বিশ্বকাপ হোক উপভোগের মন্ত্রে উজ্জীবিত
আমেরিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের সিরিজ হারের দায় অনেকটা অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তর উপর বর্তায়। নিজে খেলোয়াড় হিসেবে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। দলকেও উজ্জীবিত করতে পারেননি। মাঠে বোলিং পরিবর্তন দেখে মাঝে-সাঁঝে তাকে মনে হয়েছে একেবারেই আনাড়ি। দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা স্বভাবতই ক্ষুব্ধ। কিন্তু কিইবা করার আছে তাদের। শান্ত অধিনায়ক না থাকলেও যে এমনটা ঘটত না সে-কথা হলফ করে বলা যায় না।
টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক নিয়ে বাংলাদেশ গত কয়েক বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষা অনেক করেছে। মাঝে তো পরিস্থিতি এমন হয়েছে, তালে গোলে এক ম্যাচের জন্য ক্যাপ্টেন্সি পেয়ে গিয়েছিলেন মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত। অনেকটা ২০০৪ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে রাজিন সালেহ যেভাবে ক্যাপ্টেন হয়েছিলেন সেভাবে। সাম্প্রতিক সময়ে যখনই এ ধরণের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, বাংলাদেশ ফিরে গেছে সাকিব আল হাসানের কাছে। তাতে কাজের কাজ কি হয়েছে, সেটা অবশ্য বলা মুশকিল। সর্বশেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপই যার বড় প্রমাণ।
হাতে অন্য যেসব অপশন ছিল তার কোনোটাই সন্দেহাতীত ছিল না। তাসকিন আহমেদের ইনজুরি প্রবণতা, টি-টোয়েন্টি দলে জায়গা পাওয়া নিয়ে মেহেদি হাসান মিরাজের অনিশ্চয়তা, লিটন দাসের অনাগ্রহ ও ফর্ম সমস্যা শান্তকে নেতৃত্বের ভার এনে দিয়েছে। হয়তোবা খেলোয়াড় হিসেবে যথেষ্ট পরিপক্ব হওয়ার আগেই তিনি এটা পেয়েছেন। নেতৃত্ব পাওয়ার পরও আজ অবধি তিনি এমন কোনো বাড়তি ক্যারিশমা দেখাতে পারেননি যা ক্যাপ্টেন হিসেবে তাকে দুর্দান্ত প্রমাণ করবে।
কিন্তু এটাই বাংলাদেশ। এখন শান্তকে সবার সর্বান্তকরণে সমর্থন করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। দল খারাপ করলে সমালোচনা হবেই। শান্তরও সমালোচনা হবে; কিন্তু এখন এমন কিছু বিষয়ে তার সমালোচনা হচ্ছে যা তার উপর চাপ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
উগান্ডার অধিনায়কের পর এই বিশ্বকাপে অধিনায়কদের মধ্যে তার স্ট্রাইক রেট সবচাইতে কম- এটা আবিষ্কারের পর যে ধরণের সমালোচনা হচ্ছে তার অনেকটা অন্যায্য। এ ধরণের পরিসংখ্যান দিয়ে যদি একজন খেলোয়াড়কে মাপা হয়, তাহলে শান্তও চাইলে সারা জীবন নিজেকে ডন ব্র্যাডমান দাবি করতে পারবেন। জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক ইনিংসে ব্র্যাডমানের রান ১৮। শান্ত’র ও তো তাই!
