশ্বকাপ

দুলাল মাহমুদ | প্রকাশিত: ০৪:১০ পিএম, ২৯ মে ২০২৪

যে কোনো বিশ্বকাপই সংশয় আর সম্ভাবনার। অংশগ্রহণকারী কোনো দল কি নিশ্চিত করে বলতে পারে, তাদের সংশয় নেই? আবার সম্ভাবনার কথা বললেও তা কতটুকু? সম্ভাবনা পরিমাপ করে নিশ্চিতভাবে ঘোষণা কি দেওয়া সম্ভব?

চূড়ান্ত সক্ষমতা যেখানে দাবি করে, সেই বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া প্রতিটি দলের এই দ্বিধা ও অনিশ্চয়তা রয়েছে। সংশয় আর সম্ভাবনার দোলাচল আছে বলেই যে কোনো খেলার সর্বোচ্চ আসর বিশ্বকাপের আকর্ষণ অন্য সব কিছুকে ছাড়িয়ে যায়। আর ক্রিকেটকে বলা হয়, গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা। এ অনিশ্চয়তার কারণে ক্রিকেটের বিশ্বকাপের আছে অন্য রকম এক সৌন্দর্য। খেলার পরতে পরতে রোমাঞ্চের হাতছানি। খেলাটা এমন, প্রতিটি বলেই বদলে যেতে পারে তার গতিপথ।

আর এই একটি খেলার বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলতে পারে বাংলাদেশ। যে কারণে আশা-নিরাশার টইটম্বুরে ফুটতে থাকেন দেশবাসী। আর কোথাও তো এই সুযোগ মেলে না। ক্রিকেটাররাই সৃষ্টি করেছেন সেই প্রত্যাশা। সঙ্গত কারণেই তাদের প্রত্যাশার তুমুল ভার বইতে হয়। সর্বক্ষণ থাকতে হয় আতস কাচের নিচে। প্রত্যাশা কিংবা অন্য কোনো কারণেও হতে পারে, এই দলটি নিয়ে এত কাটাছেঁড়া করা হয়, অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হয় বৈকি। অকথিতভাবে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের এত নির্বাচক ও বোদ্ধা, যা অনায়াসেই গিনেসের বিশ্ব রেকর্ডে স্থান করে নিতে পারে।

USA Cricket

ক্রিকেট খেলার কৌশল, নিয়ম-কানুন কিংবা ক্রিকেট সংস্কৃতির সঙ্গে ক্ষীণতম যোগাযোগ না থাকলেও অধিকাংশই এমনভাবে পর্যালোচনা বা সমালোচনা করেন যেন তারা প্রত্যেকেই ক্রিকেটের মহামহোপাধ্যায়। তাদের অভিমত বা মন্তব্য অনুসরণ করা হলে বাংলাদেশ হবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন কিংবা অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক দল!

তাহলে কেন তাদের গুরুত্ব দেওয়া হয় না? এ বিষয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নতুন ভাবনার দাবি রাখে। জাতীয় দল নির্বাচনের জন্য তারা একটি গণভোট আয়োজন করতে পারে। ভোটের ফল পাওয়ার পর তা থেকে নির্বাচকরা দল গঠন করবেন। তাতে যদি কথিত জনমনে সংশয় বা অনাস্থা খানিকটা দূর করা যায়!

মজার ব্যাপার, বেশিরভাগ সমালোচনা করা হয় ঘটনা ঘটার অর্থাৎ খেলা হয়ে যাওয়ার পর। তার আগে বোধকরি বুদ্ধির গোড়ায় তারা শান দিয়ে থাকেন। সময়-সুযোগ বুঝে আত্মপ্রকাশ করেন সমালোচনার ছুরি নিয়ে। কি-বোর্ডকে তারা বানিয়ে ফেলেন ক্ষুরধার এক অস্ত্র। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে ঘায়েল করার জন্য বড় একটা গোষ্ঠী সারাক্ষণই মুখিয়ে থাকে। পান থেকে চুন খসলেই হয়েছে, একদমই রক্ষে নেই। ভীমরুলের মতো ছেকে ধরেন। তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ হতে হয় ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদের। মানসিকভাবে হতে হয় রক্তাক্ত।

সমালোচকদের বড় একটি অংশ দলের ক্রিকেটারদের রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করেন কি না সন্দেহ। তাদের বোধকরি অতিমানবীয় মনে করা হয়। যেন প্রত্যেক ক্রিকেটারই চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের আঁকা অতিকায় বলিষ্ঠ মানব। চাইলেই মাঠে যা খুশি তা করতে পারেন। এমন দিব্যি দিয়ে যেন তারা খেলতে এসেছেন। কিন্তু কেন যেন তারা ইচ্ছে করেই নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন না!

