বাংলাদেশের সেরা বিশ্বকাপ, পার্শ্ব নায়ক থেকে মহানায়ক মাহমুদউল্লাহ
আকাশপথে ঢাকা থেকে কুয়ালামপুর হয়ে মেলবোর্ন। ২০১৫ বিশ্বকাপ কভার করতে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে উঠেই পেলাম অপ্রত্যাশিত আতিথ্য। ইকোনমি ক্লাসের টিকিট, আমরা তিন সাংবাদিক বসেছিলামও নিজেদের সিটে। বিমান যখন টেক অফ করতে রানওয়েতে, তখন ইকোনমি ক্লাস থেকে আমাদেরকে উঠিয়ে বিজনেস ক্লাসে সিট দেয়া হলো!
এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের (এএফসি) সভায় যোগ দিতে ওই ফ্লাইটে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন আমাদের সহযাত্রী! ঢাকা থেকে কুয়ালামপুর যাত্রাপথে বাফুফে সভাপতির সঙ্গে অনেক কথা হলো। আমরা বিশ্বকাপ ক্রিকেট কভার করতে যাচ্ছি শুনেই সালাউদ্দিন ভাই বললেন- ‘আমি নিশ্চিত, এবার তোমরা দারুণ একটা সুখবর নিয়ে দেশে ফিরবে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এবার বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলবে।’
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি ক্রিকেটকে ঘিরে এতোটা সম্ভাবনা দেখছেন কিভাবে? তার একটা সমীকরণ মিলিয়ে দিলেন সালাউদ্দিন ভাই- ‘গ্রুপ রাউন্ডে আফগানিস্তান, স্কটল্যান্ডকে বাংলাদেশ বড় ব্যবধানে হারাবে। শ্রীলঙ্কা-ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের স্ট্যান্ডার্ডের কাছাকাছি বাংলাদেশ। এই দুটি দলের মধ্যে একটিকে হারাতে পারলেই হবে।’
বাংলাদেশের ক্রিকেটের খোঁজ-খবর রাখেন বাফুফে বস। এর পেছনে একটা কারণও আছে। ফুটবলের পাশাপাশি সালউদ্দিন ক্রিকেটও খেলতেন। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রথম হাফ সেঞ্চুরিয়ান সে সময়ের বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তারকা ফুটবলার সালাউদ্দিন আজাদ বয়েজের অপরিহার্য ক্রিকেটারও ছিলেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটের শুভাকাঙ্খী হওয়ার পেছনে এটাও বড় কারণ।
সালাউদ্দিন ভাই যে সমীকরণে বাংলাদেশ কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছেন, আমরা অতোটা আশাবাদী ছিলাম না। বিশ্বকাপ মিশনের আগে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলও খুব বেশি স্বপ্ন দেখায়নি। কারণ, অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড সফরে বাংলাদেশের অতীত মোটেও সুখকর নয়।
২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ডে বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলতে যাওয়ার আগে এই দুটি দেশে দুবার করে সফর করেছে বাংলাদেশ দল। হোয়াইট ওয়াশ হয়ে ফিরতে হয়েছে ওই চারবার। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের উইকেট পেস বোলারদের জন্য ভয়ংকর। বাংলাদেশ ব্যাটারদের জন্য এখানকার উইকেটে প্রতিকূলই বটে।
২০১৫ বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচ আফগানিস্তানের বিপক্ষে। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপে যাদের কাছে হারের অতীত আছে। বিশ্বকাপের শুরুতে যদি বড় ঝাঁকুনি আসে, তাহলে বাংলাদেশ দল হয়ে যাবে এলোমেলো। এটাও ছিল শঙ্কা।
প্রতিকূল কন্ডিশন থেকে ভালো কিছু অর্জনে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিকল্পনা ছিল যথার্থ। ২০১৫ বিশ্বকাপে অংশ নিতে আইসিসির অফিসিয়াল আতিথ্য পাওয়ার আগে ১৫ দিনের অনুশীলন ক্যাম্প করতে পেরেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে।
