কর্মকর্তাদের অপরিণামদর্শিতাই মোহামেডানের বিপর্যয়ের মূল কারণ
মোহামেডান কেন এত খারাপ খেলছে ? মাঠে একদম অগোছালো, অবিন্যস্ত, ছন্নছাড়া আর অনুজ্জ্বল মোহামেডান কি আসলে এত খারাপ দল?
মোহামেডানের চার ভাগের একভাগ বাজেটের দল অগ্রণী ব্যাংক, ব্রাদার্স ইউনিয়ন, সাইনপুকুর ও সিটি ক্লাবও জয়ের মুখ দেখেছে। অথচ, মোহামেডান পারেনি। কেন? কি কারণে সাদা কালোদের এত করুণ দশা?
উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই বেরিয়ে আসবে কর্মকর্তাদের অপরিণামদর্শী পরিকল্পনার বিষয়টি। তাদের এই অপরিণামদর্শী পরিকল্পনার কারণেই এবারের প্রিমিয়ার লিগে মোহামেডান গঠন করেছে তারকায় ঠাসা একটি অদুরদর্শী দল।
খালি চোখে মোহামেডানকে যত সমৃদ্ধ দল মনে হয় আসলে দলটি তা নয়। ক্লাবের কর্মকর্তারা সাকিব, মিরাজ, রিয়াদ, সৌম্যদের নিয়ে ‘হাইপ’ তোলার চেষ্টা করেছেন বেশি। মাঠের খেলায় এসব ক্রিকেটাররা উপস্থিত থাকতে পারবেন কি না সেটা তলিয়ে দেখেননি।
কর্মকর্তারা দলের ভেতরের অবস্থা খুঁটিয়ে দেখেননি। তারা যে দল গঠন করেছেন, সে দলটি যে ব্যালেন্সড নয়, ব্যাটিং ও বোলিংয়ে যে বহু ফাঁক-ফোকর আছে, সেটাও খুটিয়ে দেখেননি তারা।
ক্রিকেটারদের বর্তমান ফর্ম, ফিটনেস এবং ভাল খেলার দৃঢ় সংকল্প আছে, নিজেকে মেলে ধরতে মুখিয়ে এবং ভবিষ্যত উজ্জ্বল- এমন পারফরমারের চেয়ে মোহামেডান দুই বছর ধরে নাম-ডাক, তারকা খ্যাতির দিকেই ঝুঁকেছে বেশী। এমন তারকার দিকে ঝুঁকেছে, যাদের এক সময় রাজত্ব ছিল; কিন্তু এখন তারা নখ-দন্তহীন রাজ্য হারানো সিংহ।
গত লিগে কিছুই করতে পারেননি এসব ‘বড় মাপের’ ক্রিকেটার। একটি ম্যাচ একা হাতে জেতানোর রেকর্ড নেই, তা জেনেও ওপেনার সৌম্য সরকার আর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে দলে রাখা হয়েছে। দু’জনের অবস্থা এবার ভীষণ খারাপ। রিয়াদ তবু প্রথম ম্যাচে ফিফটি হাঁকিয়েছেন। শেষ ম্যাচে লিজেন্ডস অব রুপগঞ্জের বিপক্ষে ২৬ বলে ৪২ করা ছাড়া বাকি তিন ম্যাচে সৌম্য কিছুই করতে পারেননি।
সৌম্যকে দলে রাখলেও তরুণ সম্ভাবনাময় ওপেনার পারভেজ ইমনকে ছেড়ে দিয়ে চরম অদূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন মোহামেডান কর্মকর্তারা। এটাই শেষ নয়, উইকেটরক্ষক কাম হার্ডহিটার ইরফান শুক্কুর ভাল খেলেছেন আগের বার, তাকেও এবার রাখা হয়নি। ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
অথচ, এবার রূপগঞ্জ টাইগার্সে গিয়ে নিয়মিত রান করছেন ইরফান শুক্কুর। সাকিব, মিরাজ আর রনি তালুকদারদের খেলার কথা সুপার লিগ থেকে। তার আগে নির্ভরতার প্রতীক ভাবা হয়েছিল মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে।
যিনি টেস্ট আর টি-টোয়েন্টির পর ওয়ানডে দল থেকেও বাদ পড়ে মানসিকভাবে চরম অশান্তি ও অস্বস্তিতে। তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেল কি না! এই চিন্তা কুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে রিয়াদকে। বয়স হয়েছে। ক্ষিপ্রতা, চপলতা কমে গেছে। আগের মত লম্বা ইনিংস খেলতে পারেন না। আক্রমণাত্মক ব্যাটিংটাও আগের মত নেই। তার সঙ্গে জাতীয় দলে নিজের ভবিষ্যত অনিশ্চিত। তা ভেবেই অস্থির। রিয়াদ নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন।