কোনো গবেষণা ছাড়াই একটু ঝুঁকি নিয়ে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে, সবচেয়ে আলোচিত বা সমালোচিত দল হচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল। সমালোচনার এই চাপ ও তাপ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিতে পারেন না দলের ক্রিকেটাররা। মনের মধ্যে যখনই তা ভর করে, খেলতে পারেন না স্বাভাবিক খেলা। ছন্দপতন হয়। ধারাবাহিকতার ক্ষেত্রেও বড্ড খামতি রয়ে যায়।

এ কারণে প্রায়শই দলটি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। তবে এ কথাও মানতে হবে, বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের বরাবরই অযৌক্তিক আলোচনা আর কঠোর সমালোচনার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। সঙ্গত কারণেই এতদিনে এ ক্ষেত্রে তাদের গা সয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ক্রিকেটাররা কেন যেন তাতে অভ্যস্ত হতে পারেননি। যে কারণে এই সমালোচনার ভয় তাদেরকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। মনস্তাত্ত্বিক এ সমস্যাকে উপেক্ষা করে দেখার সুযোগ নেই।

এবার যুক্তরাষ্ট্র এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজে যৌথভাবে আয়োজিত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশ দল। ক্ষুদ্র সংস্করণের এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স বরাবরই অনুজ্জ্বল। কখনোই সুবিধা করতে পারেনি। এবারও বাংলাদেশকে নিয়ে বড় কোনও প্রত্যাশার কথা জানাননি টিম ম্যানেজমেন্ট।

বোধকরি অতীত পরিসংখ্যান, দলের দুর্বলতা ও সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স এর কারণ হতে পারে। দেশের মাটিতে সর্বশেষ দুই সিরিজে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজ হেরেছে এবং জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ জিতলেও দলের পারফরম্যান্স গর্বিত হওয়ার মতো ছিল না। মাস ছয়েক আগে ভারতে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপেও বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ছিল খুবই হতাশাজনক।

Bd team

সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় থাকতেই বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত বলেছেন, ‘প্রতিবারই বিশ্বকাপ নিয়ে অনেক কথা হয়। সবাইকে অনুরোধ করছি, প্রত্যাশা বেশি না রাখতে। আপনার যা প্রত্যাশাই থাকুক না কেন, অনুগ্রহ করে সেগুলো আপনার মনের মধ্যেই রাখুন। আমরা জানি, খেলোয়াড়রা কী করতে চায়? দলের সদস্যরা ১২০ শতাংশ দিতে চায়। আমি গ্যারান্টি দিতে পারি, আমরা অনেক আশা নিয়ে খেলি।’

অধিনায়ক রীতিমতো মিনতি করেছেন, দলকে নিয়ে প্রত্যাশা না করতে। প্রত্যাশা করলেও তা নিয়ে সরব না হতে অনুরোধ জানিয়েছেন।

জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু অভিজ্ঞতার আলোকে বলেছেন, ‘বড় লক্ষ্য পূরণ করার মতো দল এখনও হয়ে উঠেনি বাংলাদেশ। অবশ্যই দলের কাছে আমাদের প্রত্যাশা রয়েছে এবং আমরা চাই, তারা প্রথম রাউন্ড পেরিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠুক। আমরা যদি দ্বিতীয় রাউন্ডে পৌঁছাতে পারি, তাহলে অবশ্যই সেই রাউন্ড পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা থাকবে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে আমাদের দল এখনও এমন একটি স্তরে পৌঁছায়নি, যেখানে আপনি ধরে নিতে পারেন যে আমরা সেমিফাইনালে উঠব। তবে ক্রিকেট খেলায় যে কোনও কিছু ঘটতে পারে।’

দলের অন্যতম দুই কাণ্ডারি বাংলাদেশ দলকে নিয়ে খুব একটা আশাবাদী নন। এ নিয়ে তারা কোনও লুকোচুরিও খেলেননি। না হওয়ার কারণ তারা সরাসরি জানিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হতে পারে, টিম ম্যানেজমেন্ট যেহেতু জানে, এই দল নিয়ে বেশি প্রত্যাশা করা যাবে না, তাহলে প্রত্যাশা করা যায়, তেমন একটা দল কেন গঠন করা হলো না? বিষয়টা হচ্ছে, এই দলের বাইরে যে বা যারা আছেন, তারাও তো অপরীক্ষিত নন, তাদের দলভুক্ত করা হলেই কি বাংলাদেশ দল প্রত্যাশার রঙে রাঙাতে পারবে? এমন নিশ্চয়তা কি কেউ দিতে পারবেন? সেই ক্রিকেটাররাও ব্যর্থ হলে একই রকম সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হতে হতো। থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়।

নির্বাচকদের বিবেচনায় শ্রেয়তর দলটি গঠন করা হয়েছে। শ্রেয়তর দল হলেও প্রত্যাশা পূরণের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি। তাই জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক লিপু স্পষ্টতই বলেছেন, ‘বড় লক্ষ্য পূরণ করার মতো দল হয়ে উঠেনি বাংলাদেশ।’ এখন কথা হলো, সেটা কবে হয়ে উঠবে? তার জন্য তো বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হবে। আর এটি নির্ভর করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের যথাযথ পরিকল্পনা ও সাংগঠনিক দক্ষতার ওপর।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেটে প্রস্তুতির অংশ হিসেবে স্বাগতিক যুক্তরাষ্ট্র দলের বিপক্ষে দ্বি-দেশীয় তিন ম্যাচের সিরিজে অংশ নেয় বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এটি দুই দলের প্রথম সাক্ষাৎ। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ ৯ এবং আইসিসির সহযোগী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র ১৯ নম্বরে। এ থেকেই বোঝা যায় দুই দলের ব্যবধান।