ব্রিসবেনে থাকা-খাওয়া, এই অনুশীলন ক্যাম্প , সেখানকার মাঠ এবং জিম ব্যবহারের পুরো খরচ বহন করেছে বিসিবি। অনুশীলন ক্যাম্পে ২টি প্রস্তুতি ম্যাচও খেলেছে বাংলাদেশ দল। অস্ট্রেলিয়ার প্রাদেশিক দল এবং বিগ ব্যাশের দলে চন্ডিকা হাথুরুসিংহের কোচিংয়ের অভিজ্ঞতা আছে বলে বিশ্বকাপের ৯ মাস আগে তাকে বাংলাদেশ দলের হেড কোচের দায়িত্ব দেয়াটাও ছিল যথার্থ সিদ্ধান্ত। হাথুরুসিংহে বাংলাদেশ দলের হেড কোচ হয়ে শ্রীলঙ্কার সাবেক ক্রিকেটার থিলান সামারাবিরাকে কোচিং স্টাফে নিয়েছেন, এখানেও অস্ট্রেলিয়ান কানেকশন। বিশ্বকাপকে সামনে রেখে এসব পরিকল্পনার সুফলই পেয়েছে বাংলাদেশ দল।
অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের সূচিটা স্বস্তিদায়ক ছিল না। গ্রুপ রাউন্ডে ৬টি ম্যাচের মধ্যে দু’বার নিউজিল্যান্ড সফর করতে হয়েছে বাংলাদেশ দলকে। সূচি তৈরির সময় বিসিবির মতামত আইসিসিতে কতটা বিবেচ্য হয়েছে, এটাও ছিল প্রশ্ন। তবে এসব আমলে না নিয়ে বাংলাদেশ দল এই বিশ্বকাপটা খেলেছে অন্য একটা জিদ নিয়ে।
অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সমর্থনও ক্রিকেটারদের পারফর্ম করতে উদ্বুদ্ধ করেছে বেশি। বাংলাদেশের প্রতিটি ম্যাচে ব্রেকের সময়ে জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গান বেজে উঠেছে স্টেডিয়ামগুলোতে। স্টেডিয়ামের বাইরে ফ্যানজোনে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও ক্রিকেট দলকে করেছে উদ্দীপ্ত।
ক্যানবেরার মানুকা ওভালে আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ বাংলাদেশ দল নিজেদের হোম ভেন্যু ভেবেই খেলেছিলো। আশ্চর্য হলেও সত্য, ওই ম্যাচে স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শকের ৯০ শতাংশই ছিল বাংলাদেশের। ওই ম্যাচে তাসকিন-রুবেলের বেশ ক’টি ডেলিভারি ছাড়িয়ে গেছে ঘন্টায় ১৪০ কিলোমিটার! স্পিডগান শো করেছে তা। ক্যানবেরায় প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১০৫ রানে জয় বাংলাদেশ দলকে এনে দিয়েছে দারুন ছন্দ।
তিনদিন পর ব্রিসবেনে বৃষ্টির কারণে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটি পরিত্যক্ত ঘোষিত হলে ওই ম্যাচ থেকে এক পয়েন্ট অর্জন বাংলাদেশকে দিয়েছে এগিয়ে। সে সময়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ক্রিকেট স্টেডিয়াম মেলবোর্নে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি।
বিশাল মাঠ, অনেক উচুঁ স্টেডিয়াম এবং অনেক উঁচু থেকে ফ্লাড লাইট বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের ফেলেছে সমস্যায়। শ্রীলঙ্কার কাছে ৯২ রানে হেরেছে বাংলাদেশ তৃতীয় ম্যাচে। মেলবোর্ন থেকে ক্রাইস্টচার্চ হয়ে নেলসন। আকাশপথের দূরত্ব প্রায় ৬ ঘণ্টা। এই যাত্রা পথটাই বাংলাদেশ থেকে বিশ্বকাপ কভার করতে যাওয়া সাংবাদিকদের ফেলেছে ভোগান্তিতে।
মাত্র কিছুদিন আগে বড় ধরণের ভূমিকম্প হওয়ায় ক্রাইস্টচার্চ-নেলসন বাস সার্ভিস অনিয়মিত। সারা রাত ক্রাইস্টচার্চ বিমানবন্দরের আশে-পাশে ঘোরাঘুরি করে মাত্র ৫৫ মিনিটের ওয়ানওয়ে ফ্লাইটের টিকিট ৩৫০ ডলার দিয়ে কাটতে হয়েছে নিরুপায় হয়ে। নেলসনে নেমে বিস্ময়ে ঘোর কাটছে না কিছুতেই। প্রকৃতি এতো সবুজ হয় কী করে? এটাই ছিল কৌতুহল।
সবুজ ঘেরা ছোট্ট শহর নেলসনে প্রেসবক্স অস্থায়ীভাবে বানানো হয়েছে। বাউন্ডারি রোপের পাশে সাদা তাবু টানিয়ে তার নিচে চেয়ার-টেবিল বসিয়ে, সেখানে ইন্টারনেট কানেকশন দেয়া হয়েছে মিডিয়ার জন্য। চার-ছক্কা’র শটের দিকে চোখ না রাখলে বলের আঘাতে আহত হওয়ার শঙ্কা ছিল। ল্যাপটপও হতে পারে ক্ষতিগ্রস্থ।
মাঠে ফিল্ডিংয়ের সময় ক্রিকেটারদের কথা স্পষ্ট শুনতে পাওয়া যায় এই মিডিয়া বক্সে বসে। প্রকৃতিরাজ্যের মধ্যে গড়ে ওঠা এই স্টেডিয়ামে স্বেচ্ছাসেবক, নিরাপত্তাকর্মী-কারো বয়স ৬০-এর নীচে নয়। এ যেনো এক বৃদ্ধ নিবাস!