লোয়ার মিডল অর্ডারে নেয়া হয়েছে আরিফুলকে। তিনিও নিজের স্বর্ণ সময় পিছনে ফেলে এসেছেন। জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েছেন। আর ফেরার মত অবস্থাও নেই।
একই কথা খাটে শুভাগত হোমের বেলায়ও। কোয়ালিটি প্লেয়ার। ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বোলিংটাও পারেন; কিন্তু তারও জাতীয় দলে ফেরার অবস্থা নেই। কারণ জাতীয় দলে ফেরার যে প্লাটফর্ম, সেই হাই পারফরমেন্স ইউনিটেও নেই দু’জনার কেউ। মানে জাতীয় দলে ফেরার ক্ষেত্রটাই আর তাদের নেই।
খুব স্বাভাবিকভাবে আরিফুল ও শুভাগত হোমের তেড়ে-ফুঁড়ে ভাল খেলার সেই প্রবল ইচ্ছেটাই এখন মরে গেছে। নিজেকে মেলে ধরার যে দৃঢ় সংকল্প ও জোর তাগিদ- তার সবই গেছে কমে। যেনতেন ভাবে খেলে লিগটা পার করাই যেন তাদের লক্ষ্য। তাই শুভাগত হোম আর আরিফুল এবার একদমই নিষ্প্রভ, অনুজ্জ্বল। তারা সেভাবে সার্ভিস দিতে পারছেন না।
তাদের পরিবর্তে এইচপির দুজন তরুণ অলরাউন্ডার দলে থাকলে তারা নিজের ভবিষ্যতের জন্যই মোহামেডানের মত বড় দলে এসে সব কিছু উজাড় করে দিয়ে খেলতেন। দল উপকৃত হতো; কিন্তু তা হয়নি।
একই অবস্থা পেস বোলিং আর স্পিন ডিপার্টমেন্টেও। গতবার দলে থাকা তাসকিন, এবাদত আর হাসান মাহমুদদের মত বোলারদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে এবার। অথচ রেখে দেয়া হয়েছে লাল বলের (টেস্ট দলের) বোলার আবু জায়েদ রাহী ও খালেদ আহমেদকে। অপর পেসার কামরুল ইসলাম রাব্বিও মাঝে যুক্তরাষ্ট্র চলে গিয়েছিলেন। অনুশীলনে ঘাটতি থাকায় তিনিও নিজেকে মেলে ধরতে পারছেন না।
মোটকথা, মোহামেডানের পেস ডিপার্টমেন্টে সাদা বলে পারদর্শী পারফরমারের একজনও নেই। তার চেয়ে লাল বলের বোলার দিয়ে দলটাকেই ভারী করা হয়েছে শুরু। পরিণতিও ভোগ করছে তারা। এবারের লিগের এখন পর্যন্ত সর্বাধিক ৩৪৯ রান উঠেছে মোহামেডানের বিপক্ষে।
একইভাবে দলে স্পিনার নেয়ার ক্ষেত্রেও দেখিয়েছে রাজ্যের অদুরদর্শিতা। প্রতিটি দলে অন্তত একজন বাঁ-হাতি এবং একজন জেনুইন অফস্পিনার নেয়া হয়েছে। মোহামেডান শুভাগত হোমের ওপর নির্ভর করেছে বেশি। শুভাগত কতটা ফর্মে আছেন, তার আসলে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে বোলিং করার তীব্র ইচ্ছে আছে কি না- তা খুঁটিয়ে দেখা হয়নি। শুভাগত হোম সে অর্থে অফস্পিনার হিসেবেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছেন না।