শচিন টেন্ডুলকার জীবনে একটাই আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। তাতে তার রান ১০, স্ট্রাইক রেট ৮৩। বাংলাদেশের মোহাম্মদ রফিকও আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলেছেন একটাই। রান করেছেন ১৩, স্ট্রাইক রেট ২৬০। এখন এসব দেখে কেউ যদি রফিককে টেন্ডুলকারের চাইতে বড় ব্যাটার আর শান্তকে ভেবে বসেন ব্র্যাডমান- সেটা নিশ্চয় হাস্যকর হবে! তেমনি উগান্ডার অধিনায়ক ছাড়া আর সব অধিনায়কের স্ট্রাইক রেট তার চাইতে বেশি বলে শান্ত তাদের সবার চাইতে খারাপ- এটা ভাবাও হাস্যকর হবে।
আসলে শান্ত বাংলাদেশের জাতীয় চরিত্রের বাইরে কেউ নন। বাংলাদেশের খেলার ধরণটাই এমন, এখানে টপ অর্ডারে তেড়ে-ফুঁড়ে মারার মত কেউ নেই। পাওয়ার প্লে’তেই ম্যাচ থেকে ছিটকে গেছে বাংলাদেশ অনেকবার; কিন্তু এত সমস্যার পরও বাংলাদেশ এই বিশ্বকাপের আগে ৬৫টা ম্যাচ জিতেছে। তাদের শিকারের তালিকায় অনেক বড় বড় প্রতিপক্ষও আছে। এই শান্তই গত বছর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুটো ম্যাচ জেতায় বড় ভূমিকা রেখেছেন। এখন খেলা ভুলে আবার নিজেকে খুঁজে ফিরছেন।
লিটন দাসের অবস্থা হয়েছে আরো খারাপ। গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ১২০ কোটি ভারতবাসীর বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলেন লিটন। এখন নিজেই কাঁপছেন। দেশের সবচাইতে সাবলীল ব্যাটার এখন মারতে গেলেই আউট হয়ে যাচ্ছেন। প্রতিদিন তাদের চাপের বোঝা ভারী হচ্ছে। তাতে খেলোয়াড় হিসেবে কেবল লিটন আর শান্তই নন, বাংলাদেশের প্রায় সবারই চিড়ে-চ্যাপটা হওয়ার দশা।
এসবের পাশ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে এসেছে আমেরিকার মতো দলের বিপক্ষে সিরিজ হার। মাঠের ফলাফল যেমনই হোক আমেরিকাকে বাংলাদেশের চেয়ে ভাল দল মনে করার কোনো কারণ নেই; কিন্তু দল হিসেবে তারা চাপমুক্ত হয়ে খেলতে পেরেছে যা বাংলাদেশ পারেনি। হারের ভয়ে ভাল অবস্থানে থেকেও প্রথম দুই ম্যাচে খেলা থেকে ছিটকে গেছে বাংলাদেশ।
এই সিরিজ হার আসন্ন টি-টেয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে দুই ভাবে প্রভাবিত করতে পারে। মানসিকভাবে তাদের আরো চাপে ফেলে দিতে পারে, অথবা তাদের ওপর প্রত্যাশার যে চাপ আছে তা পুরোপুরি সরিয়ে দিতে পারে।
শেষ ম্যাচটা ১০ উইকেটে জেতায় দ্বিতীয়টা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। মানসিক চাপ এই জয়ে কিছুটা হলেও কমেছে। প্রত্যাশার চাপ কমেছে আগের দুই ম্যাচেই। সব মিলিয়ে এই বিশ্বকাপটা বাংলাদেশ খেলতে যাচ্ছে অনেকটা নির্ভার হয়ে।
তাদের এখানে হারানোর কিছু নেই। যারা আমেরিকার কাছে হারতে পারে, তারা শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকার কাছেও হারতে পারবে। টুর্ণামেন্টে প্রথম দুই ম্যাচ এই দুই দলের বিপক্ষেই খেলবে বাংলাদেশ।
সমস্যাটা তৈরি হবে যদি এই দুই দলের কোনো একটির সঙ্গে জিতে যায়। প্রত্যাশার পারদ তখন আবার আকাশে উঠে যাবে এবং বাংলাদেশকে তখন নেপাল ও নেদারল্যান্ড্স এর সঙ্গে জিততেই হবে। দল হিসেবে বাংলাদেশ যে রকম অধারাবাহিক এই দুই ম্যাচও যে তাদের জন্য সহজ হবে না সেটা এখনই বলে দেয়া যায়। তবে নিজেদের খেলাটা বাংলাদেশ যদি খেলতে পারে, ফলাফল তাদের পক্ষে আসার সম্ভবানাই বেশি।
বাংলাদেশে এখন তাই প্রয়োজন সব সমালোচনাকে দূরে ঠেলে বিশ্বকাপ খেলা উপভোগের মন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়া। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তার মেঘের কাহিনী কবিতায় লিখেছেন, ‘বিশ্বের ডাক শুনেছি আবার, হৃদয় ভরেছে স্নেহে, বিশ্বের প্রেমে পরাণ আমার ধরে না ক্ষুদ্র দেহে।’
অজস্র দর্শক সমর্থকের হৃদয় ভরা স্নেহের কথা মাথায় রেখে খেলতে পারলে সাফল্য তাদের অনিবার্য।
আইএইচএস/