স্কটল্যান্ডের কোচ শেন জার্গেনসেন বাংলাদেশ দলের কোচের দায়িত্বে ছিলেন প্রায় ২ বছর। রিচার্ড পাইবাস দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার পর প্রথমে ভারপ্রাপ্ত কোচ, পরবর্তীতে বাংলাদেশ দলের হেড কোচ হিসেবে ছিলেন তিনি। মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ, রুবেল, তাসকিন-সবাইকে চেনেন জার্গেনসেন। তাই স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে খেলতে নেমে তাদের কোচকেই প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে মনে করতে হয়েছে।
নেলসনের ফাস্ট আউটফিল্ড সেদিন বাংলাদেশ ফিল্ডারদের ভাবনায় ফেলে দিয়েছিলো। ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি উইকেটে বাংলাদেশ বোলাররা মার খেয়েছে যথেষ্ট। স্কটিশ ওপেনার কাইল কোয়েৎজার একাই টেনে নিয়েছেন দলকে। তার ১৩৪ বলে ১৫৬ রানের ইনিংসে ভর করে প্রথমে ব্যাট করে স্কটল্যান্ড ৮ উইকেট হারিয়ে ৩১৮ রান করলে দুর্ভাবনাই পিছু নিয়েছিল বাংলাদেশের।
বিশ্বকাপে এর আগে কখনও ৩শ’ করতে পারেনি বাংলাদেশ। তাহলে ৩১৯ রান তাড়া করবে কিভাবে? এটাই ছিল প্রশ্ন। এ প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে সেদিন হাথুরুসিংহে ব্যাটিং অর্ডার রদবদল করেছেন। ফিল্ডিংয়ের সময় এনামুল হক বিজয় আহত হলে বাধ্য হয়ে মাহমুদউল্লাহকে তিন নম্বরে নামিয়েছেন।
তার সুফলটা পেয়েছে বাংলাদেশ দল। দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে তামিম-মাহমুদউল্লাহ ১৩১ বলে ১৩৯ রান যোগ করে দলকে রেখেছেন জয়ের কক্ষপথে। ১১ বল হাতে রেখে ৬ উইকেটে জিতেছে বাংলাদেশ ওই ম্যাচে। ভাগ্যটা খারাপ তামিমের। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান হতে পারতেন এই বাঁ-হাতি ওপেনার। যেভাবে খেলেছেন, তাতে তামিমের সেঞ্চুরিকে অভিনন্দিত করতে ডাগ আউট টিমমেটরা সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন; কিন্তু ভুলটা করলেন তামিম। স্কটিশ পেসার জস ডেভিকে ক্রস খেলতে যেয়ে এলবিডব্লুতে থামলেন সেঞ্চুরি থেকে যখন মাত্র ৫ রান দূরে, তখন।
বিশ্বকাপে এই প্রথম তিনশ’ প্লাস তাড়া করে জয়ের আত্মবিশ্বাস নিয়ে তাসমান সাগর পাড়ি দিয়ে অ্যাডিলেডে বড় পরীক্ষার মুখে বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে হারাতে হবে ইংল্যান্ডকে। ডন ব্রাডম্যানের শহরে পা দিয়ে বাংলাদেশ ফিরে গেছে ৪ বছর আগে।
২০১১ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দেয়ার অতীত সুখস্মৃতি থেকে টনিক নিয়ে এডিলেডে এদিন অবতীর্ণ হয়েছে বাংলাদেশ দল। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ প্রথম সেঞ্চুরিয়ানের দেখা পেয়েছে এই ম্যাচে। মাহমুদউল্লাহর হাত ধরে সূচিত হয়েছে এই ইতিহাস (১০৩)। স্টুয়ার্ট ব্রডকে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে খেলে ১ রান নিয়ে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেই দিয়েছেন ফ্লাইং কিস। অ্যাডিলেডে টিম হোটেলে স্ত্রী-শিশুপুত্রকে রেখে এসেছিলেন। তাই তাদের উদ্দেশ্যে সেঞ্চুরি উৎসর্গ করতে এই বিশেষ স্টাইলে উদযাপন মাহমুদউল্লাহ’র।