কিন্তু পঁচা শামুকে পা কাটার মতো এই সিরিজে ২-১ এ হেরেছে বাংলাদেশ! অবশ্য আমেরিকানদের দলটিকে পঁচা শামুক বললে তাদের অবমূল্যায়ন করা হয়। এই দলের ক্রিকেট ইতিহাস ১৮০ বছরের পুরানো। তবে তা মোটেও সমৃদ্ধ নয়। ভারত, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিকেটারদের নিয়ে গড়া বর্তমান দলটি শক্তির দিক দিয়ে মোটেও উপেক্ষা করার মতো নয়।

তাই বলে অনেকটা পার্টটাইম ক্রিকেট খেলা এই দলের কাছে বাংলাদেশ সিরিজ হারবে! আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শক্তিমান দল না হলেও বাংলাদেশকে সমীহ করে খেলতে হয় প্রতিপক্ষকে। যে কোনও দলকে হারিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য রাখেন টাইগাররা। যুক্তরাষ্ট্র দলকে হোয়াইটওয়াশ করার সক্ষমতা যদি না থাকে, তাহলে বিশ্বকাপে কী করবে এই বাংলাদেশ?

যে মার্কিনীদের মাতব্বরি আর মস্তানিতে (রাজনৈতিক ক্ষেত্রে) সর্বদা মাথা নিচু করে থাকতে হয়, তাদেরকে শোচনীয়ভাবে নাজেহাল করার এমন একটা মোক্ষম সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া হয়ে গেল! যদিও তৃতীয় ম্যাচে নিয়মিত খেলোয়াড়দের অনুপস্থিতিতে আরও বেশি দুর্বল হয়ে পড়া মার্কিনীদের বিপক্ষে টাইগারদের প্রত্যাশিত দাপট দেখা যায়; কিন্তু তার আগেই সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। বাংলাদেশ দলকে নিয়ে বেশি প্রত্যাশা না করলেও প্রত্যাশার এতটা অবনমন কিভাবে হজম করা যায়?

Shanto

এই হার উগ্র সমালোচকদের আরও বেশি উস্কে দেবে, এটা তো খুবই স্বাভাবিক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তো বটেই সর্বত্রই আক্রমণাত্মক সমালোচনার মুখে পড়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। ক্রিকেটারদের কিভাবে মানসিকভাবে ক্ষত-বিক্ষত করা যায়, তার সর্বোত্তম উপায় ব্যবহার করা হয়।

অবশ্য এই সিরিজ পরাজয় সর্বস্তরের ক্রিকেটানুরাগীদেরও দারুণভাবে মর্মাহত করেছে৷ যে কোনও নাগরিকের কাছে অবশ্যই এটা আত্মসম্মানে ঘা দেওয়ার মতো ঘটনা। একে তো দুর্বল প্রতিপক্ষের কাছে অপ্রত্যাশিত সিরিজ হারানো এবং এই পরাজয় ঘিরে সমালোচনার ধারালো তরবারিতে বিদীর্ণ ক্রিকেটারদের হৃদয়। তাতে বোধকরি দলটা মানসিকভাবে অনেকটা এলোমেলো হয়ে যায়। হোয়াইটওয়াশ হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ায় এখন তা কতটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে, সেটাই বড় কথা।

অধিনায়ক প্রথম দুই ম্যাচ হারের যুক্তি দিতে গিয়ে উত্থাপন করেছেন অযৌক্তিক প্রসঙ্গ। খানিকটা তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। এটা দলের জন্য ক্ষতিকর। এখন প্রয়োজন দলকে উজ্জীবিত করা। ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলার তালিম দেওয়া। সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে ক্রিকেটারদের সহানুভূতি জানানো। তাহলেই তারা ধীরে ধীরে ফিরে পেতে পারেন আস্থা ও আত্মবিশ্বাস এবং জয়ের মনোবল।

বিশ্বকাপ অভিযানের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের পথে দলের যাত্রা সবে শুরু হয়েছে। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছানোর আগে চলার পথে অপ্রত্যাশিত বাধাবিঘ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। যদিও এই পথ চলা থেকে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির সালসা সংগ্রহ করার একটা প্রচেষ্টা থাকে। পথচলা এখনও চলছে।

তার আগে ভালো-মন্দ আরও অভিজ্ঞতা হতেই পারে। কিন্তু নিজেদের মধ্যে ‘বোঝাপড়া’টা হতে হবে এমন, ‘মনেরে আজ কহ যে/ভালো মন্দ যাহাই আসুক/সত্যেরে লও সহজে।’ এই দীক্ষা ও অনুপ্রেরণা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারলে ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।

আইএইচএস/