বাঁ-হাতি স্পিনার হিসেবে হাসান মুরাদ, রাকিবুল, তানভির ইসলাম, সানজামুল ইসলাম নয়নের কাউকে না নিয়ে নেয়া হয়েছে প্রায় ৪০ ছুঁই ছুঁই এনামুল জুনিয়রকে। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়ের নায়ক এনামুল জুনিয়র। বরাবরই দীর্ঘ পরিসরের বোলার হিসেবে সমাদৃত। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে তার কার্যকরিতা বরাবরই তুলনামূলক কম। এনামুল জুনিয়রের পরিবর্তে একজন তরুণ স্পিনার থাকলে তিনি হতে পারতেন শ্রেয়তর বিকল্প।
ভিনদেশি ক্রিকেটার সংগ্রহেও মোহামেডান দুরদর্শিতার চাপ রাখতে পারেনি। অনেক দলের চেয়ে পিছিয়ে তারা। সাদা-কালোদের হয়ে খেলছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অলরাউন্ডার অনুষ্টুপ মজুমদার। তার মান কেমন, তা এরই মধ্যে টের পেয়ে গেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকরা।
ঢাকা লিগের চাপ ও প্রতিদ্বন্ত্বীতামূলক পরিবেশ মানিয়ে নিয়ে পারফর্ম করতে দরকার শক্ত ও কঠিন মানসিকতার। তাই বেশিরভাগ দল ভারতের অন্য প্রদেশের ক্রিকেটার- বিশেষ করে তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, হায়দরাবাদের ক্রিকেটার দলে ভিড়িয়েছেন। মোহামেডানেই খেলছেন বাঙালি অনুষ্টুপ। তিনি নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি একদমই। যেখানে অন্য দলের ভিনদেশিরা হয়ত সেঞ্চুরি না হয় হাফ সেঞ্চুরি হাঁকাচ্ছেন, সেখানে মোহামেডানের অনুষ্টুপের ব্যাট থেকে এখনো একটি অর্ধশতকও বের হতে পারেনি। দলের কঠিন সময়ে হাল ধরার মত সাহস দেখা যায়নি তার মধ্যে।
এতো গেল দর গঠনে অদুরদর্শিতা আর ক্রিকেটারদের অফফর্মের কথা। মোহামেডানের ব্যর্থতার সাতকাহন আরও লম্বা। কোচ নিয়োগেও এ ঐতিহ্যবাহি দলটি এবার দেখিয়েছে চরম অদুরদর্শিতা ও অদক্ষতা।
কার্যত মোহামেডান এবার প্রিমিয়ার লিগে খেলছে হেড কোচ ছাড়াই। খেলোয়াড়ী জীবন শেষে প্রতি বছর হয় বোলিং কোচ না হয় সহকারী কোচের দায়িত্ব পালন করা আশিককে প্রধান কোচের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
আগের বার সারোয়ার ইমরানের কোচিংয়ে দল রেজাল্ট পায়নি, তাই তাকে এবার আর রাখা হয়নি। তার পরিবর্তে আসলে কাকে হেড কোচের দায়িত্ব দেয়া হবে- তা ঠিক না করেই দল সাজিয়েছে মোহামেডান। অর্থ্যাৎ, একজন কোচ যেখানে কার্যকর ক্রিকেটার বাছাইয়ে ভূমিকা রাখেন, সেখানে ‘মাথামোটা কর্মকর্তাদে’র মতোই দল সাজিয়েছে ক্লাবটির কর্মকর্তারা।
যেখানে খালেদ মাহমুদ সুজন আবাহনী, মোহাম্মদ সালাউদ্দীন প্রাইম ব্যাংক, সোহেল ইসলাম শেখ জামাল, মিজানুর রহমান বাবুল গাজী গ্রুপের কোচ হিসেবে দল গুছিয়েছেন, সেখানে মোহামেডান একজন সহকারি কোচকে প্রথমবার দল পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে দল বদলের পর।
যিনি আগে কখনো কোনো ছোট দলেরও প্রধান কোচের দায়িত্ব পালন করেননি, প্রিমিয়ার লিগের মত আসরে তিনি কি করবেন? মোহামেডানের মত এতবড় দলের দায়িত্ব সামলাবেন কিভাবে? প্রশ্ন থেকেই যায়। মোটকথা, সাকিব... সাকিব করে ‘হাইপ’ তোলা, একঝাঁক নামসর্বস্ব ফর্মহীন পারফরমারের আধিক্য এবং তরুণ সম্ভাবনাময় ও তেজোদ্দীপ্ত পারফরমারের ঘাটতিই মোহামেডানের মাঠে ব্যর্থতার মূল কারণ।
এআরবি/আইএইচএস