মুশফিকুর রহিমও এ দিন পেতে পারতেন সেঞ্চুরি। বিশ্বকাপে জোড়া সেঞ্চুরির প্রথম রেকর্ডটা সেদিনই দেখতে পারতো বাংলাদেশ। ১১ রানের জন্য সেই সুযোগ হাতছাড়া করেছেন মুশফিকুর রহিম। তবে চতুর্থ উইকেট জুটিতে মাহমুদউল্লাহ’র সঙ্গে ১৪১ রানে অবদান রেখে দলের স্কোর ২৭৫/৭ পর্যন্ত টেনে নিতে দারুণ ভুমিকা রেখেছেন তিনি।
২৭৫ রানের চ্যালেঞ্জিং স্কোর করে ইংল্যান্ডকে ভয়ংকর চাপে ফেলেছিলো বাংলাদেশ দল। এই পুঁজি নিয়ে ১৫ রানে বাংলাদেশ জিতেছে তিন পেস বোলার রুবেল (৯.৩-০-৫৩-৪), মাশরাফি (১০-০-৪৮-২) এবং তাসকিনের (৯-০-৫৯-২) দুর্ধর্ষ বোলিংয়ে। ৪৯তম ওভারের প্রথম বলে স্টুয়ার্ট ব্রড এবং তৃতীয় বলে এন্ডারসনকে বোল্ড করে রুবেল দিয়েছেন উৎসবের উপলক্ষ্য।
বাংলাদেশ দলের খেলা দেখতে এডিলেডের হসপিটালিটি বক্সে ছিলেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন এমপি। বাংলাদেশ দলের জয় উদযাপনে তিনি নেমে এসেছেন মাঠে! ক্রিকেটারদের সঙ্গে উৎসবে যোগ দিয়েছেন তিনিও। ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনটা সেদিন ছিল মাহমুদউল্লাহময়। বাংলাদেশ থেকে বিশ্বকাপ কভার করতে আসা সাংবাদিকরা সবাই মাহমুদউল্লাহ’র সঙ্গে ছবি তুলেছেন। প্রথম সেঞ্চুরির অফিসিয়াল স্কোরকার্ডে মাহমুদউল্লাহ’র অটোগ্রাফটাও আছে আমার সংগ্রহে।
ইংল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ। গ্রুপ রাউন্ডের শেষ ম্যাচে হ্যামিল্টনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে জিততে পারলে কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতকে এড়াতে পারত টাইগাররা। তবে ডিমেরিট পয়েন্ট পাওয়ায় ঝুঁকি এড়াতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অধিনায়ক মাশরাফিকে দেয়া হয়েছে বিশ্রাম।
এখানেই ভুলটা হয়েছিলো। সাকিবের ক্যাপ্টেনসিতে সেই ম্যাচে জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়ে বাংলাদেশ হেরে গেছে ৩ উইকেটে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাদের মাঠে সেবার বিশ্বকাপে ১৫০’র উপর স্কোর করতে পারেনি কেউ। ট্রেন্ট বোল্ট, সাউদিদের বলের গতি তখন ঘন্টায় দেড়শ’ কিলোমিটার ছুঁই ছুঁই।
হ্যামিল্টনে বোলিংয়ে গতিটা একটু বেশিই পান এই পেস জুটি। অথচ, সেই হ্যামিল্টনে ট্রু উইকেটে প্রথমে ব্যাট করে বাংলাদেশ করেছে ৮ উইকেটে ২৮৮ রান। বিশ্বকাপে উপর্যুপরি দ্বিতীয় সেঞ্চুরি পেয়েছেন মাহমুদউল্লাহ (১২৮*)। স্কোরশিটে ২৭ রান উঠতে ২ ওপেনার ফিরে যাওয়ার পর ব্যাটিংয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।
তৃতীয় উইকেট জুটিতে সৌম্যকে নিয়ে ১০৮ বলে ৯০, ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে সাব্বির রহমান রুম্মানকে নিয়ে ৪৮ বলে ৭৮ রানে দিয়েছেন নেতৃত্ব। তারপরও মাহমুদউল্লাহ’র এই সেঞ্চুরি ম্লান হয়েছে গাপটিলের সেঞ্চুরির কাছে (১০৫)। ৩ উইকেটে হেরে কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশ ভারতকে পেয়েছে প্রতিপক্ষ হিসেবে।
মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল দর্শক এবং দুই আম্পায়ার আলীম দার-ইয়ান গোল্ড। টিভি আম্পায়ার স্টিভ ডেভিসও নিয়েছেন তাদের পক্ষ। সুরেশ রায়নার স্কোর যখন ১০, মাশরাফির বলে পরিস্কার এলবিডাব্লুউ। অথচ, মাশরাফির আপিলের পর ‘নো’ কল করেছেন ইয়ান গোল্ড! ১০ রানে থেমে যাওয়ার কথা ছিল যার, সেই রায়না ইনিংস টেনে নিয়েছেন ৬৫ পর্যন্ত।
৯০ রানের মাথায় রুবেলকে পুল করতে যেয়ে ডিপ মিড উইকেটে ক্যাচ দিয়ে ড্রেসিং রুমের দিকে ফিরছেন যখন রোহিত শর্মা, তখন স্কোয়ার লেগ আম্পায়ারের ইশারায় স্ট্রাইক এন্ডের আম্পায়ার দিলেন ‘নো’ কল! বাংলাদেশের রিভিউ আপিল শেষ হয়ে যাওয়ায় এই সুযোগটা নিয়েছেন ওই দুই আম্পায়ার।
আম্পায়ারের কৃপায় বেঁচে যাওয়া এই রোহিত শর্মাই ইনিংসটা টেনে নিয়েছেন ১৩৭ পর্যন্ত। ইংল্যান্ড এবং নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পর পর ২ ম্যাচে সেঞ্চুরি করে হ্যাটট্রিক সেঞ্চুরির সংকল্প মাহমুদউল্লাহ’র। তার প্রতিপক্ষ এদিন টিভি আম্পায়ার স্টিভ ডেভিড!
মোহাম্মদ শামির শর্ট অব লেন্থ ডেলিভারিকে সাজা দিতে নিয়েছিলেন পুল শট। সেই শট বাউন্ডারি রোপের উপর ধাওয়ানের পা টাচ করার পরও টিভি আম্পায়ার স্টিভ ডেভিসের সিদ্ধান্ত অন্যায়ের পক্ষে! ২০১৫ বিশ্বকাপকে সামনে রেখে ক্রিকেট বাণিজ্যিকরণে ভারত-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ড মিলে অলিখিতভাবে ‘বিগ থ্রি’ জোট করেছিল। সেই জোটের কাছেই সেদিন হেরেছে বাংলাদেশ।
২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ওডিআই ক্রিকেটে ১০০তম ম্যাচ জয় দিয়ে উদযাপন করেছে ভারতকে ১৫ রানে হারিয়ে। ২০০৯ সালের ২৭ জুলাই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৩ উইকেটে হারিয়ে ২০০তম ম্যাচও উদযাপন করেছে জয় দিয়ে। তবে ২০১৫ সালের ১৯ মার্চ ৩০০তম ম্যাচের মাইলস্টোনে বাংলাদেশকে কাঁদিয়েছেন ম্যাচ অফিসিয়ালরা।
মেলবোর্ন অবিচারে (১০৯ রানে হার) কোয়ার্টার ফাইনালে থেমেছে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ মিশন। ম্যাচের আগের দিন বাংলাদেশ দলের সঙ্গে কিছুক্ষণ ফিল্ডিং অনুশীলন করেছেন। মেলবোর্নে বাংলাদেশ দলের অনুশীলনের উপর রিপোর্ট করতে এসে নিজ চোখে দেখেছি তা। অথচ, একদিন আগে বাংলাদেশের ক্রিকেটের পরম বন্ধু হিসেবে দেখেছি, পরদিন সেই পাকিস্তানি আম্পায়ার আলীম দার বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ!
মেলবোর্নের প্রেস বক্সের পাশে আইসিসি বক্স। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে অন্যায়ভাবে বিদায় করার দৃশ্যটা মানতে পারেননি তখনকার আইসিসি সভাপতি আ.হ.ম মোস্তফা কামাল (বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী)। বক্স থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে আইসিসির নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনে সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্র্যাউন্ডের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ইয়ারা নদীর উপর ব্রিজ, সেই ব্রিজ পেরুলে হোটেল ল্যাংহাম। ওই হোটেলের ২২ তলার স্যুটে বসে আ.হ.ম মোস্তফা কামাল দিয়েছিলেন আইসিসি সভাপতি হিসেবে দুই ভারতীয় সাংবাদিককে বিশাল সাক্ষাৎকার। সেই সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা আমাকেই করে দিতে হয়েছিল।
আমাকে পাশে বসিয়েই তিনি সেই সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। যে সাক্ষাৎকারেতে আইসিসি চেয়ারম্যান শ্রীনিবাসনকে ধুয়ে দিয়েছিলেন তিনি। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আইসিসির সভাপতি পদ অলংকৃত করেও আ.হ.ম মোস্তফা কামালের ক্ষমতা খর্ব করে চেয়ারম্যান পদে শ্রীনিবাসনকে বসিয়ে নির্বাহী ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তাকে।
বিশ্বকাপে বিজয়ী দলকে ট্রফি তুলে দিবেন আইসিসি সভাপতি, এটাই রেওয়াজ। সেই রেওয়াজ ভঙ্গ করে ২০১৫ বিশ্বকাপ জয়ী দলকে ট্রফি দিবেন আইসিসি চেয়ারম্যান! এমন আদেশই জারি করেছে আইসিসি সেবার। এই সিদ্ধান্তে আইসিসির উপর এমনিতেই ছিল তার ক্ষোভ। বাংলাদেশের বিপক্ষে পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ে তার সেই ক্ষোভটা বিস্ফোরিত হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপে পরিকল্পিত একটা দল হিসেবে নিজেদেরকে উপস্থাপন করতে পেরেছে মাশরাফিরা। বিশ্বকাপের আগে চিত্র- নায়িকা হ্যাপির দায়েরকৃত মামলায় বড় ধরনের ফেঁসে গিয়েছিলেন পেস বোলার রুবেল। তাকে ক’দিন কারাবাস পর্যন্ত ভোগ করতে হয়েছে।
এই রুবেলকে মামলা থেকে জামিনে বের করে আনতে প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা দিয়েছে বিসিবি। তার প্রতিদান দিয়েছেন রুবেল। একাদশে তিন পেস বোলার নিয়ে প্রতিটি ম্যাচ খেলার আইডিয়াটা এই বিশ্বকাপেই প্রথম দেখিয়েছে বাংলাদেশ দল। তাসকিন (৯ উইকেট), রুবেল (৮ উইকেট), মাশরাফি (৭ উইকেট) পেয়ে টিম ম্যানেজমেন্টের আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পেস ত্রয়ীর বোলিং মুগ্ধ করেছে সৌরভ গাঙ্গুলিকে। আমাকে দেয়া ইন্টারভিউতে সেই প্রশংসা করেছেন তিনি। বোলিংয়ে গতির লড়াইয়ে তাসকিন-রুবেলর মধ্যে সেবার পাল্লা জমে উঠেছিল। বলে-কয়ে ঘন্টায় ১৪০ কিলোমিটার প্লাস বোলিং করেছেন।
সাকিব, তামিম, মুশফিকুর রহিমরা দলে থাকায় বিশ্বকাপে মাহমুদউল্লাহ’র ব্যাটে নায়কোচিত পারফরমেন্স প্রত্যাশা করেনি কেউ। অথচ, বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ দলের পার্শ্ব নায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের মহানায়ক হিসেবে আবির্ভুত। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের প্রতিকূল কন্ডিশনকে জয় করা মাহমুদউল্লাহ ২ সেঞ্চুরি, ১ ফিফটিতে সেই বিশ্বকাপে ৭৩.০০ গড়ে করেছেন ৩৬৫ রান!
আইএইচএস/